মামুনের জোড়া অণুগল্প

‘এতোদিনে বুঝিলেন মহাশয়
মাসে মাসে বেতন কেন হয়,
চাকুরির মধ্য আছেন বলে
এ ছাড়া অন্য কিছু নয়।’

– অনেক আগে দেখা একটা নাটকের শেষে এই গানটি ছিল। একদিন একজন অফিসের বসের মনে হল, ‘তিনি বেতন কেন পান? কি এমন কাজ করেন তিনি যে তাকে বেতন দিতে হবে?’ এই চিন্তায় এই বস ভদ্রলোক অস্থির হয়ে গেলেন। সাব-অর্ডিনেটদেরকে জিজ্ঞেস করেন,
: আমি বেতন কেন পাই?
: স্যার, আপনি আমাদেরকে নির্দেশ দেন বিভিন্ন কাজের জন্য, তাই পান।
: তোমাদের আমি কি নির্দেশ দেই?
: নির্দেশ তো আগেই দেয়া আছে স্যার, আমরা সেটাই পালন করি।

-এই উত্তরটা ও বসের মনঃপুত হল না। নির্দেশ যদি আগেই দেয়া হয়ে থাকে তবে তার আর প্রয়োজন কিসের। বাসায় এসে বউ-ছেলেমেয়েকেও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। তাঁরা বলেন যে, তার সংসারে বউ-ছেলেমেয়েরা আছে , তাদেরকে পালতে হবে বিধায় তিনি বেতন পান। এটাও পছন্দ হয় না তাঁর।

পরবর্তীতে তিনি ধরে ধরে সবাইকে এই একই প্রশ্ন করেন। এক পর্যায়ে তার বউ তাকে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিয়ে যান। সেখানে সাইক্রিয়াটিস্ট তাকে জিজ্ঞেস করেন,
: আপনাকে চাকুরী দেবার সময় কি এপয়েন্টমেন্ট লেটার দেয়া হয়েছিল?
: হ্যা, হয়েছিল।
: আপনি কি রিটায়ারমেন্টের কোনো নির্দেশ সম্বলিত কাগজপত্র পেয়েছেন?
: জী না, পাই নাই।
: তাহলে তো আপনাকে বেতন নিতেই হবে। ওটা (রিটায়ারমেন্টের) না পাওয়ার জন্যই আপনাকে বেতন দেয়া হয়।

এবার বস ভদ্রলোক খুব সহজেই বুঝতে পারলেন।

আমাদের দেশেও উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা, মন্ত্রী, এমপি এদের ভিতরও হয়তো ঠিক এই বোধ কাজ করে। কিন্তু তাদের ভিতর ঐ বস ভদ্র লোকের মতো অস্থিরতা নেই বিধায় কোনো লজ্জাও নেই। এইজন্যই তাঁরা নির্লজ্জ ভাবে জনগনের টাকায় প্রতিপালিত হয়। আর একতরফা শুধু নেবারই প্র্যাকটিস করেন তারা। আর এই জন্যই নির্বাচন এলে আমাদের দুয়ারে জোড়হাত করে ভিক্ষুকের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। বাকি সময়গুলিতে জনগনের জন্য কিছু করেছেন কিনা, সেটা বেমালুম ভুলে থাকেন!

এক একজন বেহায়া, নির্লজ্জ এবং অকৃতজ্ঞ ভিক্ষুক!

#বেতন_কেনো_পাই_অণুগল্প_৪৭৬

****
কামিনী রায় এর একটা কবিতা পড়েছিলাম অনেক আগে-
‘… করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে
পাছে লোকে কিছু বলে…।’

আর একটা গল্প শুনেছিলাম…

এক বাবা ও ছেলে তাদের গাধাটা বাজারে বিক্রী করতে নিয়ে গেল। পথে বাবা গাধার পিঠে চড়েন আর ছেলে পায়ে হেঁটে যায়, এ দৃশ্য দেখে পথচারী ক’জনের উক্তি,
: দেখ, কেমন বাপ! নিজে আরামে যাচ্ছে, আর ছেলেটাকে এই রোদ্দুরে হাঁটায়ে নিয়ে যাচ্ছে।

একথা শুনে ছেলেকে গাধার পিঠে চড়ানো হল। বাবা এখন হাঁটছেন। কিছুদূর যাবার পরে আরো ক’জনের উক্তি,
: এ কোন যুগরে বাবা! নিজে গাধায় চড়ে বৃদ্ধ বাবাকে হাঁটায়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমন কুলাঙ্গার ছেলে তো আর দেখি নাই!

এই কথা শুনে আবার বাপ-বেটা দু’জনেই এবার গাধার পিঠে চড়লেন। পথে এবার কিছু পশুপ্রেমিকদের মন্তব্য,
: দেশ থেকে মায়া-মমতা সব উঠেই গেল মনে হচ্ছে। এই অবলা পশুটি কথা বলতে পারে না বলে কি এভাবে অত্যাচার করতে হবে?

এবার দু’জনে দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা নাড়লেন। এরপরের দৃশ্য…
একটা গাধাকে বাঁশের সাথে চার পা বেঁধে বাপ-বেটা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে অনেক মানুষ খুব মজা পেল। কেউ কেউ আনন্দে হাততালি দিতে দিতে ওদের পিছু নিলো। মোটকথা কিছু একটা করার তাঁরা পেয়ে গেছে দেখে খুব ভাল লাগছিল সবার। এমন সময় একটা বাঁশের সাঁকো সামনে এলো। পার হতে গিয়ে মজা দেখতে আসা লোকজনের চিৎকারে গাধাটা ভয় পেয়ে চারপা’র বাঁধন খুলে ফেলার চেষ্টা করল এবং বাপ-বেটার কাঁধ থেকে নীচে খালে পড়ে গেলো। অনেক পানি থাকায় আর পা বাঁধা থাকায় গাধাটির জলে ডুবে মৃত্যু হল। তখন কিছু লোক এসে সেই বাপ-বেটা দু’জনকে বলল,
:এমন গাধামি কি কেউ করে? গাধাকে কাঁধে করে নিয়ে আসার দরকারটা কি?

একবার আমার বাবরি চুল রাখার পরে অফিসে আমার সামনে এবং আড়ালে অনেকে এই চুল নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছে। কেন ভান্ডারীদের মত চুল রেখেছি… বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে ইত্যাদি ইত্যাদি কথা শুনে শেষে এক রাতে চুল একেবারে ছোট করে ফেললাম। পরেরদিন অফিসে আসার পরে ক’জন আমাকে দেখে বলল,
: এইটা একটা কাজ করলেন? কি সুন্দর লাগতো আপনাকে বাবরি চুলে!

আমি কি উত্তর দিবো কিংবা রাগ করা উচিত হবে কিনা সেটা ভাবতে লাগলাম।

ঠিক এভাবেই আমাদের দেশে যে কোনো ভাল কাজ করতে গিয়ে, জনে জনে প্রদত্ত মতামতের প্রভাবে, সেই ভালো কাজগুলিও শেষ পর্যন্ত পানিতে পড়ে সলিল সমাধি লাভ করে। আর উদ্যোক্তাকে সেই সমাধির পাশে বসে গাধাটির মালিকের মতো করুন নয়নে গাইতে হয়-
“তোমার সমাধি
ফুলে ফুলে ঢাকা…।।”

#পাছে_লোকে_কিছু_বলে_অণুগল্প_৪৭৭

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৩-১২-২০১৮ | ৯:৫৩ |

    চেনা দুটো লিখা থেকেই আমাদের নিজস্ব কিছু শিক্ষা নেবার মতো উপকরণ রয়েছে। ধন্যবাদ প্রিয় লিখক মি. মামুন।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৩-১২-২০১৮ | ১৭:৩২ |

      স্বাগত ভাইয়া আপনাকে। শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

       

      GD Star Rating
      loading...
  2. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০৩-১২-২০১৮ | ১১:২১ |

    খুব ভালো হয়েছে গল্পজোড়া মহ. আল মামুন ভাই। শুভ সকাল। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৩-১২-২০১৮ | ১৭:৩৩ |

      গল্প দুইটি পড়ে আপনার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য ধন্যবাদ কবিদা'

      শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. রিয়া রিয়া : ০৩-১২-২০১৮ | ১৮:৩৮ |

    গল্পের প্রয়াস ভালো হয়েছে গল্প দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৩-১২-২০১৮ | ১৯:১৪ |

      ধন্যনাদ দিদি আপনাকে। ভালো থাকুন সবসময়।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...