ছোটগল্প: সৌরভ

ভালোবাসার মেয়েটিকে হারাবার পর, বছরগুলি পাগলের বেশে কাটিয়েছিল আমান। আক্ষরিক অর্থেই পাগল ছিল সে। সেই সূত্রে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছে। জেলায় জেলায় বন্ধু পেয়েছে।
.
বিচিত্র সে সব বন্ধুরা ওর।
কেউ পুলিশ কেউ মাঝি। কেউ রেলের শান্টিং মাস্টার তো কেউ ভার্সিটির প্রোফেসর। সবাই-ই বন্ধু। এদের ও আবার বিচিত্র কর্মকান্ড। বড্ড চিত্রিত হয়েছে তাতে ওর রংহীন জীবন। বিবর্ণ.. ধূসর। তাতে ধার করা রঙ লেগেছে শুধু। বর্নীল হয়েছে কিনা জানে না সে।
.
নেশারু বন্ধু ও আছে। মন খারাপের বিকেলগুলি, আমানের অসহ্য লাগে। সে তখন সন্ধ্যায় প্রবেশ করে। আঁধারে নীল জোছনায় ভিজে।
এমন এক সাঁঝেরবাতি জ্বলা ছোট্ট ট্রলারে। তুরাগের মাঝবুকে। এক মধ্যরাতে। তারা ছিল আকাশে। মেলা চলছিল বোধহয় ওদের। আকাশের মেঘবালিকারা ইয়াবা সেবন করেছিল বুঝি সে রাতে। তাই নির্ঘুম থেকে ঢেকে রাখছিল চাঁদ কে।
.
মাঝি আমানের বন্ধু। গাঁজায় আসক্ত। যুবক বয়স। ট্রলারে ছিলো আরও একজন। পড়ন্ত বেলার। সাদা চুল ব্যাক-ব্রাস করা। চকচকে চেহারা। শরীরে বয়সের ছাপ না থাকলে ও চোখে বয়স বসে গেছে।
.
যখন মেঘবালিকারা কান্না শুরু করল, তখন মাঝ নদীতে মধ্যরাতে কেবল আমানরা তিনজন। হাতে মাটির কল্কে। গোল হয়ে ঘুরছে। উপরে স্টিলের খোলা ছাদ। শীতল জলকণার ছিটকে আসার শব্দে ঘোর লাগে ওদের।
.
টুকটাক আলাপ থেকে পরিচিত হওয়া। দু’একটা কথায় সম্মত হওয়া। বিতর্কিত কথা এড়িয়ে যাওয়া। সব পার হয়ে শেষে নিজেদের কথায় প্রবেশ করা।
.
ব্যাক-ব্রাস করা চুলের মালিক ইতোমধ্যে পঞ্চাশ অধিক বসন্ত করেছেন পার। নিজের কথায় সাদা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিহিত সেই সাদা চুলের মালিক নিজেকে চেনালেন। এক মধ্যরাতে। ঘোর লাগা প্রহরে।
.
‘আমার বউটা পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুক। আপনারা আমীন বলেন। বড্ড ভাল মহিলা ছিলেন। বড্ড ভালবাসত আমায়।’

আমান আর মাঝি নিজের মনে আমীন বলে।

থামেন তিনি। কিছুক্ষণ ভাবেন। আমান কথা বাড়ায়,
– আপনি ভালবাসতেন না?
– হ্যা! বাসতাম। অনেক বাসতাম। সে জানত এটা। এজন্যই যাবার বেলায় হাত ধরে কেঁদেছিল। মৃত্যু ভয়ে না। সে চলে গেলে কে দেখবে আমাকে এই ভেবে!
.
একটু জোরেই হেসে ফেলেন তিনি। বাইরের বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়েও সেটা আমানের কানে বাজে। বেশ জোরালো।

– একবার ভাবুন তো, সারাজীবন ছোট্ট চড়ুই বাবুর মত তাকে আগলে রাখলাম আমি! এমনই ভাবতাম আমি সারা জীবন। অথচ যাবার সময় কাঁদলো কিনা, কে আমাকে দেখে রাখবে ভেবে? কে ভালবাসবে তার মত! আমিই চড়ুই বাবু ছিলাম তার কাছে। সেই আগলে রাখত আমাকে। বুঝলাম আমি এটা সে চলে যাবার বেলায়।
.
নিরবে জল গড়িয়ে নামে। নদীর জলে দু:খগুলি ভেসে যায় বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়ে। আমানের এমন মনে হয়। নি:শব্দের মাঝে নিরব তিন পুরুষ। একজনের কষ্টগুলি অনুভব করতে চায় বাকী দু’জন। পারে কি?

কারও কষ্ট তার মত করে অন্য কেউ অনুভব করতে পারে কখনো?
.
আমান নীরবতায় আঘাত হানে আবারও।
– আপনার কে কে আছেন?
– এক ছেলে। তার বউ। নাতি একজন।- নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন তিনি।
– আপনার ছেলেই তো আছে আপনাকে দেখে রাখবার। ভালবাসবার। কি করে ছেলে?
– আমি আমার এলাকার সব চেয়ে ধনী। বলতে গেলে পুরা একটা মহল্লার মালিক। সব জায়গা বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দেয়া। গার্মেন্টসের স্টাফ ওয়ার্কাররা ভাড়া থাকে। ছেলের কিছু করা লাগে না। তারপরও গার্মেন্টস ফ্লোর করে দিয়েছি আমি। সেখানে সাব-কন্টাক্টের কাজ করে ছেলে।
.
মাঝি নীরবে শুনছে। কল্কে পরিষ্কার করছে। অখন্ড মনযোগ দু’দিকেই। আমান মন্তব্য করে,
– সবই তো তাহলে ঠিক আছে। সমস্যা তো কোথাও নাই।
– হ্যা, সবই ঠিক ছিল। আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি দিতে চেয়েছিলাম আমার সম্পদকে। কিন্তু ছেলে সম্পদ হতে চাইল না।
– কি রকম?
– ওর মা থাকতেই তার বিয়ে দিয়েছিল। নিজের পছন্দ করা মেয়ে এনেছিল ওর মা। লক্ষী। গুণবতী।
চেহারা বেশ সুন্দর আমার ছেলের। একটু বেশী-ই সুন্দর ছেলে। সেই হিসেবে তার চরিত্র সুন্দর হল না। পরনারীর বড্ড নেশা তার।
.
আবারও কিছুক্ষণ চুপ থাকেন তিনি। কুপির আলোয় এক রহস্যময় রাতে, ট্রলারে মাঝনদীতে এক মধ্যরাতে-আমানদের ছায়াগুলি দীর্ঘ প্রলম্বিত দেখায়। স্বপ্ন গুলির মতই দীর্ঘ হতে চায় বুঝি!
.
রহস্যময় সাদা পোশাক পরিহিত মানুষটি কথার খেই ধরেন,
– মাসে ঘর ভাড়াই আসে আমার পাঁচ লাখের উপরে। আরও মার্কেট, ইটের ভাটা- সব মিলিয়ে আরও অনেক আসে। সব আমি ছেলের জন্য দিয়েছি। কিন্তু সে কি দিচ্ছে আমাকে?
.
আমান এবং মাঝি চোখে চোখ রাখে ওনার। দীর্ঘক্ষণ পলক পড়ে না। কারো চোখের।

– আমি কি চেয়েছি, ছেলে বুঝে না। ছেলে যা চায়, আমার পছন্দ না। সমস্যা না, এটা?
আমানের একটু আগের প্রশ্নের উত্তর দিলেন এবার।
.
– আমি তেমন লেখাপড়া করি নাই। দুনিয়া আমাকে শিখিয়েছে। ছেলের মা চাইলেন ছেলে অনেক পড়াশুনা করুক। প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে এমবিএ করালাম। দেখুন শিক্ষিত ছেলের কেমন অশিক্ষিত কাজকারবার!
– সে কি তার মা বেঁচে থাকতে ও এসব করতো?
– হ্যা, স্বভাব তো আর একদিনে নষ্ট হয় না। বদলায় ও না একদিনে। নষ্টের আলাদা ঘ্রাণ আছে। অনেকে পায় না। আমি পাই। ওর মা পেতেন না। আর আমিও আমার সব শক্তি দিয়ে ওনাকে পেতেও দিতাম না। এসব খবর বাতাসে ছড়ায়। আমি বাতাসকে ও আটকে রাখার চেষ্টা করেছি।
.
আবার নীরব। দূর থেকে আর একটি নৌযানের আলো এসে পড়ে আমানদের ট্রলারে। তীব্র আলোয় ভেসে যায় আমানরা-ট্রলার-মাঝনদী সব। মাঝি বিচলিত হলে তিনি হাসেন।
– আমার ট্রলার। আমাকে নিতে এসেছে।
.
বড় ট্রলারটি ওদের ছোট ট্রলারটির পাশেই নিরবে অন্ধকারে ভুতের মতন দাঁড়িয়ে থাকে। বৃদ্ধ এবার আমানের চোখে তাকিয়ে বলেন,
– আমি চেয়েছি আমার ছেলে সুগন্ধী হয়ে উঠবে। সে রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যাবে, সৌরভ ছড়াবে। অনেকক্ষণ সেই ঘ্রাণে রাস্তা মৌ মৌ করবে। সবাই বলবে, ঐ যে, আমার ছেলে যায়। আমার সিনা গর্বে চওড়া হয়ে যাবে। ও নিজের ঘ্রাণের সাথে সাথে আমার ঘ্রান ও ছড়িয়ে যাবে। সুগন্ধী গোলাপ না হয়ে নর্দমার নোংরা হয়েছে ছেলে। এটাই সমস্যা আমার।
.
তিনি নি:শব্দে উঠে চলে যান। বাইরে তখনো একটানা বৃষ্টি। তাঁকে নিয়ে আধারের বুক চিরে সার্চলাইটের তীব্র আলোয় পথ খুঁজে ফেরে দীর্ঘ ট্রলারটি।
.
পথ খুঁজে ফিরেন একজন বাবাও। ছেলেকে সুগন্ধী ফুল বানাবার মিশনে ব্যর্থ তিনি। যার প্রিয় মানুষটি তাকে ছেড়ে চলে যাবার আগে হাত ধরে কেঁদেছিল। বড্ড ভালবাসতেন তাকে তিনি। বাতাসকেও আটকে রাখার মত ক্ষমতাধর একজন স্বামী হয়েও, নিজের ছেলের সৌরভে মেতে উঠার আনন্দে মগ্ন একজন বাবা হতে পারলেন না তিনি।।

_____________
#সৌরভ_ছোটগল্প

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৫-০৭-২০১৮ | ১১:৩১ |

    আপনার প্রতিটি লিখা বেশ গুরুত্বের সাথে পড়ি। একটা বিষয় আমার কাছে অসাধারণ লাগে … আপনার লিখায় অজস্র অভিজ্ঞতার মিলন খুঁজে পাই। ধন্যবাদ মি. মামুন।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৬:২৮ |

      আপনার অনুভবের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা রইলো ভাইয়া। বিভিন্ন শহরে বাবার চাকুরির জন্য আমাকে থাকতে হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে আলাদা আলাদা মানুষের সাথে মিশতে হয়েছে বিধায় বোধকরি এই অভিজ্ঞতা এসেছে।

       

      ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. রিয়া রিয়া : ০৫-০৭-২০১৮ | ১৯:৪০ |

    সৌরভ অণুগল্প পড়লাম গল্প দা। ভাল থাকবেন।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৬:২৯ |

      অণুগল্পটি পড়ার শুভেচ্ছা রইলো দিদি।

      ভালো থাকুন সব সময়।

      শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. সাইদুর রহমান১ : ০৬-০৭-২০১৮ | ৯:৩৫ |

    সকালের কচি রোদে দারুণ লাগল প্রিয় লেখক মি. মামুন

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৬:৩১ |

      আপনার ভালো লাগা টুকু আমার জন্যও প্রেরণাদায়ক জানবেন ভাই।

      শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

      GD Star Rating
      loading...