★ – এতো রাতে ফোন করলি কেন? তোর হাজবেন্ড কোথায়? তারিকের আওয়াজে বিরক্তির ঝাঁঝ।
– আনহ্যাপি মহিলারাই এত রাতে এইভাবে ফোন করে।
মিলার মুখ গাল কান থেকে গরম ভাপ উঠতে লাগলো, কঠিন গলায় বললো,
– রাত সাড়ে দশটা, তুই তখন বললি বলেই ফোন করলাম। যাকে তাকে রাত্রে ফোন করি না আমি। রিসিভ ও করি না।
তারিকের মেজাজ একই রকম খারাপ,
– তাতে কী? ঘুম ভেঙ্গে দিলি কেন? এখন আমি কি করবো?
মিলা অপ্রস্তুত,
– sorry , ঘুমা। রাখি।
তারিক ধমক লাগালো,
– রাখবি না। সারা রাত কথা বলবি।
– sorry
গম্ভীর হয়ে ফোন কেটে দিলো মিলা।
অনেকগুলো খারাপ অনুভুতি একসাথে হচ্ছে ওর। বিশ্রী লাগছে। সত্যি সত্যি ও বাসায় একা। ঘুম আসছে না। কী বললো তারিক? মিলা কি এই জন্য তারিককে ফোন করেছে?
মনটা খারাপ হয়ে গেলো মিলার।
টিভির, বই এর নেশা ও ছুটে গেছে অনেক বছর আগে। ভালো লাগে না। অনেক বছর ধরে নির্ঘুম রাত, নি:সঙ্গ দিন, কারণে অকারণে লোকজনের খারাপ ব্যবহারকে স্বাভাবিক বলে বুঝে নিয়েছে ও। তবু তারিকের ব্যবহারে খুব অপমান লাগলো।
আবার এক রকম মমতাও যেন টের পাচ্ছিলো। বেচারার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। একা মানুষ। আর হয়তো সহজে ঘুমটা আসবেও না।
অপরাধী মনে হতে লাগলো নিজেকে মিলার। মাথা নিচু করে বাগানের চেয়ারটাতে বসে ভাবতে লাগলো ও।
অনেকক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
‘সমস্যা আছে।’
তার মন ওয়ার্নিং দিলো।
সতর্ক মিলা মনে মনে তারিককে দুটো প্রশ্ন করলো,
‘এত কিছু থাকতে কেন তোর মনে হলো আমি আনহ্যাপি? কেমন আছিস তুই?’
ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। চাইলেও টিভি দেখে বা বই পড়ে সময় কাটাতে পারে। হয়তো তাইই করা উচিত। নিজের এলাকার বাইরে পা ফেলাটা বোকামি। তারিকের কথাগুলো মনে পড়লেই নিজের উপর নিজের রাগ লাগতে থাকলো মিলার। তার একা থাকারই অভ্যাস। এক এক সময় এক এক কাজের ভুতে পায় ওকে। তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
বন্ধু বলতে শেয়ারিং কেয়ারিং এর ইনফর্মাল যা ইচ্ছা তাই বলার কেউ মিলার কোনদিন ছিলো না। অনেক বন্ধু নিয়ে একটা কাজ চিন্তায় আসার পর সে ফর্মাল বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেছিলো।
মোটামুটি একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেলেই আইডিয়াটা বলা যাবে ভেবে সে সবার সাথে বেশ নিয়মিত কথাবার্তা বলতে লাগলো।
এই রকম একটা অবস্থায় সে তারিককে পেলো বন্ধুদের আড্ডায়। ভার্সিটিতে পড়ার সময়ে কমন দুই এক জন বন্ধুর আড্ডায় দেখা হয়েছে দুই একবার। সৌজন্যই। ঠিক বন্ধুত্ব নয়। ক্লাসমেট।
আঠারো বিশ বছর পর যোগাযোগে নিজেদের পুরনো দিনের জন্য ভালোবাসাটাই নিজেদের অজান্তে একে অন্যের সাথে শেয়ার করতে শুরু করলো। মধ্যবয়সের সয়ে যাওয়া নি:সঙ্গতা হঠাৎ অসহনীয় হয়ে উঠলো।
তারুণ্য নয়, মন চাইলো প্রথম কৈশোর ফিরে পেতে।
যে যার নিজের অতীতে ফিরে গেলো। হৈ হল্লা, ঝগড়াঝাঁটি, অভিযোগের গোলমালে তাদের আসল বয়সটা কখন হারিয়ে গেলো কেউ খেয়ালই করতে পারলো না। সময়ের সাথে সত্যি সত্যি বুদ্ধি শুদ্ধিও চলে গেলো। যার চিন্তায় যা প্ল্যান ছিলো সমস্তই ভেসে গেলো। দু’জন ব্যস্ত রইলো কথা কাটাকাটি, ঝগড়ায়।
কোন কথাটা বলার, কোনটা নয় খেয়াল ও রইলো না কারো। অবশেষে যখন হুঁশ হলো, তখন দু’জনই সত্যিকার সমস্যায় পড়ে গেলো।
তবে, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। পথ তো থাকেই। তারা কানাগলির শেষ থেকে আবার বড় রাস্তায় ফিরে চললো।
…
তারিকের প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল।
সাধারণত ঘুম ভেঙ্গে গেলে, সহজে আর ঘুমাতে পারে না। এজন্যই মিলার ফোনে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে এতটা চটেছিল। আর রাগটা আরো বেড়ে গেলো কথা শেষ না করেই হুট করে ফোনটা কেটে দেয়াতে।
বছর যদি ৩৬৫ দিনে ধরা হয়, তবে তারিক ২৮৭ দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একজন ‘বিবাহিত ব্যাচেলর’ রুপে দিন কাটায়। প্রাইভেট কোম্পানির গোলামি বলে কথা। দেশের ভিতরে থেকেই বিদেশে চাকরি করার অনুভূতি! কেমন এক বিশাল প্রাপ্তি মনে হয় তারিকের কাছে। ভিসাবিহীন, খরচাবিহীন মুফতে অনুভূতি লাভ!
নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে এক জেলায় রেখে, নিজে অন্য এক জেলায় থাকে। একা। একটি ১৩০ বর্গফুটের ছোট্ট রুমের ভিতরে রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত কাটাতে হয়। এরপর রুমে ঢুকেই কোনোমতে খেয়ে নিয়ে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয়া। ছোট্ট একটা টিভি নিজের মত চলতে থাকে। বিনোদনের ব্যবস্থা এই টিভি আর মোবাইল ফোন। প্রায় রাতই টিভি চলতে থাকে, তারিক ঘুমিয়ে পড়ে। মোবাইলে কথা বলার থেকে নেট ব্যবহারই করে বেশী।
আজও নেট ব্যবহার করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল.. মিলার কলটা যখন আসলো, রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গতেই মোবাইলটা পিঠের নিচে আবিষ্কার করে।
ডিসপ্লেতে মিলার নামটা দেখে প্রচন্ড একটা সুপ্ত ক্রোধের ধীরে ধীরে জেগে ওঠাটা টের পায়। বুকের গভীরে একটা আগ্নেয়গিরির গভীর তলদেশ থেকে প্রচন্ড জমাট বাঁধা কিছু নির্বাক অভিব্যক্তি খুব দ্রুত কিছু শীতল অনুভূতিকে সাথে নিয়ে ক্রমেই উপরে উঠতে থাকে। আর উত্তরোত্তর উত্তপ্ত হতে থাকে।
কেন এই রাগ? মিলার সাথে ওর সম্পর্কটা কেমন? দু’জনের ভিতরের এই সম্পর্ককে তারিক কিভাবে দেখছে? নিজের মনে এতোগুলো প্রশ্ন শুধু যে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে এখনই উঠেছে, তা নয়। কাজের ভিতরে কি কাজের অবসরে, এই প্রশ্নগুলো বহুবার ওর মনে উঠেছে। কিন্তু কখনোই সদুত্তর পায়নি।
পায়নি নাকি পেয়েও উপলব্ধি করাতে চায় না?
নিজের বউ বাচ্চা রয়েছে। মিলার স্বামী সন্তান। এসব কিছুকে অতিক্রম করে কেমন এক দুর্বোধ্য সম্পর্কের মায়াজালে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে ক্রমশঃ আরো গভীরে নেমে যাচ্ছে সে।
এই বয়সে কী সে মিলাকে ভালোবেসে ফেলেছে?
জীবনের অনেকটা পথ অন্য কারো হাত ধরে হেঁটে হেঁটে এই বিষন্ন বেলাভূমে নতুন অন্য কাউকে নিয়ে একটি অচেনা ফিরতি পথ ধরে এক আনন্দময় ট্রেইলের কল্পনা করাটা কি ঠিক হচ্ছে? শোভন হচ্ছে?
তবে এই ভাবনায় যে কিছু বৈসাদৃশ্য রয়েছে, বিছানায় উঠে বসে ভিতরে ভিতরে কাঁপতে থাকা অবস্থায় তারিক অনুধাবন করে। ওর এই মুহুর্তের চিন্তাধারায় ‘বিষন্ন বেলাভূমি’ এবং ‘অচেনা ফিরতি পথ’ ধরে ‘এক আনন্দময় ট্রেইলের’ কল্পনা করা হয়েছে। বিষন্ন বেলাভূমি কখনো আনন্দময় ট্রেইলের উৎপত্তি ঘটাতে পারে না। আর ফিরতি পথ অচেনা হয় কিভাবে? যে পথে সামনে আগানো হয়েছে, আবার সেই পথে ফিরে যাওয়া হয় বলেই না সেটাকে ফিরতি পথ বলে।
কিন্তু নিজেই নিজের ভাবনাগুলোর উত্তর দেয়। ফিরতি পথ অবশ্যই অচেনা হতে পারে। যখন অচেনা কাউকে সাথে নিয়ে হাত ধরে নিজের চিরচেনা পথে ফিরে আসা হয়, তখন পরিচিত পথটিও অচেনা হয়ে উঠে।
তবে কি মিলা ওর অপরিচিত? যাকে নিয়ে সে জীবনের বাকি পথটুকু এক আনন্দময় ভ্রমনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে চায়!
কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে তারিকের।
একটা ঘোরের ভিতরে চলে যায় সে। ওর এই রুমের বাথরুমের শাওয়ারটির নিচে দাঁড়ালে মাঝে মাঝে সে এই অনুভূতি পেয়ে থাকে। প্রচন্ড পানির গতি, উপর থেকে সারা শরীরে আছড়ে পড়ার অদ্ভু্ত মাদকতার পরশ বুলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি! বেশ আগে ছেলেবেলায় এক বৃষ্টির দিনে প্রচন্ড স্রোতের ভিতরে খালে নেমেছিল সে। অল্প অল্প সাঁতার শিখেছিল। হঠাৎ স্রোতের টানে খালের পানির ঘূর্ণিতে তলিয়ে যেতে যেতে চোখে ভাসছিল পানির ভিতর থেকে গজিয়ে উঠা হোগলা গাছের লম্বা ফুলের হলুদাভ অবয়ব। বৃষ্টির পানির ঠান্ডা অনুভূতিকে ছাপিয়ে কেমন উষ্ণ আরামদায়ক অনুভূতি এনে দিচ্ছিল খালের পানি। আর ডুবে যেতে যেতে নাকে মুখে পানি প্রবেশের সময়ের সেই প্রচন্ড সাইনাস পেইনের অনুভূতিও মুহুর্তে অনুভব করে।
সেবার অবশ্য নিয়তিই ওকে তীরে এনে ফেলেছিল। ওহ! পায়ে যখন মাটির স্পর্শ পেয়েছিল, আর বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকণার শীতল ছুঁয়ে দেয়ার মাঝে ঝাপসা চোখে কালো আকাশকে দেখেও যে অসাধারণ ভালোলাগার অনুভূতি জেগেছিল!
আজ মিলাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সময়েও কি এই সবগুলো অনুভূতি ক্রমান্বয়ে তারিককে ঘিরে ধরছিল?
মিলা!
মিলাকে নিয়ে অচেনা ফিরতি পথ ধরে আনন্দময় ট্রেইলের সন্ধান লাভের চিন্তাটা শাওয়ারের প্রচন্ড গতিতে শরীরে পানির স্পর্শের সুখানুভূতি কি এনে দেয় না? আর চলমান বাস্তবতা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট বৃষ্টির শীতল ফোটার সাথে খালের স্রোতে তলিয়ে গিয়ে খাবি খাওয়ার অনুভূতিই কি নয়? আর এসব কিছুকে ছাপিয়ে জীবনের পিছনের ট্রেইল মুছে দিয়ে, এতোদিনের সম্পর্কগুলোকে নষ্ট করে, মিলার হাত ধরে অচেনা ফিরতি পথে চলার মত মনোবলের অভাব সেই তীব্র সাইনাস পেইন হিসেবে কাজ করে।
একটা ১৩০ বর্গফুটের রুমের ভিতরে তারিক নামের এক মধ্যবয়সী নিজের জীবনের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ যেন দিক হারিয়ে ফেলে। অনুভূতিতে একজন সম্পর্কহীনা সকল সম্পর্কের মূল উৎস হতে চেয়েও কেন জানি হতে পারে না। শুধুমাত্র হৃদয়ের অনুভূতি দিয়েতো আর জীবন যেখানে অন্তরীণ, সেই ক্ষেত্রকে অতিক্রম করা যায় না। তাই তারিকও জীবনের বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারে না।
বহু যত্নে হৃদয়ে লালিত একটি ফিরতি পথ ধরে অচেনা কাউকে সাথে নিয়ে পথচলা আর হয়তো ওর হয়ে উঠবে না।।
.
#ফিরতি_পথে_মামুনের_অণুগল্প
মামুনের ৫০টি অণুগল্প // গল্প নং-৮
loading...
loading...
শব্দনীড়ের পাতায় অসংখ্য কবিতার ভীড়ে আপনার লিখা আমি বিশেষ দৃষ্টিতে বিশেষ সম্মানে পড়ি। পাঠাভ্যাস পরিবর্তন হতে কার না ভালো লাগে। শুভেচ্ছা মি. মামুন।
loading...
শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলাম শ্রদ্ধেয় লেখক
loading...