জীবন এমনই: অণুগল্প

নিজের জীবনের আঠাশ বছরে পা দিতে আর সপ্তাখানেক বাকী রোমেলের। পঁচিশ বসন্তে চাকুরিতে ঢুকেছিলো। তখন সে আর রাবু। রাবেয়া রাবু নাম ধারণ করেছিলো ওদের বিয়ের পরেই। রোমেল এর সিংহভাগ কৃতিত্ব দাবী করতেই পারে। অন্যরা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়েছে।
.
এই তিন বছরে দুই থেকে তিনে পৌঁছেছে ওরা। পিম্পি ওদের মাঝের সেতু হয়েছে। মা-বাবা আর দুই বোন অন্য শহরে। জীবন একরকম কেটেই যাচ্ছিলো ওদের। অম্ল-মধুর আছে-নাই এমন এক সর্পিল পথে চলছিলো জীবন।
.
এমন সময় হুট করে চাকরিটা চলে গেলো রোমেলের। সেদিন বাসায় ফিরে রাবুকে নিয়ে দীর্ঘসময় চুপচাপ কাটিয়েছিলো। অনিশ্চিত ভবিষ্যত কি একধরণের চাপে রেখেছিলো? চাপ তো সবসময়েই ছিলো। তবে নির্বাক হয়ে যাবার মতো.. হোক না সামান্য সময়ের জন্য.. ছিলো কি?
.
সময় পার হয়। চাকরি পায় না। একদিন একমাত্র সঞ্চয় ডিপিএসটি ম্যাচিউরড হবার আগেই ভাংগাতে ব্যাংকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রোমেল। গত তিন বছর ধরে তিল তিল করে জমানো সঞ্চয়টুকু এই ইটপাথরের বিশাল অট্টালিকার পেটে পরম মমতায় রেখেছে সে। আজ সেই শিশুকে ‘প্রি-ম্যাচিউরড’ ভূমিষ্ঠ করাতেই হচ্ছে।
.
নিজের মনে ভাবনায় ছিলো। তাই ঘোরের ভিতর কখন কিউতে দাঁড়িয়েছে, কাউন্টার ম্যানের সাথে কথা বলেছে, তার মেশিন এবং হাতে টাকাগোনা দেখেছে! সবই না দেখার মতোন। টাকার বান্ডিল ওর দিকে বাড়িয়ে দিতেই নিয়েছে। পকেটে পুরেছে। এরপর বের হতে পিছু ফিরেছে।
.
সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দেবার আগে থেমে যায়। টাকাটা গুনে দেখা দরকার ছিলো। ব্যাংকের দরোজার সামনের সিঁড়ি লাগোয়া ডাম্পিং প্লেসে এসে দাঁড়ায়। বান্ডিলের টাকার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যায়। অবাক হয়। আবার গোনে।
.
তৃতীয়বার গোনা শেষ। বিচিত্র অনুভব একসাথে ঘিরে ধরে রোমেলকে। প্রায় আট হাজার টাকা বেশী দিয়েছে ক্যাশের দায়িত্বরত লোকটি!
.
ভিতরের শয়তান নিমেষে এসে হাজির হয়। সাথে নিয়ে আসে আরো কিছু পুরনো বন্ধুদের। লোভ, আকাঙ্ক্ষা, বিলাসী মনোভাব ওদের অন্যতম। শয়তান মিচকি হেসে বলে,
– সোজা হাটার উপর থাক। ডাইনে বায়ে কোথায়ও তাকাইস না। আট হাজার টাকা বাইঞ্চোত!! দ্রুত ভাগ..।
.
ভিতরের রোমেল বিব্রত হয়। ওর শুভবুদ্ধি ওর পা দু’টি আটকে রেখে নিরবে চেয়ে থাকে। লোভকে সামনে ঠেলে দিয়ে আকাঙ্ক্ষা বিদ্রুপ করে,
– দাঁড়িয়ে রইলি যে বড়? শীত আসছে। পিম্পির জন্য একটা লাল সোয়েটার.. সেই যে পছন্দ করেছিলো রাবু, ওটা নিতে হবে না?
.
একটু লোভী হয়ে উঠে রোমেল। ভিতরের নিজের অসহায় অবস্থা উপলব্ধি করে। ভাংগাচুরা চলে। চলে মানসিক টানাপড়েণ। শয়তান সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পুরোদমে। মুখে মধু ঢেলে সে জানায়,
– তোমার একটা ভালো পোশাক নাই। জুতো জোড়াও গোড়ালি আর তলিতে সেলাইয়ের ফোড় নিয়ে ধুকছে। একটা কেডস অবশ্যই তোমার দরকার। মিনিমাম হাজার দুই খসে যাবে এতে। আর চাকরি খুঁজছো তুমি। এই তল্পিমার্কা পোশাক নিয়ে চাকরি পাবে? এজন্যই তো হচ্ছে না তোমার কিছু? আগে দর্শণধারী, পরে গুণবিচারি- জানো তো হে?
.
একটু নড়ে চড়ে ওঠে পা দু’টি। সামনে বাড়াতে উদ্যত হয় মস্তিষ্কের এক অংশের নির্দেশে। কিন্তু অন্য অংশ নিস্ক্রিয় থাকে। শয়তান ভিতরের নফসকে টেনে বাইরে আনতে অন্য অস্ত্র বের করে,
– সামনে থার্টি ফাস্ট। গত বছর তুমি বড়াই করে জানিয়েছিলে, এবার সবাইকে এন্টারটেইন তুমি-ই করবে। আরে বলদ, এবার কেডস মেডস কিনেও দুইটা টাকিলা তো নিতেই পারবি। ভাব একবার?
.
ভাবতে থাকে ভিতরে বাইরে দুইয়ে মিলানো এক রোমেল। অনিশ্চিত অনাগত সময় সামনে আসে এক পলক। একে একে অনেক কিছু হাজির হয়। সেখানে বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাহিদা নিজেদের চেহারা দেখিয়ে যায় ওকে।
.
দ্বিতীয়বার কাউন্টারের কাছ থেকে ফিরে আসার সময় বড্ড নির্ভার দেখায় রোমেলকে। জীবনের পথের শুরুতে রয়েছে সে কেবল। সামনে বিস্তর পথ পাড়ি দেয়া বাকী। সেই পথ কখনো বন্ধুর। কখনো সরল। ষড় রিপুর প্রলোভন.. কষ্ট-ক্লেশ.. দুনিয়ার মায়া.. সম্পর্কগুলির ভিতরের টানাপড়েণ – এসব কিছু মিলিয়েই এই জীবনের পথ।
.
এক জীবনে যে কেউ একবারই এই পথে হাঁটার সুযোগ পায়। পরিশুদ্ধ হয়ে পথের শেষে পৌঁছায় ক’জন?
.
জীবনের পথের শুরুতে দাঁড়িয়ে নতুনভাবে শুরু করা একজন রোমেল স্মিত হাসে। বড্ড বিচিত্র মানব মন। বড্ড বিচিত্র!!

#জীবন_এমনই_অণুগল্প

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৫ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. রিয়া রিয়া : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৯:০৬ |

    আপনার অণুগল্পকে আমি গল্প হিশেবে নিতে পারিনা; সত্য হিশেবে বাস্তবতা মনে করি গল্প দা।

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুরুব্বী : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৯:২৫ |

    বড্ড বিচিত্র মানব মন। বড্ড বিচিত্র!! নির্ভার রোমেলকে আমাদের শুভেচ্ছা। চরিত্রটি যদি আপনার কাছের কারু হয়। ধন্যবাদ মি. মামুন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ১৩-০৭-২০১৮ | ২০:৪৯ |

    এক জীবনে যে কেউ একবারই এই পথে হাঁটার সুযোগ পায়। পরিশুদ্ধ হয়ে পথের শেষে পৌঁছায় ক’জন?

     

    ** এও এক নিদারুন বাস্তবতা।

    শুভ কামনা সবসময়।

    GD Star Rating
    loading...
  4. ইলহাম : ১৪-০৭-২০১৮ | ০:২৬ |

     অসধারণ অণুগল্প! একজনের ভেতরে দুই জন! একটু ভিন্নতা আছে!

    চমৎকার! অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা প্রিয় মামুন ভাইhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. রুকশানা হক : ১৪-০৭-২০১৮ | ১৩:৫৫ |

    একজন রোমেল পরিশুদ্ধ হয় বিবেকের টানাপোড়েন থেকে । একজন গল্পকার সেই পরিশুদ্ধি পাঠকের বিবেকেও পৌঁছে দেন।  

     

    ভালো লাগলো ।

    GD Star Rating
    loading...