অণুগল্প: ধীরে বহো জোৎস্না

ধীরে বহো জোৎস্না অণুগল্প

জোৎস্নায় প্লাবিত চারিদিক। নৌবিহার। নদীর জল চিকচিক। মৃদুমন্দ বাতাস। ঢেউয়ের তালে দুলছে উন্মাতাল দুই হৃদয়। অভিসারে বেরিয়েছেন দু’জনায়। প্রথম প্রেম আজ পরিপূর্ণতা পাবে হয়তো…

খোলা ডেকে পাশাপাশি দু’জন। নারীর এলোচুল বাউরি বাতাসে এলোমেলো। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় পুরুষের চিবুক। ক্ষণিকের ছুঁয়ে যাওয়ায় সে যেন এক দিকভ্রান্ত নাবিক। হারিয়েছে পথের দিশা। তার খোলা বুক। ভিতর থেকে উকি দেয়া কালো পশমে ঢাকা চওড়া বুক, অজান্তেই ঢোক গিলতে বাধ্য করে নারীকে। জ্বলে ওঠে তার চোখ। ভিতর বাহিরে নারী অঙ্গারে পরিণত হয়। পুরুষের দিকে তাকায় একপলক। কোথায়ও কেউ নেই। চারদিকে নিঃসীম নিঃসঙ্গতায় ডুবে আছে চরাচর। একটু একটু ঢেউয়ের তালে দুলতে থাকা নিঃসঙ্গ বোটের দুই বিপরীত লিংগের মানুষ দু’জন ছন্দে ছন্দে একে অপরকে ছুঁয়ে যায়। কোথায় যেন জ্বলে যায়.. তবুও শান্ত.. কি এক ইংগিতের অপেক্ষায় মৌণ দু’জন!

নারীর অপেক্ষা সহ্য হয়না। কিন্তু দু’জনের ভিতরে কঠিন শপথ- কেউ কাউকে ছুঁবে না আগে। যে অগ্রণী ভূমিকা নেবে, তার হার হবে। তাই অসহ্য জ্বলনে কষ্টকর মুহুর্ত পার হচ্ছে নিঝুম নিমগ্নতায়!

পুরুষের শরীরের নিজস্ব ঘ্রাণে উদ্বেলিত নারী! কি এক অমোঘ আকর্ষণে একটু ঝুঁকে পড়ে সে পুরুষের দিকে। তার এক চোখ নিজের অবাধ্য চুলে ঢেকে আছে। অন্যটি পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অস্ফুট নিরব মিনতি তার কাঁপন ধরানো চোখের তারায়। গোলাপী ঠোঁটের নিজেদের জোর করে চেপে রাখার অপপ্রয়াস হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয় নারীর সুরেলা কণ্ঠের ঝংকারে-

“ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
না।
তবে ?
স্মৃতি।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে।”১

পুরুষ এতক্ষণ নিজের পৌরুষকে অবদমিত করে রেখেছিলো শপথের কঠিন নিষেধের বেড়াজালে। নিঃসঙ্গ যুবতীর শরীর ছাপিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ানো কামনার বহ্নিশিখারা, এক মায়াবী কোমল নারীর সুরেলা মধুমাখা আবৃত্তি শুনে-নিজেরাই নিজেদের শরীর পেট্রোলে ভিজিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়! জ্বলে ওঠে পুরুষের আপাদমস্তক.. সে বিস্ফারিত নেত্রে কল্পনায় নারীর শরীরের বাঁকে বাঁকে নিজের ভিতরের নিজকে অবগাহনরত দেখে। আপনাতেই তার মুখ দিয়ে বের হয়-

“বরফের কুঁচির মতন
সেই জল মেয়েদের স্তন!
মুখ বুক ভিজে,
ফেনার শেমিজে
শরীর পিছল!”২

আরো একটু আসে নারী! নিঃশ্বাস ঘন দূরত্ব দু’জনের.. হৃদয়ের সিস্টোল-ডায়াস্টোল দামামা বাজিয়ে চলেছে.. নাকের পাটা ফুলে ফেপে একাকার.. কিছু একটা আটকে আসতে চায় গলার কাছে নারীর! মনে মনে বলে সে, ‘ধুর ছাই! জাহান্নামে যাক শপথ’.. মুখে বলে-

“তোমাকে দেখার মতো চোখ নাই, তবু,
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই- তুমি
আজো এই পৃথিবীতে রয়ে গেছো।”৩

নারী নিজেই সমর্পিত হয় পুরুষের বাহুডোরে.. রুপালী চাঁদ জোৎস্না কে বলে ধীরে বহো.. নদীর জলে চিকচিক করে নারীর কালো এলোচুল! পুরুষ নারীর বাঁকে বাঁকে রসুনের খোসার মতো পরতের পর পরত খুলে অবগাহন করে আর বলে, ‘হ্যা! আমি আজো এই পৃথিবীতে রয়ে গেছি কেবলি তোমার জন্য!’

এক নিঃসঙ্গ বোটে- নদীর ঢেউয়ের তালে তালে, চাঁদ আর জোৎস্নাকে সাথে নিয়ে, ছন্দে ছন্দে কাঁপন ধরিয়ে যায় ফেরারি সময়।।

#ধীরে_বহো_জোৎস্না_অণুগল্প_৩৩৭

১ কথোপকথন – ৪ – পূর্ণেন্দু পত্রী
২ জীবনানন্দ দাস এর কবিতার লাইন
৩ জনান্তিকে- জীবনানন্দ দাস

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৯ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৯-০৭-২০১৮ | ১০:৪১ |

    অণুগল্পটি অসাধারণ সাজিয়েছেন মি. মামুন। আগে পড়া থাকলেও যতবারই পড়ি নতুন মনে হয়। মনে হয়; বাহ্ নতুন আর একটি লিখা পেলাম। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৫:৫৭ |

      এমন লেখা চাইলেই লিখতে পারি না আমি। মাঝে মাঝে মাথার তার ছিড়ে যায়, তখন দু'একটা এমন লেখার জন্ম হয়।

       

      ধন্যবাদ ভাইয়া আপনার সুন্দর অনুভবের জন্য।

      শুভেচ্ছা, ভালোবাসা নিরন্তর।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. রিয়া রিয়া : ০৯-০৭-২০১৮ | ১৩:৩৬ |

    লেখার মাঝে কবিতা ব্যবহার একটা ইউনিক আইডিয়া। শুভেচ্ছা রাখলাম গল্প দা।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৫:৫৯ |

      ধন্যবাদ প্রিয় দিদি।

      গল্পের প্রয়োজনে কবিতা এনে দেখলাম কেমন হয়, খারাপ হয়নি অনুভবে এলো।

      আপনার জন্যও নিরন্তর শুভ কামনা রইলো…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. ইলহাম : ০৯-০৭-২০১৮ | ১৯:৫০ |

    অপুর্ব! সাহিত্য নির্মাণশৈলীর শালীনতা বজায় রেখে দারুণ এক আবেদনময় অণুগল্প। শুভেচ্ছা নিরন্তর!!!!https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৬:০০ |

      আপনার অনুপ্রেরণার জন্য শুভেচ্ছা ইলহাম।

      ধন্যবাদ… ভালো থাকুন প্রিয়জনদের নিয়ে।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  4. রুকশানা হক : ১০-০৭-২০১৮ | ৮:৪৩ |

    অসাধারণ অনুগল্প —- নিয়ন্ত্রিত মানবীয় অনুভূতির তীব্রতায় গল্পটি অনু থেকে বৃহৎ হয়ে পাঠককে দোলা দিতে সক্ষম।  

    চমৎকার।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৬:০৪ |

      অনেক দিন পর আপনাকে পেলাম প্রিয় 'শব্দকুড়ানি'- প্রিয় কবি।

      ধন্যবাদ আপনার সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।

      জীবন-জীবিকা আমাকে এতটাই ব্যস্ত রেখেছে যে লেখালেখির জন্য সময় খুবই কম। তাই আপনাদের লেখাগুলো তে যেতে পারি না। 

      ভালো থাকুন আপনার কাছের মানুষদেরকে নিয়ে।

      শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  5. সাইদুর রহমান১ : ১৪-০৭-২০১৮ | ৯:২০ |

    পুরুষের শরীরের নিজস্ব ঘ্রাণে উদ্বেলিত নারী! কি এক অমোঘ আকর্ষণে একটু ঝুঁকে পড়ে সে পুরুষের দিকে। তার এক চোখ নিজের অবাধ্য চুলে ঢেকে আছে। অন্যটি পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অস্ফুট নিরব মিনতি তার কাঁপন ধরানো চোখের তারায়। গোলাপী ঠোঁটের নিজেদের জোর করে চেপে রাখার অপপ্রয়াস হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয় নারীর সুরেলা কণ্ঠের ঝংকারে

    গদ্যের মাঝে কবিত্বশৈলী সম্পূর্ণ নতুনত্ব আনয়ন করছে প্রিয় লেখক কবি মি. মামুন।

    GD Star Rating
    loading...