এক শুদ্র কিছু কিছু লিখতে শিখেছিল। অবিরাম লিখেই যেত সে। তবে জাতে সব থেকে নিচু হওয়াতে উঁচুতলার মানুষেরা তার লেখা পড়ত ও না, কোথাও ছাপত ও না। একদিন চলার পথে এক ব্রাহ্মণ লেখককে ভুলবশত ছুঁয়ে দেয় শুদ্র। তাকে চিনতে পেরে ছিটকে সরে গিয়ে ব্রাহ্মণ বললেন,
‘একি ঘোর অনাচার, ওহে পাপিষ্ঠা দুরাচার!
ছুঁয়ে দিলি আমায়! হে নির্বোধ কোথাকার?’
.
সত্যিই শুদ্র লেখক নির্বোধ হয়ে যায়। তখন এক ক্ষত্রিয় লেখক কোথা থেকে ছুটে আসে। মহাত্মন কে লক্ষ্য করে বলে,
– এরা যে সব আবর্জনা তৈরী করছে, সেগুলো নিয়ে আবার শিল্পকর্মের নামে ওদের যে আত্মবিলাস, এইসব ঢং দেখে বড্ড বিতৃষ্ণা জাগে আজকাল।
.
ব্রাহ্মণ চুপ থেকে বিড়বিড় করে কিছু একটা জপতে থাকেন। হয়তো ছোট জাতের লেখকের ছুঁয়ে দেয়ায় সৃষ্ট অশুচি ঝেড়ে ফেলে দেহের শুদ্ধিকরণের কোনো মন্ত্র পড়েন। কিন্তু মনের ভেতরের এই যে ছুঁয়ে দেয়ায় দৈহিক শুদ্ধতা আনতে উদ্যোগী হওয়া, দলিত লেখকের কাছে ব্যাপারটা যেন এমন লাগে, একটা সাবান গ্রাম্য কাঁচা টাট্টিখানায় পড়ে গেলে আরেকটা সাবান দিয়ে সেটা পরিষ্কারের মতই। শুদ্র হেসে ফেলে। একটু বুঝি জোর হয়েছিল শব্দে। তাই ক্ষত্রিয় লেখক তেড়ে আসে.. যেন চড়াও হতে চায়, দলিতকে দলিত- মথিত করে দেবে এমন ভাব। নিজের চেয়ে উঁচু জাতের মানুষকে ওর মনের অনুভব উদ্ধত নিচু জাতের মানুষটিকে দেখিয়ে প্রকাশ করে,
– দেখলেন তো? বলেছিলাম না আবর্জনা। নিজের নিচুতাকে আড়াল করতেই এই লিখালিখির বাহানা।
.
মুহুর্তে ভগবান প্রকট হন.. কোথায় যেন শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে.. বিশ্বচরাচর এক অরোরা জোতির্ময় আলোকপ্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে.. শব্দের ক্ষীণতম সুর লহরিটিও দূর নিহারিকা থেকে পলকে জড়ো হয়..বেজে ওঠে সহস্রকণ্ঠে,
” ওম! নম: শিবা!!”
.
তিনজন লেখকই মাটিতে নত হয়ে সম্মান জানায়। তারা তিনজনই যার যার কানের বদলে দেহের প্রতিটি রোমকুপ দিয়ে শিবের কথা শুনতে পায়,
‘আমি জাত বানাই নাই, মানুষ বানিয়েছি। মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে জাত বানিয়ে অমানুষ তৈরী করেছে। ওহে উঁচু জাতের লেখক! জনমভর এই শুদ্রের জীবন কাহিনী লিখে লিখে তুমি উচ্চশিরের অধিকারী- আর আজ ওর ছুঁয়ে দেয়ায় তোমার জাত গেল মনে হচ্ছে!? আর আবর্জনা কাকে বলছ তুমি মধ্যম জাতের দু’কূল হারা ক্ষত্রিয়? ওদের তো তবু নির্দিষ্ট জাত আছে প্যাঁচ লাগিয়ে তুমিই বা কেন কুজাতে পরিণত হতে চাইছ?’
.
শিবের কথায় দু’জন উচ্চবর্ণের লেখক নিজেদের কালো মনের ভেতর দিয়ে সৃষ্ট আলোর ঝলকের আসল উপলব্ধিতে বিলীন হয়ে চলে.. ওদের উঁচু নাক মাটিতে মিশে যেতে যেতে অনুশোচনায় তাদের হৃদয়কে দগ্ধ করে! নিচু লেখক আরো নিচু হয়.. তবে ওর ক্ষুদ্র নাকে মাটি স্পর্শ করে না.. তবুও মাটি খুশী হয়.. ভালোবাসা আত্মসমর্পনের মোড়কে ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার হৃদয়কে প্রসারিত করেই চলে। একসময় সারা জগতকে বেষ্টন করে নিজের ক্ষুদ্র হৃদয়ে এসে পথ খুঁজে পায়.. আলোর ঝলকে গোপন প্রত্যাদেশে মোক্ষ লাভ? সে আলো হয়.. আলো বিলাতে আবারো পথে নামে। প্রথম সকালের শেষ রৌদ্রকিরণ ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে.. দ্বিতীয় কিরণের আগমনী বার্তার আগের সময়টুকুতে সব কেমন চুপচাপ..
.
নিশ্চুপ
চারিধার
একদিন
প্রতিদিন!
#তিনি_শুদ্র_অচ্ছুৎ_মামুনের_অণুগল্প_৪২৩
loading...
loading...
"আমি জাত বানাই নাই, মানুষ বানিয়েছি। মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে জাত বানিয়ে অমানুষ তৈরী করেছে। ওহে উঁচু জাতের লেখক! জনমভর এই শুদ্রের জীবন কাহিনী লিখে লিখে তুমি উচ্চশিরের অধিকারী- আর আজ ওর ছুঁয়ে দেয়ায় তোমার জাত গেল মনে হচ্ছে!? আর আবর্জনা কাকে বলছ তুমি মধ্যম জাতের দু’কূল হারা ক্ষত্রিয়? ওদের তো তবু নির্দিষ্ট জাত আছে প্যাঁচ লাগিয়ে তুমিই বা কেন কুজাতে পরিণত হতে চাইছ?"
চিরন্তন এই সত্য ভাষণ মানুষ কবে মাথায় ধারণ করবে জানিনা। শুভেচ্ছা মি. মামুন।
loading...
কবে ধারণ করবে জানি না, তবে ধারণ করাটা উচিৎ। নাহলে মানুষের আসল মনুষ্যত্ব কিভাবে প্রকাশ পাবে?
ধন্যবাদ সাথে থেকে আপনার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য। ভালো থাকুন সব সময়।
শুভেচ্ছা…

loading...
ধন্যবাদ মি. মামুন।
loading...
স্বাগত আপনাকে ভাইয়া
loading...
নিখাঁদ বাস্তবতা। শুভেচ্ছা প্রিয় গল্প'দা মামুন।
loading...
ধন্যবাদ দিদি।
শুভেচ্ছা…
loading...