ছিড়ে যায় নূপুর: অণুগল্প

একটা গল্প শুনবেন? আপনাদের কাছে গল্প মনে হলেও, এ একজন অতৃপ্ত নারীর গল্প। ‘অতৃপ্ত’ শব্দটি শুনে আবার ভুল বুঝলেন? না, ভুল বুঝবার অবকাশ নেই। শরীরের অতৃপ্তির সাথে সাথে আমার মনোদৈহিক অতৃপ্তি ও জড়ানো রয়েছে এখানে।
.

আমি কে? আমার নামটি না হয় নাই বললাম। ওটা কি এতোই জরুরী জানাটা? আমি একজন নারী- এটাই কি যথেষ্ট নয়?
.

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। বাবার আদরের ছোট মেয়ে। প্রচন্ড সুন্দরী ছিলাম। সেই সাথে অনেক দুরন্ত ও মেধাবী। আমার গ্রামের সকল ছেলেদের ‘হার্ট-বিট’ ছিলাম আমি! রোজ বিয়ের প্রস্তাব আসতো। ছেলেরা বিরক্ত করতো।
যে জন্য মাত্র ১১ বছর ৪ মাস বয়সে বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন সেনাবাহিনীর এক সেপাইয়ের সাথে!
.

আমি তখন নাবালিকা। পি এস সি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। আগে থেকেই কথাবার্তা চলছিলো, পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি বিয়ের আয়োজন। দোতলায় গিয়ে বসে একা কাঁদতে থাকি, কিন্তু কেউ দেখেনা সে কান্না। রাতে লোকজন ডেকে কলমা হলো। কাবিন হল ২০ হাজার টাকার। ঐ দিন আর এক জায়গায় থাকতে দেয়নি। সকালে ও চলে যায়।
.

শেষে ও আবার আসে একমাস পরে, আমি তখন ঘুমন্ত অবস্হায়, মা ওকে আমার কাছে দিয়ে যান। ও যখন আমাকে ঘুম থেকে উঠায় আমি তখন ভয়ে কান্না শুরু করি। তারপরও ওর কাছেই আমাকে থাকতে হয়। প্রথম বার অনেক ধস্তা ধস্তি করে সে, কিন্তু মিলন হয়নি। কিছুদিন পর আবার ছুটিতে আসে, আমিতো পালিয়ে বেড়াই, কাছে যাইনা ছুটে বেড়াই; কিন্তু রাত হলে বাবা মা ভাই সবার হাতে মার খাওয়ার ভয়ে ওর কাছে গিয়ে থাকতে হয়। তখন ও আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কথা না শুনলে চাপা মার মারে, এভাবে ৩/৪ রাত ঘুম হয়না।
.

এরপর একদিন বেহুঁশের মত ঘুমিয়ে আছি। ও তখন আমাকে ঘুমন্ত অবস্হায় ভোগ করে। এরপরে আমি সাবালিকা হই। তারপর মা আমাকে বুঝাতে থাকে, তখন আস্তে আস্তে স্বামীকে মেনে নেই। কিন্তু প্রথম দিকে আমার খুব কষ্ট হতো। ও যখন আমাকে ভোগ করতো, আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তো, সর্বাঙ্গ ও মনের গভীরে জ্বলে পুড়ে যেতো, যন্ত্রনা হতো। কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলতে পারতাম না! বাঙ্গালি নারী না আমি? কিছুদিন পর আস্তে আস্তে সহনীয় হয়ে উঠলো, তারপর আর কষ্ট পেতাম না। একদিন অনুভব করলাম, ওকে ভালবেসে ফেলেছি!
.

আমাকে বিয়ে করতে আসার আগে গ্রামের বাড়িতে ও আরো একটা বিয়ে করেছিল। আমার মা বাবা তা জানতেন না। পরে যখন সেই বৌ মামলা করে, তখন ওর সেনাবাহিনীর চাকরী চলে যায়। শুরু হয়ে গেল আমাদের কষ্টের জীবন। আমার পড়াশুনা চলছিল, যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন বাচ্চা এলো আমার পেটে। আর পড়াশুনা হলো না, মা হলাম! শুরু হল সংসার জীবন। এক অনাগত ভবিষ্যতের পানে চেয়ে থাকা… আর কষ্টকর গ্লানিকর দিন দিন প্রতিটি দিন কাটানো।
.

দুই বছর স্বামী বেকার ছিলো। তারপর আজ এখানে, কাল ওখানে, এভাবে ছোট খাট চাকরি করতে লাগলো সে। কোনো জায়গায় ওর চাকরি স্হায়ী হতো না। এভাবে চললো দশটি বছর!। তারপরে ওর চাকরি হয় এক সিমেন্ট কোম্পানিতে অফিসার পোস্টে। টাকার মুখ দেখতেই সে আমাকে না জানিয়ে বাবুর্চির মেয়েকে আবার বিয়ে করলো। কেটে গেল আরো ছয়টি বছর! আমি যখন জানলাম তখন আর কিছুই করার ছিলো না।
.

রাবার যেভাবে টেনে লম্বা করে, আমাকে সে ভাবে টেনে বড় করেছে আমার মা বাবা ভাই, ঐ বুড়ো লোকটার সাথে সংসার করার জন্য। আর আমার বয়স্ক স্বামীও সুযোগ বুঝে ইচ্ছেমত আমাকে ব্যবহার করেছে। যখন সেক্সের কিছুই বুঝতাম না, তখন ঢেলে উপুর করে দিতো। আর যখন বুঝতে শুরু করি, জীবন যৌবন উপভোগের সময় এলো, যখন আমি আমি কানায় কানায় পরিপূর্ন; তখন থেকেই আমি একা, তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত!
তারপরেও আমি সেই গানটা শুনি, ‘ওগো যা পেয়েছি সেই টুকুতেই খুশি আমার মন, কেনো একলা বসে হিসেব কসে নিজেরে আর কাঁদাই অকারন’- শুনেছেন না হেমন্তের এই গানটি?
.

যখন তার টাকা ছিলনা তখন শুধু আমিই ছিলাম। আর সে যখন টাকার মুখ দেখলো, ওমনি আমায় ভুলে গেলো। পুরুষ! তোমরা এমন কেন?
.

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস জানেন? দারোয়ান থেকে যে লোক ম্যানেজার হয়েছিল, সে এখন আবার সিকিউরিটি ডিপার্মেন্টে চাকরী করছে! অসুস্থ, চিকিৎসা করানোর টাকা নেই তার, নাইট ডিউটি করে।
.

কিছু পুরুষ লোক হয় কন্যা রাশি, আর আমি বোধহয় পুরুষ রাশি! সেই ছোটবেলা থেকে এই পর্যন্ত এখনো, বয়স চল্লিশোর্ধ। তারপরেও এখনো মৌমাছির মত যেন ছেলেরা পিছু নেয় আমার। একেতো সুন্দরী, তারপরে নেই স্বামী। এখনো যে কত সতর্ক হয়ে চলতে হয়!
.

সারাটা জীবন ধরেতো একাই চলছি, যেদিকে যাই একা, যেদিকে তাকাই একা, নদিটা পার হতে গেলেও হাতটা ধরার জন্য কেউ থাকেনা। বাজারের ব্যাগটাও একা বইতে হয়! কি যে কষ্ট।
.

এখন মধ্যরাত! বাহিরে খুব সুন্দর চাঁদের আলো। জোৎস্না আমাকে খুব স্পর্শ করে, আমি আপ্লুত হই! ছাদে অথবা ব্যালকনিতে বসে জোৎস্না উপভোগ করতে খুব ভাল লাগে আমার!
.

সুখ কি? সেটা না জানলেও দুঃখ কি সেটা হারে হারে জেনেছি আমি। জীবনে অনুভব জিনিসটা কেমন? কিসের অনুভবের কথা বলবো? একজন সুন্দরী স্মার্ট, সেক্সি নারী হয়ে আমার নারী জীবনের অতৃপ্ত বাসনার অনুভব? স্ত্রী হয়েও স্বামীর কদর না পাওয়ার অনুভব? একজন অসুস্থ স্বামীকে রাতের পর রাত-দিনের পর দিন সুস্থ করার তীব্র অনুভব? সারারাত যন্ত্রনায় ছটফট করার অনুভব? দীর্ঘ ষোলো বছর ঘর করার পর নামে মাত্র ৩০/৩৫ বার দৈহিক মেলামেশা করার অনুভব? আর কত অনুভবের কথা শুনাবো বলুন? বেকার স্বামীর সব ভারবহন করার পরও সন্ধ্যায় বা রাতে তার পাশবিক অত্যাচারের অনুভব?
.

তাই এখন নতুন করে কারও কাছ থেকে অনুভবের কথা শুনলে ভয় হয়। কারন কোনদিন এমন অনুভবের ছোঁয়া পাইনি তো তাই। যদি ঐ বালুর তৈরী ঘরের মতো এই নতুন অনুভবও পানিতে তলিয়ে যায়? তাই ভয় হয়। তবে বড্ড মন চাইছে কারো খুব কাছে যেতে। ভাবতেই আমি যেন বেসামাল হয়ে যাই!
.

এত নারী থাকতে এখনো অনেকেরই আমাকে ভাল লাগে! বুঝিনা আমি- বুঝে না তারাও। আমি যে নিঃস্ব একটা মানুষ! মাথার তালু থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত নতুন করে কষ্টকে স্থান দেবো তেমন আর স্থান বাকী নাই আমার!
.

আমি মেয়ে! আমি দূর্বোধ্য! আমার নূপুরের অংশ ছিড়ে গেছে, কিন্তু আমি সেই ছেড়া নূপুরের নিক্কন শুনতে ভালোবাসি। আমি নূপুরের ছেড়া অংশ হাতে নিয়ে বসে থাকা এক নিঃসঙ্গ শংখচিল। যার সাথী থেকেও নাই।
.

‘কিনেছি অনেক দামী উপহার
বহু মনোহর কাগজের ফুল; ভালোবাসা দিয়ে হয়
নাই কেনা একখানি মেঘ একটি বকুল!
জমিজমা আর গৃহ আসবাব
অধিক মূল্যে করে রাখি ক্রয়, শুধু কিনি নাই
কানা কড়ি দিয়ে একজোড়া চোখ একটি হৃদয়!’ *
.

#ছিড়ে_যায়_নূপুর_অণুগল্প_৪২৭

* কবিতাঃ মহাদেব সাহা

** ছবিঃ পার্বতী ঘোষ এর স্কেচ

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০২-০৬-২০১৮ | ৭:৫৪ |

    ছিড়ে যায় নূপুর পড়লাম।
    অণুলিখনটি শুধুই এক নারীর জবানবন্দী নয়; সহস্র নারীরও বটে। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৩-০৬-২০১৮ | ২:০৫ |

      ধন্যবাদ অণুগল্পটি পড়ার জন্য ভাইয়া।

       

      সহমতে আছি জানবেন।

      শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  2. রিয়া রিয়া : ০২-০৬-২০১৮ | ১৬:২৭ |

    ব্যাথাতুর হলাম গল্প দা। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৩-০৬-২০১৮ | ২:১১ |

      আমার আশেপাশে এরকম অনেক নারী অহর্নিশ যন্ত্রণায় কাতর। একজন গল্পকার হিসেবে কদাচিৎ আমি তাদের কিছুটা অনুভূতি জানতে আপ্রি। সেটাকে শব্দে সাজানোর ব্যর্থ চেষ্টা আমার দিদি।

       

      কিন্তু একজন নারীর যন্ত্রণাকে কীভাবে শব্দে প্রকাশ করা যায় সে ক্ষমতা আমাকে দেন নাই আমার ঈশ্বর।

       

      ধন্যবাদ আপনার অনুভূতি জানানোর জন্য।

       

      শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...