অণুগল্প : সুরুজ্জামানের একদিন
কিভাবে গল্পরা লেখকের হৃদয়ে জন্ম নেয় শুনতে চান? এক স্বাভাবিক দুপুরে, বাউরি বাতাসে, মন ভিজে যেতে যেতে পলকের তরে লেখক নিজেকে বিস্মৃত হন। অনেক আগে, প্রচন্ড গরমে পিচ ঢালা তপ্ত পথ ধরে, একজন সুরুজ্জামানের রৌদ্রক্লান্ত দেহের টেনে যাওয়া বড্ড স্পষ্ট ভাবে চোখে ভাসে। এক ছায়াসঙ্গী হয়ে নিজ সৃষ্ট চরিত্রের পিছু নেন লেখক। অসহ্য অলস গতিতে ছায়ার কায়াকে অনুসরণের মত…
প্রচন্ড পানির পিপাসা। যেখানে গন্তব্য, তার মাঝপথে দাঁড়িয়ে জিভ বের করা কুকুরের মত হাঁফাতে থাকে। পেছনের ফেলে আসা পথে, এক গাছের ছায়ায়, একজন শরবত বিক্রী করছে। বরফকুচি মেশানো শরবত বিক্রী করতে দেখার দৃশ্যটা এই মাঝপথে এসে, হঠাৎ বড্ড তীব্র হয়ে অনুভূত হয় সুরুজ্জামানের। খরখরে জিভটা আরো শুষ্ক হয়। পকেটে সম্বল তিন টাকা। এক গ্লাসের দাম দশ টাকা। পিচ থেকে আগুন বের হচ্ছে। গরম বাতাস সেই আগুনকে টেনে এনে ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহমন। বড় কষ্টকর জীবন! আসলেই…
সামনে একটা পানির কল। দেখে আগায়। নিঃসঙ্গ এক শালিক নষ্ট কলটির ফোঁটা ফোঁটা পানির অণূকণায় পিপাসা মেটাতে চাইছে। সুরুজ্জামান কাছে যেতেই নিস্ফল আক্রোশে চিৎকার করে উড়ে যায়। তবে একেবারেই চলে যায় না। একটু দূরে নিরাপদ দূরত্বে অপেক্ষমান। রাস্তার পাশের শিরিষ গাছটির নিচু ডালের পাতায় বসে ক্ষোভ জানাতে থাকে শালিকটি।
একপলক দেখে সুরুজ্জামান। ওর ঘোলাটে চোখে কোনো ভাব জাগে না। নীরবে সামান্য সময়ের বিরতিতে নিচের ঘন সবুজ শ্যাওলার বুক ভিজিয়ে দিতেই, পরবর্তী ফোঁটাটি জন্ম নেয় পাইপের বুকের গভীর থেকে। করতল মেলে ধরে অপেক্ষায় থাকে এক দ্বাবিংশ বর্ষীয় যুবক। এক কাঠফাটা দুপুরে।
বাবার অফিসে যখন পৌঁছায়, লাঞ্চ টাইম মাত্র শেষ হয়েছে। অলস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাতঘুমের আবেশে ঢলে ঢলে পড়ছে। অলস আয়েসী মুহুর্তগুলি এই প্রতিষ্ঠানটিকে ভেতর থেকে ঘিরে রেখেছে। সোজা একাউন্টস সেকশনে চলে যায় সুরুজ্জামান। এখানেই যেতে বলে দিয়েছেন বাবা।
বাবা! শব্দটা মনে হতেই একজন নুয়ে যাওয়া যুদ্ধক্লান্ত মানুষ চোখে ভেসে ওঠে মুহুর্তে। নুয়ে যাওয়া এক অবয়ব। জীবনের এতগুলি ধাপ পেরিয়ে আসা একজন পরাজিত মানুষ? মাস ছয়েক হল আরো কয়েকজনের সাথে ‘সাসপেন্ড’ অবস্থায় রয়েছেন। কি হয়েছিল না হয়নি, কিছুই জানা হয়নি ওর। জানতেও চায় না সে। তবে না খেয়ে থাকার কষ্টে বিগত দিনগুলিতে কখনো কখনো একেবারেই যে জানতে ইচ্ছে হয়নি, তাও নয়।
মা কি কষ্ট করে এক একটি দিনের খাবার জোগাড় করছেন, এক একজনের অভ্যাসগত পছন্দ-অপছন্দকে সুন্দরভাবে সামাল দিতে মা-কে কতটা কষ্ট সইতে হচ্ছে… সব অনুভব করলেও কিছুই করতে পারেনি সে। নিজেও এতটা বড় হয়ে একটা কাজ যোগাড় করতে পারেনি। পড়ালেখাও শেষ হয়নি। একটা সার্টিফিকেট অর্জনের থেকে সে এখনো বেশ দূরে। ঠিক এই মুহুর্তেই বাবার এই সাসপেন্ডেড অবস্থা।
জীবনটা সাত সদস্যের এই পরিবারটির জন্য আক্ষরিক অর্থেই নরক হয়ে উঠলো!
আত্মীয়স্বজনেরা ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আসলে বাস্তবতা বড়ই কঠিন। অসময়ে কেউই থাকে না। অথচ সুসময়ে কি রমরমা অবস্থা। দুধের মাছিরা আজ কে কোথায়?
বেতনের একটা অংশ গত ছ’মাসে জমেছে। সেটা নিতেই বাবা ওকে সেই কয়েকশ’ কিলোমিটার দূরত্ব ঠেলে পাঠিয়েছেন। আসার ভাড়াটাই কেবল দিতে পেরেছেন বাবা। মা কিছু খাবার তৈরী করতে রাতের বাড়তি সময়টুকু জেগেছেন। লঞ্চে আসার সময়ে সেগুলি কাজে লেগেছে। সকালেও নাস্তা হিসেবে শেষাংশটুকুর সদ্ব্যবহার করেছে।
একাউন্টসে যিনি টাকা দেবার দায়িত্বে, তিনি ওকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলেন। বাবার নাম শুনেই যেন তিনি আগ্রহ হারালেন। এই লোক ওর পরিচিত নন। ছ’মাস পূর্বের এই শহুরে জীবনের অভ্যস্ত জীবনে সামাজিক আবহে বিভিন্ন পার্বণে কখনো সুরুজ্জামান এই লোকটিকে বাসায় দেখেনি। বাবার কলিগদের সাথেও কখনো এই লোক আসেন নাই। হয়ত নতুন জয়েন করেছেন। তবে একজন সহকর্মী যখন সাসপেন্ডেড থাকেন, তখন অন্যদের কাছে তিনি যেন মৃত! এতগুলি বছরের সৃষ্ট পারষ্পরিক সম্পর্ক যেন কোথায় হারিয়ে যায়! আসলেই কি কোনও সম্পর্ক কখনো তৈরি হয় এদের মাঝে? হলে এত দ্রুত ভাঙ্গেই বা কিভাবে?
সামশু ওনার নাম। তিনি এসে আবেগবিহীন স্বরে টুকটাক কথা বললেন। যেগুলির কোনো অর্থই হয় না। নিরর্থক একা-ই বলে গেলেন। ক্ষুধার জ্বালায় সুরুজ্জামান কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ শুনে গেলো। ওর চোখে পথের পাশের ঝুপড়ি দোকানের ভেতরে সাদা ভাত আর গরুর গোশতের ঝোল ভাসছিল। টাকাগুলি হাতে পেলে, এখান থেকে বের হয়েই প্রথম সুযোগে খেয়ে নিতে হবে। যতটা কম খরচে পারা যায়। চিন্তা-ভাবনার এই পর্যায়ে অভুক্ত ছোট ভাই-বোনদের মুখগুলি ভেসে ওঠায় ভেতরে ভেতরে তাড়া অনুভব করে সে।
হিসাব করে বাবার ছ’মাসের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে দু’জায়গায় ওর স্বাক্ষর নেন সামশু সাহেব। তাকে সালাম জানিয়ে হাসিমুখে চেয়ার ছেড়ে উঠবে, এমন সময় অন্য একজন রুমের ভেতরে ঢুকেন। সামশু সাহেবের সিনিয়র হবেন। তার পাশের টেবিলে বসে সুরুজ্জামানের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালে সামশু সাহেব জানায়,
– স্যার, মাহতাব সাহেবের ছেলে। ভ্যাটের মাহতাব সাহেব, ঐ যে মাস ছয়েক আগের মেয়র কেলেংকারি…
কথা শেষ না করে উর্ধতনের দিকে তাকায় সামশু। ওর কর্তা ব্যক্তি এবার কথা বলেন,
– তো এখানে কি জন্য এসেছে?
– মাহতাব সাহেবের গত ছ’মাসের হাফ বেতন নিতে এসেছে।
– দিয়েছ নাকি?
– জি স্যর, অনেকক্ষণ হলো এসেছে। সব ফর্মালিটিজ শেষ। এখন চলে যাবে, আপনিও এলেন।
– দেবার আগে আমার কাছে জিজ্ঞেস করবে না? উত্তেজিত স্বরে জানান উর্ধতন কর্তা।
সুরুজ্জামান এবং সামশু দু’জনেই অবাক হয়ে বক্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কর্তা ব্যক্তি সামশুকে লক্ষ্য করে বলেন,
– মাহতাব সাহেব সহ বাকীদের বেতন হেল্ডয়াপ করার ব্যাপারে কমিশনারের নির্দেশ এসেছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ধরণের লেনদেন না করার জন্য সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে।
নিজের ফাইল কেবিনেটের বিশেষ একটি ফাইলের দিকে অংগুলি নির্দেশ করে সামশুর দিকে তাকান তিনি। একটি প্রতিষ্ঠানের বদ্ধ কেবিনে তিনজন ভিন্ন বয়সী মানুষকে ঘিরে সময় যেন স্থির হয়ে বড্ড বিব্রতবোধ করে।
বাবার অফিস থেকে বের হয়ে একটা দুই টাকার নোট আর এক টাকার কয়েন হাতে সুরুজ্জামান পথে হেঁটে হেঁটে ভাবে, ‘এই তিন টাকায় কি খাওয়া যায়?’ কিভাবে সে বাড়ি ফিরবে কিংবা বাড়িতে ওর টাকার পথ চেয়ে অপেক্ষারত ছয় সদস্যের অভুক্ত মুখ এই মুহুর্তে একবারও ওর চোখে ভাসে না। প্রচন্ড এক ক্ষুধা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়…তিন সংখ্যার গুণাগুণ বড্ড তীব্র হয়ে বাজে একজন দ্বাবিংশ বর্ষের যুবকের হৃদয়ে। প্রচন্ড গরমের এক দুপুরে পিচ ঢালা পথের পেভমেন্ট ধরে হেঁটে চলে সে উদ্দেশ্যবিহীন…।।
#মামুনের_অণুগল্প
loading...
loading...
সুরুজ্জামান আমাদেরই পার্শ্বচরিত্র। এমন সব চরিত্রেই জড়িয়ে আছে আমাদের নিত্যদিনের বাস্তবতা। প্রতিবাদ হয়না। প্রতিবাদের জন্য প্রতিবাদী পাওয়া যায় না।
loading...
সুরুজ্জামানদের একদিন নয়; আমি অন্তত বলতে পারি প্রায় দিনের। দূর্ভেদ্য অন্ধকারে আমাদের সহবাস।
loading...
কতোশত সুরুজ্জামানের সাথে আমার দেখা হয় প্রতিদিন। গুণে বলতে পারবো না। এদের ভাগ্য বদলায় না মহ. আল মামুন ভাই। ভালো থাকুন।
loading...
ভাগ্যিস এখানে শিহাব নেই। চরিত্রের নাম শিহাব হলে বেশী কষ্ট পেতাম।
loading...
অণুগল্পটি পড়লাম মামুন ভাই।
loading...