।। কবিতাঃ একটা গল্প বলি শোনো ।।

[ একটি উপন্যাস লিখে চলেছি অনেক বছর ধরে। প্রথম খন্ড শেষ করে দ্বিতীয় খন্ডের কাজ চলছে। এই সমগ্র উপন্যাসটিকে একটি গদ্য কবিতায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম আমি। আমার কাব্যগ্রন্থ শেষ তৈলচিত্রে এই দীর্ঘ কবিতাটি স্থান পেয়েছে। যারা টেনে কবিতা আবৃত্তি করতে কিংবা এমন ‘টাইপ’ এর কবিতা শুনতে ভালোবাসেন, তারা সাথে থাকতে পারেন ধৈর্য্য নিয়ে; বাকীরা এখান থেকেই ফিরে গেলে চরম বিরক্তিকর বিষয় ‘ধৈর্য্য’র পরীক্ষা দেবার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। ]

একটা গল্প বলি শোনো

মিথিলা বাবু!
আজ তোমায় একটা গল্প বলি শোনো
তোমার বাবার গল্প এটা
বাবাতে মিশে থাকা তোমার মাটি, জল, হাওয়া, রোদ
এ সব মিলিয়েই আজ আজকের তুমি জেনো।

তোমার মত হাসপাতালে জন্ম হয়নি আমার
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মেছিলাম
রহস্যময় কাঠের দোতলা বাড়িতে, আলো-আঁধারিতে
সেথায় রহস্য ছিল অপার।

আমরা পড়া-লেখা করেছি
কেরোসিনের ল্যাম্প ও হ্যারিকেনের আলোয়
বড় একটা উঠান ঘিরে বড় পরিবার
বড় বড় টিনের চৌচালা চারটা ঘরের প্রশস্ত উঠান
ফসল তোলার দিনে গোবর দিয়ে লেপা থাকত
সেখানে ধান মাড়াই হতো গরুর মুখে ঠুসি লাগিয়ে
আমাদের শোরগোলে কাটতো দিন
কেউ দাড়িয়া বান্ধা কিংবা ডাংগুলি খেলতো
উঠানের এক কোণে রান্নাবান্না অথবা ইচিং বিচিং চিচিং।

আমার শৈশবের গ্রাম ছিল নিখাদ নিসর্গ
সূর্য উঠার সাথে সাথে দিনের কর্মচাঞ্চল্যের শুরু
সুর্য ডোবার সাথে সাথে দিনের কোলাহল আর ব্যস্ততার শেষ
সন্ধ্যা নামায় পৃথিবী নিঝুম তখন
তবুও রয়ে যেত ভালোলাগার একটু রেশ।

সারাদিনে যা কিছু দেখতাম-শুনতাম, জানতাম-বুঝতাম
তা থেকে জন্মাতো প্রশ্ন হাজার শত শত
মা’কে, বাবাকে, দাদুকে – যখন যাকে কাছে পেতাম
তার কাছেই জানতে চাইতাম সে সব
উত্তরগুলি একটার সাথে অন্যটা
জোড়া দিয়ে দিয়ে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করতাম ততো।

তোমার দাদাভাইয়েরা ছিলেন তিন ভাই
বাবা আমার ছিলেন আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে গরীব
বড় চাচার দুইটি নিয়ে তিন পরিবারের চারটি টিনের ঘর
অসাধারণ জীবনবোধে ছাওয়া সে এক বিচিত্র সংসার।

সব ঘর বাইরে থেকে দেখতে একই ছিল
উপরে টিনের শীর্ষে চাঁদ তারার নক্সা
আর বিভিন্ন ডিজাইন করা কাঠের সিঁড়িটাও অপুর্ব বেশ
একান্নবর্তী মানুষগুলির কি বিচিত্র সাংসারিক জীবন!
কিছু বুঝতাম কিছু বুঝতাম না
এখন বুঝি, এখন ভাবি, কত সুন্দর ছিল সময় তখন
রাগ, অনুরাগ, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, স্বপ্ন , চেষ্টা নিরন্তর
ব্যর্থতা, কান্না, সফলতা, হাসি-আনন্দ উচ্ছ্বাস
জীবন সাদাসিধা তবু ছিল কত উজ্জ্বল স্বাস্থ্যকর।

বাবা মায়েরা কখনো কেউ কাউকে ভালোবাসি বলেছে
বাবুটা এমন স্মৃতি আমার নাই
দেখেছি তবু তাদের সুখ দুঃখের নিঃশব্দ ভাগাভাগিটাতে
একের জন্য অন্যের শ্রদ্ধা, টান
বড্ড স্পষ্ট ছিলো তখন স্যাক্রিফাইসটা-ই।
তাদের চিন্তাগুলি, কথাগুলি ছিলো হয়ত নিতান্তই সাধারণ
আমাদের থাকা খাওয়া সুখ অসুখ বা পড়ালেখা সংক্রান্ত
তাই দিয়ে যে সংসার গড়েছিলেন তারা
তার মহিমা ভুলে যাচ্ছি আজ আমরা বড্ড রণক্লান্ত।

বিশ্বাস, নির্ভরতা আর বিশ্বস্ততায়
বছরের পর বছর ধীরে ধীরে মহীরুহ হয়ে ওঠা
বাবা মায়ের সেই প্রেমকে তারা
র‍্যাপিং কাগজে মোড়ানো দামী উপহারের মতই লুকিয়ে রাখতেন।
সকলের চোখের আড়ালে মাটির নিচে
নিরবে বইতো তাদের ভালবাসার ফল্গুধারা
তার জল হাওয়ায় সতেজ স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে উঠেছি
আজ আমরা এই পুরানা আছি যারা।

বড় চাচার বাড়িতে প্রতিদিনই ভালো ভালো রান্না হতো
সেগুলোর ঘ্রাণ আসত আমাদের বাড়িতে
মা বাবা তাদের দুই সন্তানের জন্য প্রতিদিন
পারতেন না এই খাবার সংগ্রহ করতে
অতি সাধারণ খাবার তখন আমার মায়ের বিবর্ণ হাড়িতে।

তোমার ছোট চাচু মাকে জিজ্ঞেস করতো ,
‘মা, আজ আমাদের ঘরে মুরগী রান্না করেছো?’
বা হয়ত বলে বসতো, ‘মাংস খেতে ইচ্ছে করছে’
মা এক একদিন কাঁদতেন
এক একদিন রাগ করতেন,
‘তোমাদের যা আছে তা কি সবার আছে? নিজেরটা নিয়ে খুশি হও না কেন?’
বাবা কোন কোনদিন বোঝাতেন,
‘অন্যের জিনিসে চোখ দিতে নেই’।

বাবার কত অসহায় লাগতো এখন তা বুঝি
তাদের কষ্টগুলি সীমাহীন হতো অন্য দুই পরিবারের
স্বাচ্ছন্দ্য আর প্রাচুর্যের সাথে অসম প্রতিযোগিতায়।
মাঝে মাঝে চাচীরা এটা ওটা দিলে মা আরো সংকোচ করতেন
তিনি এর সমান কিছু দিতে পারবেন না জানতেন
তবু কখনো পিঠা পায়েস করতে পারলে দিতেন।
মায়ের মুখটা হাসিতে আলো হয়ে থাকতো তখন!
এদের ভিতরের সুপ্ত ভালোবাসা মাঝে মাঝে চোখ মেলতো
যা অর্থের নিরিখে এক ধরণের দূরত্ব ধরে রাখত
এই তিনটি পরিবার এক সাথে তবু তাদের খাবার ছিল আলাদা
ঈদ কুরবানে বিয়েশাদীতে যাদের পোশাকে আশাকে তারতম্য
তবুও কখনো পাশের বাড়ির সাথে সীমানা নিয়ে বিরোধে
কিম্বা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণকে ধরে ঝগড়া বিবাদে
তিনটি পরিবার ঠিকই এক হয়ে ফুঁসে উঠত সরোবে।

এক রাত্রে খাওয়া শেষে দুই ভাই শুয়ে আছি
আম্মা খাটে উঠে বসেছেন, আব্বা পড়ার টেবিলের
একমাত্র চেয়ারটাতে বসা।
আমি চোখ বন্ধ করে দু’জনের কথা শুনতে পেলাম
সেই রাতে আমার চোখে গ্রামের নতুন একটা ছবি ধরা পড়লো!
অবারিত নীল আকাশ আর দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ মাঠ
খালের স্রোত আর স্কুলের উদ্দাম উচ্ছ্বাস কোলাহলকে পিছনে রেখে
সামনে এসে দাঁড়ালো মানুষ!
নোংরা, হিংস্র রাজনীতির সাথে পরিচয় হলো
জোতদার ভুমিপতিদের শক্তি
আর সেই শক্তি দিয়ে দুর্বল সামর্থ্যের মানুষকে শিকারের নিয়ম জানলাম!
আব্বা আম্মার অচেনা এক রূপ দেখলাম
জানলাম – আমরা গরীব! শক্তিহীন!
শক্তিমানের নির্যাতনের শিকার হবার জন্য উপযুক্ত!

জীবনে প্রথম নিজেকে ঘৃণা করলাম!
ঘৃণায় কী শক্তি তা না জেনেই দুই হাত মুঠো করে শপথ করলাম
বড় হবো! হতে হবেই!
কত আলগোছে সমাজের নির্যাতিত অংশ ছেড়ে
প্রতিবাদী অংশে উঠে গিয়েছি আমরা সেদিন
প্রিয় মিথিলা বাবু!
তা জেনেছিলাম আরো অনেক পরে।

সারা পৃথিবীতে তখন কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের ধাক্কা
যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম দিনগুলিতে তার কম্পন বেশ ভালোই উঠেছিল
শুরুতে টগবগে আবেগ আর দিন বদলের তীব্র আকাংখা
যারা মন প্রাণ সমর্পণ করেছিল তাদের সাথে প্রাণের টানে
বিশ্বাসের আকর্ষণে তোমার এই বাবাও যোগ দিয়েছিল মিথিলা বাবু!
অনেক ভালো ভালো চিন্তা ছিল
কঠিন আদর্শ ছিল
মনে মনে প্রত্যেকেই আমরা এক একজন চে’গুয়েভারা!
পৃথিবীর কোথায় কোন কোণায় সমাজতন্ত্র আন্দোলনে নেমে
‘রে রে ‘ রবে পুঁজিবাদকে তাড়া করেছে
প্রতিদিনের জয় পরাজয়ের খবর স্নায়ুকে টানটান করে রাখতো।
যে কোন রকম ভাংচুর
যে কোন লোকসানের বিনিময়ে হোক যৌথখামার হতেই হবে!
জীবনের কী দাম যদি দুনিয়াকে বদলাতে না পারি?
অনাচার অবিচার বন্ধ করার জন্য যা দরকার
যেভাবে দরকার করতেই হবে!
ধনী – দরিদ্রের বিভক্ত পৃথিবীকে এক পৃথিবী করার জন্য
অন্তত একটা সুখী, দু:খ -দারিদ্র্য-অশান্তিমুক্ত দেশের জন্য
যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসা ‘দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার ‘ শেষ করার জন্য
একটা দুটো জীবন বলি দিলে কী আসে যায়?
একটা দুটো পরিবারের সাময়িক কষ্ট তো নগন্যই
এই উৎসর্গের মহিমা অপার!

দলে তো ঢুকলাম
এক এক করে খুলতে লাগলো এক এক অচেনা জগতের প্রবেশ দুয়ার।
এক সময় আবিষ্কার করলাম
দলে টিকে থাকার জন্য, দলকে টিকিয়ে রাখার জন্য
কখন অজান্তেই দুর্বলের দল ছেড়ে সবলের দলে যোগ দিয়েছি!
শৈশবের চোখে নিজেকে দেখে বংশ পরম্পরায় চেয়ারম্যান পরিবারের
চেয়ারম্যানদের সাথে নিজের খুব বেশি তফাত পেলাম না
বাঘের বদলে শিয়াল হয়ে বাঘ চরাতে শুরু করেছি!
স্রেফ একটি চাঁদাবাজ এবং গলা কাটার রাজনৈতিক দলের সদস্যে পরিণত হয়েছি!
প্রিয় বাবুটা আজ বলছি তোমায় শোনো
তাত্ত্বিকেরা কেবল টাকাই চিনেছে শুধু
মানুষ চিনেনি কোনো।

মিথিলা বাবু!
তোমার দাদা ভাই খুবই চাপা স্বভাবের ছিলেন
চেয়ারম্যানের সাথে এক গন্ডগোলের পর
বড় দুই ভাই উল্টো ওদের পক্ষ নেয়ার ক্ষোভ- দুঃখ
বাবা কোন দিনই ভুলতে পারেননি।
মনের কষ্টে শেকড় উপড়ে একা একজন মানুষ
এই ইটপাথরের প্রানহীন শহরে এলেন
সম্পূর্ণ নতুন এক জীবন শুরু করলেন।

চিরকালই রাজনীতির শিকার হয়ে সাধারন মানুষেরা
জোতদার ভুমিপতিদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়
তাদের সাথে বিবাদে যাওয়া জলে থেকে কুমিরের সাথে লড়াইয়ের মতই
তাতে জিততে হলে সেই জলের বাইরে এসে আরো বড় কুমির হয়ে ফিরতে হয়।

আমার বাবা একদিন সকালে- শীতের সকাল ছিল সেটা
আমাদেরকে নিয়ে গ্রাম ছাড়লেন।
আজ এই এতোদিন পরে স্মৃতিগুলোও কুয়াশাচ্ছন্ন
অনুভূতিতে বড্ড ঝাপসা মনে হয়।
তবুও মনে পড়ে- আমি, আমার ছোট ভাই মা-বাবার হাত ধরে
আমাদের টিনের দোতলা বাড়িটা ছেড়ে বের হয়ে এসেছি
দুই চাচা তাদের ঘরের ভিতর থেকে ক্ষোভে বেরও হলেন না
চাচীরা অবশ্য কাঁদছিলেন.. আর দাদী?
তিনি পাথরের মত নির্বাক হয়ে ঘরের দরোজায় অটল দাঁড়িয়ে!
তার ভিতরে কি ভাবের আদান-প্রদান চলছিল?
তখন বুঝিনি কিছু.. আজ অনেকটা অনুভব করতে পারছি।

খালের পারে এসে দেখি নৌকা তৈরী
সেখানে আমাদের সাথের মালামাল নিয়ে
আমাদের দূর সম্পর্কের চাচা মেরাফ অপেক্ষা করছেন
আমাদেরকে দেখে স্বভাবসুলভ হাসি হাসলেন
হাসিতে বিষন্নতা
মায়ের চোখ অশ্রুসজল
মাফলারে আর কানটুপিতে আবৃত বাবাকে দেখেও
দাদীর মত ভাবহীন অটল পাথরের কথা সেই শিশু বয়সেও মনে হয়েছিল
আমাদেরকেও কান টুপীতে ঢেকে বাবা হাত ধরে নৌকায় তুলেছিলেন
নৌকা ছেড়ে দিল।

আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার পরিচিত গাছপালা
সেই খালের পার, পার থেকে নুয়ে বাঁকা সেই হিজল গাছটি
যার তলায় ছাবি দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরতাম, কত স্মৃতি!
বড় হয়ে বিভূতিভূষনের লিখা পথের পাঁচালি পড়েছিলাম
সেখানে অপুর বোন দুর্গা মারা যাবার পরে
অপু যখন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছিল
তখন অপুর চোখে যে দৃশ্যগুলো ধরা পরেছিল
তা পড়তে পড়তে আমার সেই দিনটা, সেই দিন দেখা সব কিছু,
সেদিনের শোনা সব শব্দ মনে পড়ছিল।
অপুকে মনে হচ্ছিল আমি
আম আঁটির ভেঁপু’র মত রেলের হুইসেলের মত বেজে ওঠা
লঞ্চের সেই ঘাট ছেড়ে যাবার বাঁশীর শব্দে
ব্যথাভরা মনে তোলপাড় করেছিল শুধু একটা প্রশ্ন, ‘আর কি ফিরবো?’

নদীর কিনারের সাথে গ্রামটা যখন ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছিল
সেই সময়ে আমার শিশু মনে গুমরে কাঁদছিলো
বড়দের বিরুদ্ধে নিস্ফল – নি:শব্দ অভিযোগ
‘ কেন ওরা কেউ কারো সাথে একটু ভালো হয়ে থাকতে পারলো না?’
হু হু কান্নায় বুক ভেংগে যাচ্ছিলো
নিরবে চোখের পানি বয়ে যাচ্ছিলো নদীর চেয়ে তুমুল স্রোতে
মূহুর্তে মূহুর্তে ভেসে উঠছিল প্রিয় মুখগুলি,
আমার চিরপরিচিত গ্রাম, প্রতিদিনের খেলার সাথীরা
সরু খাল, খালের উপর সাঁকো, খেলার জায়গাগুলো,
প্রিয় পথঘাট, স্কুল, দোকানপাট
যা কিছুই চোখে পড়ছিলো তাকেই মন বলছিলো,
‘বিদায় বন্ধু! আবার দেখা হবে।‘
কিছু দেখছিলাম চোখে.. কিছু দেখছিলাম মনে মনে।
যা কিছুই মনে পড়ছিলো তাকেই মন বলছিলো,
‘বিদায় বন্ধু! বড় হয়ে ফিরে আসবো! ‘

ছেড়ে যাবার সেই অসীম ব্যথা বহুদিন বুকে টনটন করে উঠেছে
ফিরে যাবার সেই আশাও রয়ে গিয়েছিল অনেক বছর
কতদিন বুকে হাত রেখে ভেবেছি,
‘বড় হই! বড় হয়ে যখন ফিরবো
কেউ আমাদেরকে কিছুতেই গ্রাম থেকে বের করে দিতে পারবে না। ‘

সেই পুরনো স্মৃতি!
আমাদের নৌকা যখন ছাড়ে
বৈঠার ওঠা নামার তালে তাল মিলিয়ে
ছলকে ছলকে উঠতে নামতে থাকা পানির সাথে
ছোট্ট বুকটাতে ছলকে উঠছিলো অচেনা কষ্ট!
নদীর পাড় বেয়ে মাঝির গুণ টেনে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিলো
সে যেন টেনে টেনে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!
যখন লঞ্চে উঠলাম, লঞ্চ ঘাট ছেড়ে যাবার সময়
মেরাফ চাচা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে মনে হচ্ছিল
আমার হৃদয়ে কিছু একটা যেন ভাঙ্গাচুরা হচ্ছে।
শুধু কি একটা গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম সেদিন ?
সে তো ছিলো নিজের জীবনের সাথে বিচ্ছেদ ।

সেদিনের আগে নদীটাকে দেখলেই কতদিন ভেবেছি,
‘জানতে পারতাম – এই নদী কোথায় যায়!’
জানার দিন যেদিন এলো সেদিন সেই নদীকে মনে হলো শত্রু
মনে হলো, ‘কেন নদী এতদূরে বইলো?
নইলে কি এই লঞ্চটা এভাবে আমাদেরকে সবার কাছ থেকে এত দূরে নিয়ে যেতে পারতো?’
আজ হাসি.. যার যেতেই হতো।
নদী হোক না হোক, তাকে তো পথ খুঁজে নিতেই হতো।

গ্রামে চেয়ারম্যানদের থেকে পেয়েছিলাম প্রথম দফায়
শহরে এসেও শ্রেণীবৈষম্য আমার মনে দ্বিতীয় দফায় দাগা দিয়ে গেল
কী ছেড়ে এলাম! কেন সব ছেড়ে এই অচেনা শহরে এলাম?
গ্রামের চেয়ে শহর কিসে আলাদা হলো?
শহুরে সমাজের শ্রেনী বিভেদ আমাকে হতাশ করলো।
মিথিলা বাবু!
আমরা তোমাদেরকে শোষণ মুক্ত একটি সমাজ দিয়ে যেতে পারি নাই
কিন্তু আমরা যে ভুল করেছি, সেগুলো দেখিয়ে দিয়ে যেতে চাই
তোমরা আমাদের মত এই ভুল পথে পা বাড়াবে না
এখন বড় হয়েছো। ভালো মন্দ বুঝতে পারছো
তোমাকে আমাদের সময়টা দিলাম
এতে মিশে যাও
এ থেকে নিজের মত করে যা ভালো নিয়ে নিজেকে পুর্ণ করে নাও
এ এক আয়নাও
এতে দেখতে কি নিজেকে তোমার অন্যরকম লাগছে?

সেই দেশ এখনো আছে
আমরা বড় হয়েছিলাম
কি করে যেতে পারলাম জানিনা
তোমরা কি আমাদেরকে দোষী ভাবছো?
ব্যর্থ ভাবছো? যথেষ্ট চেষ্টা করিনি ভাবছো?
তোমাদের সময়টা কি আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক সামনে চলে গেছে?
হয়তো পিছনের মানুষ আমরা
তবু তোমাদের পথের শুরুটা আমাদের এলোমেলো পায়ে চলা থেকেই
তুমি কি এভাবে ভাবো মিথিলা বাবু?
তোমাদের রাজপথের পিচের নিচে আমাদের কাঁচা মাটির পথ এখনো আছে
তার ধুলোমাটির ঘ্রাণ পাও?

এখন যদিও চরম বৈরী সময়
দুঃস্বপ্নগুলি সময়ের বুকে আঁকা
সুসময়গুলোকে কেড়ে নিয়ে এসো
এখন এভাবেই ভালো থাকা।
.
বাবুটা আমার প্রিয় মিথিলা তুমি
গল্প বলছি শোনো
জীবনবোধের পাতায় জড়ানো গল্পটা মোর
সব বাবাদেরই জেনো।।

___________
প্রচ্ছদঃ চারু পিন্টু

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১০ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২২-০৩-২০১৯ | ১১:২৯ |

    আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি … আমি এই কবিতার শুরু থেকে শেষ অবধি পড়েছি। লিখাটি অবিষ্মরণীয় হয়ে থাকবে মি. মামুন। জীবনবোধ আর প্রজ্ঞার যে পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যই অতুলনীয়। অভিনন্দন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৯-০৪-২০১৯ | ২২:৩৩ |

      আপনি কবিতা যে উপন্যাসের ছায়া, তা ও পড়েছেন। আমাকে আপনার থেকে বেশী কে আর জানেন?

      অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থাকুন ভালো লাগায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে। শুভেচ্ছা… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. রিয়া রিয়া : ২২-০৩-২০১৯ | ১১:৪৮ |

    লেখাটি আমি ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখলাম প্রিয় গল্প দা। আপনার জন্য শুভকামনা। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৯-০৪-২০১৯ | ২২:৩৪ |

      আমি কৃতজ্ঞ দিদি। ভালো লাগলো…

      ভালো থাকুন সবসম।  শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif 

      GD Star Rating
      loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ২২-০৩-২০১৯ | ১২:৫৩ |

    জীবনে কত কথাই না বলা হয়ে ওঠেনা। অসাধারণ কবিতা মহ. আল মামুন ভাই। 

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৯-০৪-২০১৯ | ২২:৩৬ |

      দীর্ঘ কবিতার সাথে থেকে আপনার সুন্দর অনুভূতিরেখে যাবার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় দাদা। অনেক অনেক ভালো থাকুন সবসম।  শুভেচ্ছা… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif  

      GD Star Rating
      loading...
  4. সুমন আহমেদ : ২২-০৩-২০১৯ | ১৪:০৩ |

    মিথিলা বাবু!
    আজ তোমায় একটা গল্প বলি শোনো
    তোমার বাবার গল্প এটা
    বাবাতে মিশে থাকা তোমার মাটি, জল, হাওয়া, রোদ
    এ সব মিলিয়েই আজ আজকের তুমি জেনো।

    মুগ্ধ হলাম মামুন ভাই।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৯-০৪-২০১৯ | ২২:৩৮ |

      আপনার মুগ্ধতা আমার লেখায় প্রেরণাহলো জানবেন প্রিয় ভাই। ভালো থাকুন সবসম।  শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif  

      GD Star Rating
      loading...
  5. রুকশানা হক : ২২-০৩-২০১৯ | ১৯:১৬ |

    এ কোন গল্প নয়, নয় কোন কবিতাও।  এ শুধুই জীবন, যে জীবন মধ্যবিত্ত নাম ধারণ করে  ছোট ছোট মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকা ।

    চমৎকার প্রকাশ । শুভকাম।        

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৯-০৪-২০১৯ | ২২:৩৯ |

      অসাধারণ বললেন প্রিয় কবি! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন, সুস্থ এবং নিরাপদে থাকুন সবাইকে নিয়ে। শুভেচ্ছা… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...