[অণুগল্প লিখতে লিখতে এখন আর টানা পড়ে যাবার মত বড় গল্প লিখতে পারিনা। আর না পারতে পারতে লেখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছি। নিচের গল্পটি অনেক আগের লেখা আমার। আবারও শেয়ার করলাম। ]
১.
পাহাড়ের (আসলে মাটির টিলা) যেখানটিতে আমি বসে আছি, তার চারিদিকে হাজারো অচেনা শব্দ এক সাথে ভেসে আসছে। কিন্তু তারপরও এক অভাবনীয় নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে। ঘরে ফেরা পাখীদের ডাক, বুনো প্রান্তরের লুক্কায়িত কীট-পতঙ্গের আওয়াজ-এ সবকিছুকে ছাপিয়ে সমুদ্রের গর্জন আর সামুদ্রিক বাতাস ঝাউবনের ভিতর দিয়ে যাবার শো শো শব্দ… আমার চেতনাকে ফ্রেমে বন্দী করে রেখেছে।
হীমছড়ির এই টিলাগুলি, আদিগন্ত বিস্তৃত ঐ সমুদ্র এবং ওর বেলাভূমি- এসবের সাথে আমার সেই ছেলেবেলা থেকে গভীর সম্পর্ক। এখানেই আমার জন্ম এবং স্কুল জীবনটা এখানেই কাটিয়েছি। কলেজ ও ভার্সিটির সময়টা চাটগাঁতে।
ওর গ্রামের বাড়ীও এই কাছে।
তবে ভার্সিটিতেই ওর সাথে পরিচয়। পরিচয় থেকে জানাশোনা, বন্ধুত্ব এবং… এবং প্রেম? আসলে একে প্রেম বলা যায় কিনা তাতে সন্দেহ আছে। ওকে বোঝাটাই খুব ‘টাফ’। ভীষণ ‘মুডি’ মেয়ে। চির-চঞ্চলা হরিনী যেন! মনের গতিবিধি মুহূর্তেই পরিবর্তন হয়। আগাম পুর্বাভাষ দেবার কোনো নিয়ম নেই।
এমন এক ‘ও’কে ভালবাসলাম।
নাম নাইবা জানালাম।
বললেও কি তোমরা চিনবে?
দু’বছর ধরে ওর সাথে ছায়ায়-কায়ায় মিলে মিশে আছি।
এখনো পর্যন্ত শুধু ওর ডান হাত ধরতে পেরেছি। তাও কয়েক মুহুর্তের জন্য। যখনই হাতে হাত রেখে কিছু আবেগী মুহুর্তকে স্মৃতির মণিকোঠায় ঠাই দেবার ইচ্ছে পোষণ করেছি, কোনো না কোনো এক অনিচ্ছাকৃত পূর্ব ভুলের ফিরিস্তি অতীতের রথে করে সে নিয়ে এসেছে। আর তারপর আমার হাতকে ‘ডিটেনশনে’ পাঠানো হয়েছে কিছুদিনের জন্য।
এরকম একজনকে নিয়ে আমার স্বপ্নের জাল বোনা হয়তো সেই কবেই বন্ধ হয়ে যেত। যদি না… যদি না নিজের ‘অপারগ দিল’ একটু বেশীই ওর জন্য কেমন দুর্বল হয়ে পড়ত। আর আমার সাথে ঝগড়ার সময়ে তীব্র উত্তেজনায় ওর নাকের নীচের বিন্দু বিন্দু জলকনা যা আলোকরশ্মির প্রতিফলনে আমার হার্টবীটকে আরো দ্রুততর করে দেয়। সামান্য চাহনি-ভ্রুকুটি অথবা রাগে চীৎকার করে আমাকে গালিগালাজের সাথে চিতার হিংস্রতায় নখের বিদীর্নকরণ… এসব কিছু মিলিয়েই আমি ওর জন্য পাগল!
ও যা করে আমি তাতেই মুগ্ধ হই!
কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ওর মনের মুগ্ধতার দৃষ্টির ত্রি-সীমানায় নিজেকে কখনো দাঁড় করাতে পারি নাই! আসলে ওর ভালবাসার যোগ্যতার মাপকাঠিতে হয়তো আমি ফেল করেছি।
হয়ত কেন, অবশ্যই করেছি।
ফ্লাক্স থেকে এক ঢোক চা খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ আগে কোকের বোতলে লুকিয়ে থাকা রেন পুল্যাক কোম্পানির কফ সিরাপ অনেকটা খেয়েছি। পরে কয়েক কাপ দুধ চা আর সিগ্রেটে ভরা গাঁজা টানাতে সারা শরীরে চিনচিনে এক অসম ভাললাগার অনুভুতি! এজন্যই মনে হয়েছিল চেতনা ফ্রেমে বন্দী হয়ে আছে যেন।
গাঁজা সেবনের কথা এরকম খোলাখুলি বললাম বলে কি আমাকে খারাপ ভাবছ? এই জিনিসগুলি দেশে ঢুকছে কিভাবে? না পেলে তো আমি সেবন করতাম না। বলতে পারো- ‘তুমি না খেলেই তো এ জিনিস দেশে এলেও লাভ নেই।‘ হ্যা, তবে এগুলোকে প্রতিরোধ করার দায়িত্ব যাদেরকে দেয়া হয়েছে, আগে তাদের কাজ। আমারটা পরে। আর এর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার জন্য দেখছ না, কেমন লোকালয় ছেড়ে এই এতো দূর নির্জন পাহাড়ের উপর বসে আছি। আইনকে সম্মান জানাচ্ছি। আইন… হাহ!
বেলাভূমিতে কয়েকজন উচ্ছল তরুন-তরুনী মন্থর হেঁটে হেঁটে জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব মিলাচ্ছে। অথচ আমি নিজে এই টিলার উপরে একজন ‘সলিটারি লাভার’ হয়ে ত্রি-ফলা নেশায় বুঁদ হয়ে রয়েছি। বুকের ভিতরের জমাট বাঁধা কিছু আক্ষেপকে উড়িয়ে নিয়ে দূর সমুদ্রে ফেলে দিয়ে এলো সামুদ্রিক বাতাস। তবে ফিরতি পথে নিয়ে এলো আরো অনেক বেশী তরল কষ্টকে… যা শিরায় শিরায় রক্তের নাচনকে উদ্বেলিত করবে মুহুর্মুহু!
২.
হিটলারের নাৎসি সেনাদের মতো লাইন ধরে মার্চ করে চলেছে লাল কাঁকড়ার দল। সবার পিছনে সাদা শার্ট ও ব্লু জীনস পড়ে ওদের পিছু পিছু আরো একজন মুগ্ধ হয়ে অনুসরণ করছে। ছোট ছোট লাল রঙের এই কীটগুলো পুরো সমুদ্র সৈকতকে একেবারে লাল করে রেখেছে। সাদা ফেনার নীল সমুদ্রের পাড়ে চিকচিকে বালির উপরে চলন্ত লালের এই কম্বিনেশন!
‘ওয়াও’!
পড়ন্ত বিকেলের মোলায়েম রোদ বাতাসের ছোঁয়ায় আরো তাপ হারিয়ে শরীর-মন দুইকেই প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। মেয়েটি কাঁকড়াগুলোকে অনুসরণ করে অনেক দূরে চলে এসেছে। ওর মটর বাইকটি রাস্তার পাশে যেখানে রেখে এসেছে, সেটা এখান থেকে প্রায় চার পাঁচশ’ গজ তো হবেই। এই মেয়েটিই পাহাড়ের উপরে একা বসে থাকা সেই ‘সলিটারি লাভার’ বয় এর ‘লাভার গার্ল’।
সে এতটা সুন্দর… মোহনীয় এবং নরম যে সকলের পরম আরাধ্য! ওর উপরের ঠোঁটের সামান্য ওপরে একটি তিল… এই ‘বিউটি স্পটটি’ তাঁর চেহারাকে আরো আকর্ষনীয় করেছে। অন্যরা যখন তাঁকে দেখে, চোখ-ঠোঁট হয়ে তাঁদের দৃষ্টি ঐ তিলের উপরে নিবিষ্ট হয়। আর কেন জানি তাঁদের হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠে ওখানে কামড়ে দেবার দুষ্ট ইচ্ছেটা জেগে উঠে। যদি কোনোভাবে এই ‘লাভার গার্ল’ ওদের মনের খবর জানত। তবে একেবারে খবর করে ছেড়ে দিত। এমনই বেপরোয়া মেয়ে সে।
টেকনাফে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কাজ করছে এমন একটি বেসরকারী সংস্থায় জব করে। নিজেই মটর বাইক ড্রাইভ করে প্রতিদিন যাওয়া আসা করে। কক্সবাজারের মেয়ে সে। এই সাগর পাড়ের আলো-বাতাস ঝড়-ঝঞ্ঝা এবং সকল প্রতিকূলতার ভিতর দিয়েই বড় হয়েছে। শখের বশে হলেও আন-আর্মড কম্ব্যাটে ব্ল্যাক বেল্টধারী। কালো দীঘল কোঁকড়ানো চুল আর কমনীয় মুখশ্রী বাদে আর সব কিছুই কেমন যেন রুক্ষতায় ভরা। ওকে এই মুহুর্তে দেখলে মনে হবে, সাদা আর নীলে আবৃতা এক কালোকেশী। লাল কাঁকড়ার পিছু ধেয়ে ধেয়ে অস্তগামী সুর্যের রক্তিম আভা হৃদয়ে ধারণে ব্যতিব্যস্ত এক সাগরকন্যা! যে কিনা আপাদমস্তক রুক্ষতার খোলসে নিজেকে ঢেকে রাখে… তবে খুব সুন্দর এবং সাগরসম ভালোবাসা নিয়ে এই খোলসের ভিতরেই একটি চমৎকার হৃদয় লুকিয়ে আছে যা কেউ জানতে পারে না।
রুক্ষ হৃদয়ের ভিতরে অন্য এক কোমল হৃদয়!
হৃদয় মাঝে আর এক হৃদয়!
সে জানতে দিতে ও চায় না কাউকে।
শুধুমাত্র একজনকে ছাড়া…
যে ঐ টিলাগুলোর যে কোনো একটির উপরে বসে নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। আর এই মুহুর্তে ঠিক ওকে নিয়েই ভাবছে। ভাবছে… চিন্তার জাল বুনছে। কিন্তু ওটা ঐ চিন্তার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তার সামনে এলেই সে কেমন করে যেন বোবা প্রাণীতে পরিণত হয়। ইচ্ছে আছে কিন্তু সাহসে কুলায় না।
ফিরিতি পথ ধরে বাইকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ধীরে ধীরে ওর আর স্লথ গতিবেগের সেই লাল বাহিনীর মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। ভাবে, সেও কি ‘লাভার বয়’ এর সাথে একটু বেশীই রুক্ষ ব্যবহার করছে না? ওদের মাঝের এই দেয়াল তো তাঁর নিজেরই তৈরী করা? সে কেন ‘ও’কে নিজের বেশী কাছে আসতে দিতে চায় না।
পরক্ষনেই চোয়াল দৃঢ় হয়।
না, ‘লাভার বয়’ ললিপপ টাইপের হোক তা সে চায় না। ওকে একজন সত্যিকারের পুরুষে রূপ দেবার জন্যই তো ওর এই খোলস ধারণ করা। না হলে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে কোনো এক বৃষ্টির রাতে, বিছানায় জড় পদার্থের মত পড়ে থেকে ওর ও তো মন চায় ‘সে’ আসুক। এসে শুধু ডান হাত নয়, শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে ভালবাসার আগুন জ্বালিয়ে যাক!
নিজেকে ‘লাভার বয়’ এর হাতে স্বেচ্ছায় সমর্পণ করতে এক ভীরু পাখির মত অসহায় হয়ে অপেক্ষা করে সে। হৃদয়ের ভিতরে ঝড় বয়ে যায়… প্রতিটি রোমকূপ তৃষ্ণায় জেগে উঠে… একসময় অতৃপ্তির মাঝে লীন হতে হতে আবার সেগুলো নিস্তেজ হয়। এভাবেই রাত ভোর হয়… দিন থেকে সন্ধ্যা… রাত… আবার ভোর।
জীবন কেটে যায় পা পা করে।
বলাকারা ফিরে যাচ্ছে… বেলাশেষে ভানু ও নিজেকে অস্তগামী করাতে ব্যস্ত। এরই মাঝে রহস্যময় এক রাত নামবে। গৃবা উঁচু করে হেঁটে যাওয়া এক এলোকেশীর জীবনে সেটা নতুন কোনো কিছু এনে দিবে কি?
পাহাড়ের উপরে বসেই ‘লাভার বয়’ তাঁর ‘ও’কে বাইক চালিয়ে চলে যেতে দেখে। সামুদ্রিক বাতাসের উপরে তাঁর প্রচন্ড হিংসে হয় এই মুহুর্তে। ‘ও’র চুলগুলোকে নিয়ে ইচ্ছেমত খেলা করছে বাতাস! যা সে অনেক চেয়েও একটু ছুঁয়ে দেখতে পারেনি! মোবাইল হাতে নিয়ে ‘ও’র নাম্বারটি বের করে।
কিন্তু কল করা হয়না…
হয় না মনের না বলা কথাগুলো তাঁকে বলা।
যদিও প্রকৃতি আজ তাঁদের দুজনের জন্য সব আয়োজনই করে রেখেছিল!!
৩.
লাবনি পয়েন্টের সাথেই হোটেল কল্লোল। এর রিসেপশন থেকে বের হয়ে এলাম।
ছুটির দিনের এক অলস বিকেল।
‘ও’ ফোন করেছে। দেখা করতে যাচ্ছি। সাধারণত এমনটি কদাচিৎ হয়। আমার প্রয়োজনে আমিই ওকে ডাকি। ও ধরা দেয় না। দূরে দূরে থাকে। আজ নিজে যেচে আমাকে ডাকল!
‘তোমায় আমি ডেকেছিলেম ছুটির নিমন্ত্রণে’!!
ওর নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করা আমার পক্ষে কি সম্ভব?
চারিদিকে মোটামুটি ভীড়। এখন ‘সিজন’ না হলেও কক্সবাজার সারা বছরই ইদানিং জমজমাট থাকে। ফুচকার দোকানটি পার হয়ে যাবার সময় ছোট একটি পরিবার চোখে পড়ল। স্বামী- স্ত্রী এবং দু’টি বাচ্চা। বাচ্চা দুটি ‘ফ্রিসবি’ নিয়ে বালির উপরে দুরন্তপনায় ব্যস্ত। আর মা বাবা দুজন চোখে সীমাহীন মায়া নিয়ে তাই দেখছে। হৃদয়ের ভালোবাসা ওদের দৃষ্টি থেকে উপচে পড়ছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
আমার বুকের ভিতর একটু বেদনা জেগে উঠল।
এই বেদনার উৎস কি? বোঝার চেষ্টায় হাঁটতে হাঁটতে কখন যে মানুষের ভীড় ছাড়িয়ে চলে এলাম বুঝতে পারিনি। সমুদ্রের গর্জন এবং ঢেউ এর তীরে এসে ভেঙ্গে পড়া আর ভালবাসার নোনা স্বাদের বাতাস, আমাকে নেশাবিহীন অবস্থায়ই এক ঘোরের ভিতর নিয়ে গেলো।
আমার ফেভারিট কালারের শাড়ী পরা কেউ একজন তট রেখা ধরে একাকী হেঁটে চলেছে। এখনো অনেকটা দূরে। তাই দূর থেকে শুধু আকাশী রং দেখতে পাচ্ছি… এক নারী নীলাকাশের নীচে নীলাম্বরী হয়ে নীল জলের পটভুমিতে আঁকা ছবির মতো চোখে ধরা দিলো।
শুধু শুধু মন খারাপ হল। আজকাল কঠিন সৌন্দর্য আমাকে বেদনাক্রান্ত করে তোলে। ঐ নারী যদি আমার “ও’ হতো! এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এরকম ড্রেসে সে কখনোই এই পাবলিক প্লেসে আসবে না। ওর চিরাচরিত সেই নীল জিন্স ও সাদা শার্ট এর বাইরে সে যাবে না।
একটা নাম না জানা পাখীর কর্কশ চীৎকারে বাস্তবে ফিরে এলাম।
এবং মেয়েটিকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম… আরো একটু কাছে আসতেই বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ‘ও’কে আবিষ্কার করলাম। সেই তিল… চেনা প্রিয় মুখ… যা আমাকে রাতের পর রাত জাগিয়ে রেখেছে!… দিনের অসহ্য ঘন্টাগুলোতে বেদনাকে জাগিয়ে তুলেছে! হাসিমুখে এগিয়ে আসা আমার প্রিয়তমা কি এক রহস্য মদিরতায় ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠার অপেক্ষায়।
আমার বিস্ময়টুকু সে বেশ উপভোগ করল। নীরবে… কথা না বলে ঝাউ গাছগুলোর একটু সামনে বালিয়াড়ির মতো দেখে সেখানে বসলাম। দুজনে… পাশাপাশি। এরকম রোমান্টিক পরিবেশে মনে হল ‘ও’কে নিয়ে এই প্রথম। আগেও ওকে নিয়ে এখানে অনেক হেঁটেছি। কিন্তু সেই ‘ও’ আর আজকের ‘ও’র মাঝে অনেক ব্যবধান মনে হচ্ছে।
চুপচাপ অনেকক্ষণ কাটালাম। সমদ্রের ঢেউ এবং দূরে যতদূর চোখ যায় আমরা অর্থহীন দেখার চেষ্টায় সময়ক্ষেপন করলাম। মাঝে মাঝে কয়েকবার চোরা দৃষ্টিতে ওকে দেখছিলাম। সে ও মনে হয় এটা অনুভব করল। বাতাসে আমার এবং ওর চুলগুলো নিয়ন্ত্রণহীন উড়ছিল। কয়েকবার ওর অবাধ্য চুল আমার মুখের উপর হাল্কাভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলো। ও কখনো পারফিউম ইউজ করেনা। ও নিজেই তো এক তাজা পারফিউম! আমার মন-প্রাণকে সতেজ করে দেয়া ভালবাসার আবেশ এনে দেয়া সুগন্ধি এক নারী! হ্যা আজ ওকে বড্ড বেশী নারী মনে হচ্ছে। এটাকি ওর ‘গেটআপ’ পরিবর্তন করাতে? না এর ভিতরে আরো গভীর কিছু একটা রয়ে গেছে।
– এভাবে চোরের মতো দেখছ কেন?
ওর কথায় নীলজলরাশির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালাম। কিন্তু কয়েক পলক তাকিয়েই ওর ধারালো সৌন্দর্য সহ্য করতে না পেরে দৃষ্টি আপনা থেকে নত হয়ে এলো। আসলে ও কি বলেছে আমার কানে তা কিছুই যায়নি। আমি শুধু কিছু শব্দ শুনলাম। তাই আবারও আমাকে ওর বলতে হল,
– এদিকে তাকাও, চোরের মত আমাকে দেখছিলে কেন?
: চোর না হয়ে উপায় আছে? তুমি কি কখনো ভালভাবে দেখতে দাও?
আমার এই কথায় কিছুটা অবাক হল সে, ওর চোখে বেদনা ও কি জেগে উঠল একপলকের জন্য? বসা থেকে সোজা উঠে দাঁড়ালো সে। আমি একটু ভয় পেলাম। এখন কি জানি কি করে বসে। ওর আকাশী শাড়ী ওকে সম্পুর্ণ ঢেকে দিতে পারেনি। পাতলা শাড়ী ওর সুন্দর নাভীকে একটা পর্দার আড়াল থেকে দেখার মত করে আমার চোখকে দেখালো। আমি মুগ্ধতার গলা টিপে ধরে উঠে দাঁড়ালাম। ওর সাদা ব্লাউজের নীচে থাকা হৃদয় মনে হয় দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছিল। বুকের উঠানামা দেখেই আমি টের পেলাম। আমার নিজেরও কি তা হচ্ছিল না! আমার চোখে ওর পুর্ণ দৃষ্টি মেলে বলল,
– আমি বিড়াল প্রেমিক পছন্দ করি না। আমার সামনে কেউ সারাজীবন মিউ মিউ করুক সেটাও চাইনা।
: বুঝলাম না?
– ভালোবাস আমাকে?
একটা ঢোক গিলে বললাম,
: হ্যা!
– আমাকে ছুঁতে চাও? আদর করতে চাও?
কি বলব আমি? আমি তো সেটাই চাই… তবে এভাবে না। মানে ও আমাকে এই কথাটা এভাবে সরাসরি বলবে তা ভাবিনি কখনো। ভালবাসার একটা পর্যায়ে শরীর কেন চলে আসে? তবে কি আমার ভালোবাসা শুধুই শরীরকেন্দ্রিক? হঠাৎ একটা তীব্র না পাওয়ার বেদনা কোথা থেকে এসে আমাকে টলিয়ে দিয়ে যেতে চাইলো। আমি এক মুহুর্তের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। আমি কে, কোথায় আছি তা বিস্মৃত হলাম। আমার নীরবতাকে সে আমার দুর্বলতা ভেবে বসল। কাঁধের উপর থেকে শাড়ির আঁচল ফেলে দিলো। আমার অবাক চোখের সামনে আমার হাতটি ধরে ওর বুকের ওপর ধরে রেখে বললো,
-নাও, যা ইচ্ছে তাই করো।
আমি একটা বিস্ফোরনোম্মুখ আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হলাম। মুহুর্তের ভিতরে মনে হল ফেটে চৌচির হয়ে যাব। একটা অপার্থিব অনুভুতি আমাকে তীব্রভাবে ঊত্তপ্ত করে… আমি আমার ভিতরে নতুন এক ‘আমার’ উপস্থিতি টের পাই। আশ্চর্যজনক ভাবে আমি ক্রমে শীতল হই… আমার ভিতরের জড়তা,নমনীয়তা ঝেড়ে ফেলে আমি বিড়াল থেকে চিতায় পরিণত হলাম। ওর শরীরের নরম ও কোমল আগুন আমাকে পোড়াতে পারেনা। আমার মনের ভিতরে কোনো সাপ জাগে না। আমি হাত সরিয়ে নেই আলতো করে।
দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকি।
সময় স্থির… সবকিছু নীরব! ভালবাসার স্বরূপ উদঘাটনে ব্যস্ত দুই হৃদয় হঠাৎ করে নিজেদেরকে ফিরে পায়। ওর ঠোঁটের তিল আমাকে আকর্ষণ করে। আমি দুহাতে ওর মুখ ধরে নিজের কাছে টানি… ও চোখ বন্ধ করে অতৃপ্ত ঠোঁট একটু মেলে ধরে। কিন্তু আমি ওর কপালে হাল্কা করে চুমো দেই। ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়।
একটু হাসে।
আমি ওর কোমর ধরে পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। নিজেকে খুব নির্ভার মনে হয়। ও যখন ওর বুকে আমার হাত তুলে নিয়ে গেলো, আমি ঠিক সেই সময়েই নিজের ভিতর থেকে নিজকে উত্তরণে ব্যস্ত ছিলাম। আমার সুনীলের সেই কবিতাটির ঐ লাইনগুলো মনে পড়ছিল,
… বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে
বরুনা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!…
আজ আমি আমার বরুনার বুকে মাংসের গন্ধের পরিবর্তে সেই আতরের গন্ধই পেয়েছি! আজ সে কোনো নারী না হয়ে আমার ‘ও’ হয়েই আমার কাছে ধরা দিয়েছে। সত্যিকারের শরীরহীন ভালবাসার জন্যই এটা সম্ভব হলো। জীবনটা ছেলেখেলা নয়। দুটো হাত এক হবার আগে সারাজীবন হাতে হাত রেখে চলার মতো ভালোবাসা অর্জন করে নিতে হয়। অনাগত দিনগুলোর জন্য একে অপরের প্রতি আত্মবিশ্বাস- দুজনের পারষ্পরিক বোঝাপড়া আগেই বুঝে নিয়ে তবেই পথ চলার শুরুটা করা ভালো।
এই গল্প আমার আর ‘ও’র। আমাদের সবার।
আমরা যারা সংসার নামের এই রঙ্গমঞ্চে ‘আমি’ এবং ‘তুমি’র ভুমিকায় অভিনয় করছি তাঁদের সবার।
শেষ বিকেলের আলোয় বেলাভুমিতে দুটো ছায়া হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অনেক দীর্ঘ সেই ছায়া! একটু আগে ভালবাসা নামের অদৃশ্য এক শক্তি ওদেরকে অনেক কাছে এনে দিয়েছে। এতোটা কাছে মনে হয়না কখনো আর ওরা দূরে চলে যেতে পারবে। লাল কাঁকড়াদের ফেলে আসা ট্রেইল ধরে ওরা দুজন জীবনকে রাঙানোর জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রঙিন এই ভূবনে টিকে থাকতে অনেক রঙের প্রয়োজন।
আচ্ছা ভালবাসার রং কি?
#মামুনের_গল্প_ভালোবাসা_বর্ণহীন।
loading...
loading...
সুন্দর বলেছেন মহ. আল মামুন ভাই। ভালোবাসা বর্ণহীন। দীর্ঘ লিখাটি পড়তে মোটেও ক্লান্তি আসেনি। দারুণ আপনার মেধা।
loading...
ক্লান্তিহীন আপনার মূল্যবান সময় নিয়ে লেখাটি পড়েছেন, অনেক ভালো লাগলো আমার ৷ ভালো থাকুন প্রিয় কবি দাদা। শুভেচ্ছা…

loading...
এক আধটু পুরোনো লেখা হলেও ক্ষতি বৃদ্ধি হয়নি গল্প দা। অনেক ভাল হয়েছে লেখাটি। ক্লান্তি পেলে চলবে না, লেখা জারি রাখুন। পাঠক হিসেবে পাশে পাবেন।
loading...
ধন্যবাদ দিদি। আপনার মতো একজন সব্যসাচী লেখক আমার লেখা পড়ছেন, এটা আমার জন্য গর্বের ব্যাপার। ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা..
জি, ক্লান্তিহীন লিখে যাবার আশা রাখি। ভালো থাকবেন সবসময়।
loading...
এই গল্প আমার আর ‘ও’র। আমাদের সবার।
আমরা যারা সংসার নামের এই রঙ্গমঞ্চে ‘আমি’ এবং ‘তুমি’র ভুমিকায় অভিনয় করছি তাঁদের সবার।
অনেকের মতো আমি কখনই কোন লিখা সহজে শেষ করতে পারি না। লম্বা লিখা তো নয়ই। বড় লিখা পেলে শুয়ে শুয়ে পড়তে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আর সমস্যাটি এখানেই; শুয়ে তো পড়তে পারবো না। যাইহোক অবশেষে লিখাটি পড়লাম।
হ্যাঁ, আমারও একই প্রশ্ন মি. মামুন … আচ্ছা ভালবাসার রং কি? নীল লাল সবুজ ?
loading...
জি ভাইয়া, এই গল্প 'আমাদের'।
ভালোবাসার রঙ খুঁজে চলেছি, পাইনি এখনো। ধন্যবাদ।

loading...
বাহ
খুব সুন্দর হয়েছে।
loading...
ধন্যবাদ দাদা। শুভেচ্ছা…
loading...