বাবার স্পঞ্জের স্যান্ডেল ... মামুনের কবিতা

সন্তান হিসেবে আমি একজন সক্ষম এবং স্টাইলিশ বাবার বিত্ত-বৈভবের ভিতরে লালিত পালিত হয়েছিলাম। আক্ষরিক অর্থেই অভাব শব্দটি কখনোই আমাদের চার ভাইয়ের সামনে আসে নাই।
.
নিজে যখন বাবা হলাম, আমার দুই কন্যা সামনে পেলো একজন অক্ষম এবং ল্যাবেন্ডিশ মার্কা বাবাকে। যে কখনোই তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। যদিও তাদের চাহিদা বিকল্প পথে (দাদী/নানী/মামা/চাচা) নিবৃত্ত হয়ে আসছে অদ্যাবধি।
.
আমার অনেক গল্পে আমি অন্য মানুষের গল্প প্রথম পুরুষে ‘আমি’ শব্দ দিয়ে লিখেছি; কিন্তু অনেক পাঠক ঐ ‘আমি’ শব্দকে আল মামুন খান ভেবে সেভাবে মন্তব্য করেছেন।
.
নিচের কবিতাটিতে একজন বাবার কথা তুলে ধরেছি আমি। জীবনের ভয়াবহ এক সময়ে লিখেছিলাম কবিতাটি, সেই সময়ে আমার পুরনো বন্ধুরা অনেকেই পড়েছিলেন হয়তো কবিতাটি। আজ নিজেই বলছি, কবিতার বাবা আমি নিজেই :D
.
স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ের মানুষটিও আমিই ছিলাম। ৯০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম দীর্ঘ অনেকগুলি মাস (প্রায় দুই বছরেরও অধিক) ওটা পায়ে দিয়ে গোলামির জীবনে ভাংগাচুরা রাস্তা দিয়ে হেটেছিলাম আমি। একদিন স্যান্ডেলটির নিচ দিয়ে তীক্ষ্ণ কিছু একটা ভয়াবহ আঘাত করে আমার পায়ে, গোটা জীবনটাই ঐ এক ধাক্কায় আমার কাছে পাওয়া-না পাওয়ার বঞ্চনা সহ আমার ভুল-ভ্রান্তি সমেত আমার সামনে মুহুর্তের জন্য হাজির হয়েছিলো।
.
তাতক্ষনিক লিখে ফেলেছিলাম রাস্তার পাশের একটা চা’র দোকানে বসে একটা সিম্ফোনি মোবাইলে ডান হাতের কেবল বুড়ো আংগুল চেপে চেপে। আমার ৪টি গ্রন্থের তিনটির বেশীরভাগ লেখাই এভাবে এক আংগুল দিয়ে লিখেছিলাম আমি। কেবল উপন্যাসটি মাত্র ৩ দিনে ডেস্কটপে লিখেছিলাম।

কবিতাটি শেয়ার করলাম:-
________________________________________________

বাবুটা!
খেলনাটা কিনে দেই নাই বলে কি গাল ফুলিয়ে আছো এখনো?
ভিতরে ভিতরে ফুঁসছো নিশ্চয়ই আমারই মতো?
তোমার মা, তুমি দুষ্টুমি করলে কি বলতেন আমাকে নিয়ে?
– ও প্লাস না! বাপের রক্ত। স্বভাব চরিত্র ও বাপের মত হবে না তো কি!
এমনই তো বলতেন সে, মনে পড়ে তোমার?
.
খেলনা টা কিনে দেবো তো… আর কিছু দিন…।
তুমি কি ক্যালেন্ডার দেখতে শিখেছো, বাবুটা?
হাসছো! বাবার কথা শুনে?
পাগলা বাবা আমার- এমন ভাবছ না তো?
তুমি কি কখনো এভাবে ভাবো বাবুটা, বাবাকে নিয়ে?
.
তুমি হাসো বাবার কথা শুনে
আর গ্রিলের ওপারে গেলেই বাবাকে নিয়ে হাসেন অন্য মানুষেরা!
তোমার সামনে থেকে সরে গেলে, বাবা ও কি অন্য মানুষ হয়ে যান?
তোমার…তোমার মায়ের…তার মায়ের…তোমার বাবার মায়ের
এভাবে সবার আড়াল হলে তোমার বাবা মানুষটা কেমন হয়ে যান?
.
তুমি জানবে না এখন… সামনে জানবে, প্রচুর সময়
বাবা জানবেন না, সময় নেই… তাই তোমাকে বলা।
তুমি যেদিন জেনে-বুঝে অনুভবে বাবা মানুষটিকে দেখবে, সেদিনই তুমি আমাকে দেখবে।
তুমি কি কখনো আমাকে দেখতে চেয়েছো?
এভাবে ভাবতে তোমার কেমন লাগছে, বাবুটা?
.
এই শহর! এখানে প্রচুর অলি-গলি
এই অলিতে গলিতে, গ্রিলের ওপারে চলে যেতেই, বাবারা ক্রমশ: ভিন্ন মানুষে পরিণত হন।
এখানে রাক্ষুষী সন্ধ্যা নামে
সেখানে বাবারা ছায়ায় হারিয়ে যান!
নিজেদের কায়া হারিয়ে খুঁজে ফেরেন নিজেকে অহর্ণিশ…
শ্রেফ তোমার জন্য, বাবুটা! এই বাবাও হেঁটে চলেন
সবার মতো নিজের হারানো কায়ার খোঁজে।
.
বড্ডো বন্ধুর সেই পথ
একজন বাবা বছর তিনেক আগে
এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল কিনেছিলেন নব্বই টাকা দিয়ে!
এক পাটির তলায় ছিদ্র হয়েছে
মন খারাপের বিকেলগুলিতে কালো রাজপথ, সেই ছিদ্র দিয়ে আকাশ দেখে নির্ভার হতে চায়।
.
পথে কাঁটা বিছানো
কতটা জানো?
সমগ্র বিশ্ব যন্ত্রণার পেরেক বিছিয়ে বাবাকে স্বাগত জানায় নিরবে।
বাবা আরও নিরবে হেঁটে চলেন… নিঝুম নিমগ্ন সুখে!
তুমি কি এখন অনুভব করছো বাবুটা, বাবাকে?
.
বাবুদের নিজেদের যদি কোনো জাদুঘর থেকে থাকে
তবে সেখানে সবার আগে, বাবার এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল শোভা পাবে!
শুধু তোমার জন্য বাবুটা!
সমগ্র বিশ্ব পায়ে দলে হেঁটেছেন তোমার বাবা..
অণুক্ষণ যন্ত্রণা সয়েছেন… তবু হেঁটেছেন… থামেন নাই!
.
তুমি কি গ্রিলের ওপার থেকে এখন বাবাকে দেখছো?
তুমি কি ‘আমাকে’ দেখতে পাচ্ছো?
.
খেলনা টা কিনে দেবো তো বাবুটা!
সপ্তাহটা ঘুরুক…।।

#বাবার_স্পঞ্জের_স্যান্ডেল_মামুনের_কবিতা

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. সাইদুর রহমান১ : ০২-০৭-২০১৮ | ১৬:১৮ |

    আপনার কাব্য, অনুগল্প, বিশদ গল্প, খোলামেলা আলোচনা সবকিছুই আমাকে টানে। কেননা, যে বিষয় নিয়েই আলোচনা করুন না কেন সবসময়ই আপনি সাহিত্য রস দেয়ায় ক্ষেত্রে আপোষহীন কলম টানেন। এসকল কারণেই আপনার লেখা পাঠকপ্রিয় হয়। নয়তো বাবার কম দামি স্যান্ডেল নিয়েও দারুণ লিখেছেন। আমিও টুকিটাকি চেষ্টা করছিলাম কিন্তু যখন দেখলাম এটা আমার জন্য নয় তখন আর সামনে এগুলাম না।প্রীত হলাম পড়ে।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৬:৫২ |

      আপনার বিশদ খোলামেলা আলোচনা ভালো লাগলো আমার। আসলে যারা গল্পকার/কবি/ সাহিত্যিক লিখতে গিয়ে জীবনের অনেক বিষয় যা নেতবাচক, অন্ধকার পর্ব এবং যা নিজের অনেক গোপন বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে, এমন দিকগুলি 'হাইড' করে যান। এটাও ঠিক না। আমি বর্তমানে সাংবাদিকতা করি, এখন এদেশে সাংবাদিকতার নামে যা চলছে, তা যদি লিখি, তাতে আমি সহ অন্যদের ও গোমর প্রকাশ হয়ে যায়। তাই বলে কি লিখবো না? আমি এ বিষয়ে একটি পর্ব লিখে আর লেখিনি, কারণ আমার বসবাসের এলাকার সকল সাংবাদিকেরা আমাকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছেন। যদিও লেখাটি অবশ্যই আমি শেষ করবো।

      মোটকথা আমি একজন মানুষ হিসেবে নেতিবাচক/ ইতিবাচক মিলিয়েই মানুষটি কেমন সেটাই উপস্থাপন করা উচিত।

      অনেক কথা বলে ফেললাম। ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা রইলো। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ০২-০৭-২০১৮ | ১৮:৩৯ |

    আপনার প্রতিটি প্রেজেন্টেশন যথেষ্ঠ আকর্ষণ জুড়ে থাকে।
    যাপিত জীবন এবং লিখন সুন্দর হয়েছে। অভিনন্দন জানবেন। ধন্যবাদ।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৬:৫৪ |

      ধন্যবাদ ভাইয়া।

      আপনার মন্তব্য লাইক দিতে গিয়ে ভুলে ডিজলাইক বাটনে চাপ লেগে গেলো! এখন একে ফেরানোর কোনো অপশন পেলাম না। কি করা যায়?

      ভালোবাসা নিরন্তর…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. রিয়া রিয়া : ০৩-০৭-২০১৮ | ৭:৪৪ |

    হৃদয় ছোঁয়া লেখা পড়লাম। ভালো থাকুন গল্প দা।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৩-০৭-২০১৮ | ১৬:৫৫ |

      লেখাটি পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ রিয়াদি' 

      আপনিও সবাইকে নিয়ে সব সময় ভালো থাকুন।

      শুভ কামনা… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...