ঘ্রাণ_অণুগল্প

কখনো যদি টেলিফিল্ম বানাই, এই গল্পটিকে বানাবো। আমার উপন্যাস (অসমাপ্ত) ‘আগন্তুক’ এর একটি পর্ব ‘ঘ্রাণ’।

আবার শেয়ার করছি:
________________________________
কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। সাগরপারের যে হোটেলটিতে রাহেলা উঠেছে, কক্সবাজার এলে সে এখানেই ওঠে বরাবর। কেন যে উঠে সেটা কখনো মন জানতে চায়নি; সে ও মনকে জানায় নাই। কিসের এত ঠ্যাকা পড়েছে! মন কি কখনো নিজের খারাপ-ভালো অবস্থার কথা ওকে জানায়?

এই হোটেলের নিজস্ব সৈকত রয়েছে। হোটেলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ‘সাগর-স্নানের’ ব্যবস্থা থাকায় সৌখিন ভ্রমণ পিপাসুরা এখানেই রুম বুকড করে রাখে।

দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে সে একা একা। সামনে অন্তহীন সাগর। উপরে মহাকাশ অসীম ব্যপ্তি নিয়ে মাথার ওপরে ছায়া দিয়ে আছে। হঠাৎ এক সাগরকন্যার মন খারাপের দরুন আকাশবালিকারাও গাল ফোলানো গম্ভীরতায় নিজেদের শুভ্রতাকে বিসর্জন দিয়ে আঁধারে ডুবে যায়। এরপর নিঃসঙ্গ রাহেলা নামের এক সাগরকন্যার কষ্টগুলো অনুভব করেই ওরা কেঁদে ওঠে। টানা কেঁদে চলে ঘন্টাখানিক। এরপর শকের প্রাথমিক ধাক্কা কেটে গেলে একটু শান্ত হয়। কিন্তু নিজেদের আভরণ সেই আঁধারেই ঢাকা থাকে। পূর্বের শুভ্র উজ্জ্বলতা মাঝে প্রিয় আকাশী রঙে ফিরে আসতে ওদের আরো কিছুটা সময় লেগে যাবে।

এই প্রাইভেট সৈকতে আর ভালো লাগে না রাহেলার। যদিও নিরিবিলি থাকাটা ওর বেশী পছন্দের। কিন্তু এই পর্যটন নগরে অচেনা রঙিন মানুষদের মাঝে থেকে নির্জনতার স্বাদ নিতেই চেয়েছে সে এবার। ভেজা কাপড়ে বের হবে, না রুমে গিয়ে শুকনা কাপড় পরে বের হবে? পলকের দ্বিধায় একটু বিচলিত হলেও শেষে ভেজা কাপড়েই যাওয়াটা স্থির করে মনের সাথে। অবুঝ মন! সব বুঝে, কিন্তু কিছু-ই বুঝে না।

এ কেমন অনুভব! কেন এমন উপলব্ধি! এই নিঃসঙ্গতা কেন?
ভেবে ভেবে হেঁটে হেঁটে লাবনী পয়েন্টকে ছাড়িয়ে কখন এসেছে খেয়াল-ই নেই। সুগন্ধা পয়েন্টের দিকে আগায়। ভেজা বালু রোদবিহীন আলোক স্বল্পতায় ও কেমন চকচক করছে! আদৌ কি করছে, না এটাও ওর খেয়ালী মনের কল্পনা? শুধুমাত্র এই কল্পনার কারণে-ই নাকি বিগত দিনগুলিতে একজন মানুষকে কেন্দ্র করে ওর কাছের প্রিয় দুজন মানুষ অনেক দূরে সরে গেছে। যে মানুষটিকে রাহেলা দেহ-মন-প্রাণ সব-ই দিয়ে নির্ভার হতে চেয়েছিল, সে নাকি বাস্তবে আসলে কেউ না। সব ওর মনের কল্পনা। দেশের এবং বিদেশের নামকরা সব সাইক্রিয়াটিস্ট ও একই কথা বলেছে। বলেছে এটা রাহেলার মুডের সমস্যা… এক ডিস্টার্বড ভিশন ওর ভেতরে হঠাৎ করেই জন্ম নিয়েছে। তাই ওর অবচেতন মনের চেতন অংশ অচেতন অংশের সাথে সংঘর্ষে জড়ানোর কারণেই যত সব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

কিন্তু এদেরকে কিভাবে রাহেলা বুঝাবে যে, এটা ওর ভেতরের কোনো ডুয়াল ক্যারেক্টারের অনুভবের কিংবা মুডের সমস্যা নয়। সে যা দেখতে পায়, সেটা ওর দৃষ্টি বিভ্রম নয়। সে ঘ্রাণও পায়। ভালোবাসার ঘ্রাণ.. ঘৃণার ঘ্রাণ.. ঘ্রাণের ঘ্রাণ- এসবই সে সেই নির্দিষ্ট মানুষটিকে সামনে পেলেই পায়। বিভ্রমের সময়েও কি আমাদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় এরকম তীব্রতর ভাবে নিজেকে প্রকট করায়? হয়ত… হয়ত না।

কোনো ভাবেই কোনো কাজ না হওয়ায় ওর বাবা নিজের মত করে একটা জীবন ওকে উপহার দিলেন। ওর কাছে কেউ কিছু জানতে চাইবে না। ওকে জবাবদিহি করতে হবে না কারো কাছে। শ্রেফ নিজের জন্য এক আলাদা ভূবনের একমাত্র সম্রাজ্ঞীর এক পোষ্ট-ই বাবা ওকে দিলেন। শর্ত একটা-ই। বাবার সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। সেটা সেলফোনের দ্বারা-ই হোক, কি জিপিএস এর মাধ্যমে প্রযুক্তির উচ্চতর ব্যবহারের দ্বারা-ই হোক। একভাবে হলেই হলো। এটা ছিল বাবার শর্ত।

রাহেলা ও বাবাকে ওর নিজের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করিয়েছিল। ওর পেছনে কোনো মানুষকে বাবা নজরদারী করতে লাগাবেন না। বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেটা ও মেনে নিয়েছিলেন। তবে এই একটা ব্যাপারে বাবা যে তাঁর কথা রাখবেন না, সেটা রাহেলা বেশ ভালো-ই বুঝেছিল। অন্তত আর কাউকে না হোক, সবুর চাচাকে বাবা অবশ্যই নজরদারির এই কাজে লাগাবেন-ই। ছেলেবেলা থেকেই ওকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন সবুর চাচা। আর বাবা না বললেও সবুর চাচা ঠিকই তাঁর দীর্ঘদিনের দায়িত্ব পালন করেই যাবেন।

সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ! এদের ভেতরে যে কেউ সবুর চাচা হতে পারেন। নিজের ভোল পাল্টাতে ওনার মত দক্ষ এই সময়ে হয়ত আর কেউ-ই নেই। আশেপাশের সবার দিকে অসহ্য অলস গতিতে রাহেলা চোখ বুলিয়ে যায়। অতি পরিচিত মুখের আসল জিনিস দুটি একবার দেখলেই সে চাচাকে চিনতে পারবে। অসম্ভব উজ্জ্বল সবুর চাচার চোখ। বাঘের মত। এই বয়সেও বাঘের ক্ষিপ্রতায় চলাফেরা করেন।

আনমনে হেঁটে হেঁটে কখন যে সুগন্ধা বিচও পার হয়ে এসেছে রাহেলার খেয়াল নেই। ধীরে ধীরে মানুষজনের ভিড়টা হাল্কা হয়ে আসাতে সাগরের নির্জনতা টানা গর্জনের ভেতরেও কেমন এক সুরেলা মৌণপ্রহরের কোমল ছুঁয়ে যাওয়ায় রাহেলাকে উদ্দীপ্ত করে! আরো কিছু দূর এগিয়ে গিয়েই বেশ দূরে একজনকে ট্রেইল রেখে ধীরে ধীরে হেঁটে যেতে দেখে। পেছন থেকে এই অচেনা পুরুষটিকে কেন জানি কাছে-দূরের অনুভবে অনুভবক্ষম ওর বড্ড চেনা কারো মত লাগে। একপলকে মনে হয়, ‘সে না তো!’ আর যখনই তাঁর কথা ওর মনে হয়, ওকে পেছনে ফেলে পায়ের ছাপ রেখে এগিয়ে যাওয়া মানুষটির সেই চিরপরিচিত ঘ্রাণ পায় সে! চিত্তে স্বেচ্ছা-বিসর্জনের করুণ রাগিনী মুহুর্তে ভেতরের স্নায়ুদের প্রহ্লাদ নৃত্যে কেমন যেন মাতোয়ারা করে তোলে রাহেলাকে! আকাশ-বাতাস-পাতাল জুড়ে কেবল একজনের আগমনী ধ্বনি বেজে চলে। মহাসাগরের মহাতল থেকে নিষিদ্ধ সৌরভে আশপাশটা ভরে যেতে থাকে। এ এক নিষিদ্ধ লোবান! সবাই এই ঘ্রাণে উদ্দীপ্ত হলেও রাহেলার জন্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সৌরভের শুরু প্রান্তেই ওর জন্য এক বিশাল সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছে, ‘নো-ট্রেসপাসিং!’

তাই থমকে যেতে-ই হয়। আর যখন-ই সে থেমে যায়, পেছন থেকে অতীত এসে ওকে ঘিরে ধরে। এক সুদর্শণ অনুভবে-কল্পনায় ওর সামনে দাঁড়ায়। কল্পনার চরিত্রটি তাঁর বাস্তব হাত দিয়ে রাহেলাকে ইচ্ছেমত ছুঁয়ে দিয়ে যায়! শীৎকারে চীৎকারে অনুভবের তীব্রতর কম্পনে একা এক সাগরতীরে এক যুবতী বেঁকে যেতে থাকে। আশেপাশে কোথায়ও কেউ নেই। আর থাকলেও এমন নিঃসঙ্গ পরিবেশে এক একেলা নারীর অসহায় মুহুর্তের সুবিধা না নেবার মত দৃঢ় মানসিকতার পুরুষ আজকাল কোথায় পাওয়া যায়? তবে রাহেলার এই মুডের গন্ডগোলের তীব্রতর সময়ে অযাচিতভাবে মেঘবালিকারা আবারো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। টানা বর্ষণে ক্রমশঃ শীতল হতে হতে একসময় সে বেলাভূমে বালির ওপর লুটিয়ে পড়ে। গলায় ঝোলানো মোবাইলে রিং হতে থাকে। একজন বাবা ফোন করেছেন তাঁর প্রিয় কন্যার খোঁজ জানার জন্য।

পৃথিবীর বৃহত্তম সাগরপারে অবিন্যস্ত লেপ্টানো পোষাকের নিচে এক হৃদয় আরেক হৃদয়ের ঘ্রাণে আপ্লুত হতে চেয়ে বিবশ হতে থাকে। চেতনা লুপ্ত হলেও ভেতরের প্রাণ তো আর লুপ্ত হয় না। তাই বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে এক হৃদয়… ভিজতে থাকে ভিতরে বাহিরে সব দিকেই.. সব ভাবে।

#ঘ্রাণ_অণুগল্প।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৮-০৯-২০১৭ | ১২:২৬ |

    প্রচ্ছদ এবং লিখা দুটোই পরস্পরের উপযোগী মনে হলো। অভিনন্দন মি. মামুন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. আলমগীর কবির : ১৮-০৯-২০১৭ | ১৪:৪০ |

    লেখাটা পড়ে সত্যিকারেই সাহিত্য মনে হয়েছে।

    GD Star Rating
    loading...