আমাদের সবার একটা আনন্দময় শৈশব আছে। আমারও রয়েছে। নিচের দীর্ঘ লেখাটি পড়লে, আমার এবং আমার সমবয়সীদের শৈশব কেমন ছিলো, জানা যাবে।
বেশ দীর্ঘ লেখাটি। তাই পড়তে গিয়ে বিরক্ত হতে পারেন।
________________________________
” ছায়া ফেলে যায় তবুও নি:সময়
তারই মাঝখানে লহমার এই দেখা
একার সঙ্গে মুখোমুখি হল একা।” ১
সবার মাঝে থেকেও কখনো কখনো বেশ একা লাগে। সেই একাকীত্বকে কাটাতে কত কিছুই না করা। ইচ্ছেঘুড়ি শত সহস্র আলোকবর্ষ ঘুরে আসে, তবুও ঘুচে না নিঃসঙ্গতা। কারণ সেই ঘুরে আসাটা থাকে বর্তমানকে সাথে নিয়ে কেবলি সামনের দিকে। তাই অতৃপ্তি ঘুচে না। তখনি হৃদয়ের গহীন কোণ থেকে ডাক শুনতে পাই-
‘ তোমার কিসের অভাব খোকা?
ইচ্ছে হলেই পাও কাছে সব
জুঁই জোনাকি পোকা।
তোমার আছে সবুজ পাহাড়
ফুলের বাহার, নদী-
তোমার বুকে যাক না বয়ে
জোয়ার নিরবধি।’ ২
মুহুর্তে এই বুড়ো খোকা মাইকেল জে ফক্স হয়ে ফিরে যায় সোনালী অতীতে- হিরণ্ময় অতীত- হীরার কুঁচির মত জ্বলজ্বলে আমার শৈশব সকল অতৃপ্তি মিটাতে আমাকে কাছে টেনে নেয়! যদিও এই ডিজিটাল যুগের নিরিখে সাদা-কালো ক্যানভাসে অনেকটা বিবর্ণ আমার শৈশব! দেখা যাক, কেমন ছিল সেই ক্যানভাস…
শৈশবের প্রথম স্মৃতিঃ
কোথায় যেন পড়েছিলাম, এল এস ডি নামের একটি ড্রাগ রয়েছে, যা সেবনে হ্যালুসিনেশন এর প্রভাবে মানুষ তার মাতৃগর্ভের স্মৃতিকে পর্যন্ত মনে করতে পারে। আমার কাছে এটি অবাস্তব মনে হয়। আমি আমার চেতনায় শৈশবের প্রথম স্মৃতি যা দেখতে পাই, সেটি আমার দাদা বাড়ির ঘটনা। আমি আমার চাচার কোলে… তন্ময় হয়ে দেখছি আগুনের লেলিহান শিখা। রাতের বেলা… দাদা বাড়ির পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে… আকাশ ছুঁতে চাওয়া আগুনের শিখাগুলির প্রলয় নৃত্য সেদিনের এক শিশুর মানসপটে আজো ভেসে বেড়ায়। নিজেকে এতো শক্তিধর ভাবা মানুষ, কিছু প্রাকৃতিক ভৌত বস্তুর সামনে কিভাবে অসহায় হয়ে আত্মসমর্পণ করে, সেদিন আমার অবচেতন মনে গেঁথে গিয়েছিল।
নানা বাড়ির স্মৃতিঃ
জীবনের একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ে চাকরির সুবাদে আমার আব্বা খুলনায় একটি মেসে থাকতেন। আমি আম্মার সাথে নানা বাড়িতে। জীবনের মধুর সময়গুলো আমার সেখানেই কেটেছে। হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রাম। পটে আঁকা ছবির মত। প্রাচীন জমিদারদের মত সিমেন্টবিহীন লাল ইটের চুনামাটির প্রলেপে বানানো একটি বাড়িতে আমার জন্ম। সেই ইটগুলো জায়গায় জায়গায় গাঁথুনির চুনা ঝরে যাওয়াতে ফোঁকর দৃশ্যমান ছিল। সেই ফোঁকরগুলো আরো গভীর করাতে আমার প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। আজ আমার ছোট বাবুকে দুষ্টুমি না করার জন্য যখন উপদেশ দেই, আড়ালে থেকে আমার শৈশবের সেই ‘আমি’ আমাকে মুখ ভেংচায়।
দিনভর খালের পাড়ে মাটির প্রধান রাস্তায় অন্যান্য খালাতো-মামাতো ভাই বোনদের সাথে খেলায় খেলায় কাটত। কত রকমের খেলা যে ছিল। কিছু কমন খেলার ভিতরে রান্না-বান্না, পুতুলের বিয়ে আর দোকানদারি করার
খেলাটাই বিশেষভাবে মনে পড়ে।
তখনো সাঁতার শিখি নাই। কিন্তু তাতে কি? খালে যখন ভাঁটা থাকে, তখন দলবেঁধে সবাই নেংটো হয়ে কাদা পেরিয়ে তাল গাছের ঘাটলার সর্ব শেষ ধাপে অবস্থান নেই। কোমর সমান পানিতে হাবুডুবু খাবার সেই নষ্টালজিক অনুভূতির কাছে, এখনকার সকল অনুভূতিকে তুচ্ছ মনে হয়। আজ ইট পাথরের নগর জীবনে পার্কের স্লিপারে আমার কন্যাদের যখন আমোদে মেতে উঠতে দেখি, তখন খালের পাড়ে নিজেদের তৈরী মাটির স্লিপারে নগ্ন ‘আমি’র উচ্ছলতাকে মনে পড়ে। পানি ছিটিয়ে ঢালু খালের কর্দমাক্ত সেই প্রাকৃতিক স্লিপারে যে আনন্দ পেয়েছি, আজ আমাদের সন্তানেরা কল্পনায়ও আনতে পারবে কি? ভাটার সময় খালের কাদার ভিতরে ‘ডগরা’ মাছ ধরার সেই আনন্দঘন মুহুর্ত বড্ড মিস করি। এখনকার হাজার টাকা দিয়ে টিকেট কিনে পুকুরে হুইলে মাছ ধরার আনন্দ শৈশবের সেই হাত দিয়ে মাছ ধরার তুলনায় বড্ড পানসে লাগে।
নানাবাড়ির অন্দর মহলের পুকুর ঘাটটিও আমাকে বেশ টানত। সেখানে তিন মামার জন্য আলাদা তিনটি ঘাটলা ছিল। মহিলাদের জন্য একেবারে ঘেরা। সেই লাল ইটের পলেস্তারাবিহীন ঘাটলাকে আমার কংকালের মত দাঁত বের করা হাসিমুখ মনে হত। আসলে এখনকার সময়কে যদি আধুনিক ধরা যায়, তবে আমার শৈশবে তখন নানাবাড়ির জৌলুস ভগ্নপ্রায় প্রাচীনতাকে ধারণ করে মধ্যযুগে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
আমার হাতে খড়িঃ
আমার হাতে খড়ি হয়েছিল আমার নানার হাতে। তখন কালো স্লেটের চল থাকলেও তাল পাতার চিকন ফালি করা খাতায় বাঁশের কলম কয়লা গুড়ো করে বানানো কালিতে চুবিয়ে লিখতে হত। আর এক টুকরো কাপড় রাখা হত কালির লেখা মুছবার জন্য। এখন যে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে কিংবা কিন্ডারগার্টেনে সবাই বি-সিরিয়ালের রেডিমেড সুদৃশ্য পেন্সিলের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত, আমাদের সময়ের সেই বাঁশের কলম দিয়ে তালপাতায় লেখার সুখানুভূতি কি আদৌ পাওয়া সম্ভব? একটা ছোট হোগলার মাদুর সাথে নিয়ে যেতাম টো্লে। একজন হিন্দু পন্ডিতমশাই ছিলেন আমাদের সকল শিশুদের একমাত্র শিক্ষক। সেখানে আমার আসল হাতে খড়ি বেশ জাকজমকের সাথে হল। তখন এই বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে বাতাসা, খই, চিড়া ভাজা ছিল প্রধান উপকরণ। অন্যান্য ছাত্ররা সবাই মিলে একসাথে এক মহাউৎসব পালন হত। আমরা মাটিতে মাদুর বিছিয়ে লেখাপড়া করতাম। ওহ! সেই দিনগুলি!!
প্রতিদিন সকালে ফজরের সময়ে উঠে নানার কাছে আরবি শিখতাম। এরপরে আদর্শলিপি থেকে নানা আমাদের সকল ভাই-বোনদেরকে মুখস্ত করাতেন খুবই কমন কিছু কবিতা-
” সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন যেন আমি ভাল হয়ে চলি।”- কিংবা
” পারিব না একথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার।”- অথবা
” পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো
কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল”- কি বন্ধুরা, মনে পড়ে? [আমার সমবয়সী যারা তাদেরকে বন্ধু সম্বোধন করেছি]
তখন গ্রামে চাষাবাদ-ই ছিল একমাত্র জীবিকা। অনেক কামলা কাজ করত। তাদেরকে সকাল বেলা এক গামলা পান্তা ভাত অবাক বিস্ময়ে খেতে দেখতাম! লাল আউশ চালের ভাত সরিষার তেল, পিয়াজ এবং পোড়া মরিচ ডলে ভাতগুলোকে আরো লাল করে ফেলে তাদের সেই তৃপ্তিকর খাবার দৃশ্য এখনো আমার জিভে জল এনে দেয়! আর দায়ে কাটা তামাক চিটা গুড় সহযোগে হুক্কায় দম দেবার এবং হুক্কার নারিকেলের খোলে পানির ভিতর থেকে বের হওয়া সেই অদ্ভুত শব্দ এখনো কানে বাজে [যদিও হুক্কা পান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তাই বিষবৎ পরিত্যাজ্য]
আর একটি জিনিস উল্লেখ করে এই পর্বের ইতি টানবো। ধান কাটার মওশুমে ধান কাটা হয়ে গেলে কিছু ধান মাঠে পরে থাকতো। ছোটরা দলবেঁধে সেই ধান টোকাতে যেতাম। এতোটা দুষ্টু ছিলাম যে, অনেক সময় ক্ষেত থেকে ধান গাছের উপরের শীষ কেটে নিয়ে যেতাম। যদিও এখন বুঝি যে, সেই কাজটি ছিল এক ধরণের চোর্য্যবৃত্তি। তবুও কি এক উদ্দাম নেশায় সেই কাজটিও সকলে করতাম। এ ছাড়া ইদুরের গর্ত থেকেও ওদের জমানো ধান বের করে নিয়েছি। এই কাজটি অনেক বিপদজনক ছিল। প্রায় ইঁদুরের গর্তেই সাপ থাকার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সময়ে ভয় ডর বলে কিছু ছিল না। এই জমানো ধান চলে যেতো ভ্রাম্যমান খই, মুড়ি-মুড়কি বিক্রেতার ঝোলায়। এরা ধান কাটার সময় এলে বাড়ি বাড়ি এসে ওদের জিনিসগুলোর পরিবর্তে ধান নিয়ে যেতো। এখানেও নানীর গোলা থেকে ধান চুরি করে এনে কত মোয়া নিয়েছি। আজ নিজেকে বড্ড চোর মনে হচ্ছে। কিন্তু সেই সাথে কি একটুও আফসোস হচ্ছে না? থেকে থেকে কি মনটা আবারো সেই ‘না বলে নেয়ার’ মুহুর্তগুলিতে ফিরে যেতে চাচ্ছে না? হৃদয়ের তন্ত্রীতে কেবলি বেজে উঠছে ওয়ারফেজ এর সেই গানটি-
“… আজো ভুলিনি সেই দিনগুলি
মনে পড়ে যায় আবারো ফিরে আসে…”
… …
দাদা বাড়িঃ
আমার ছেলেবেলায় বেশীরভাগ সময়ই নানা বাড়িতে কেটেছে। তবে দাদা বাড়িতেও অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে। নানা বাড়ি থেকে সেই সময়ে দাদা বাড়ি যাতায়াতের বেশ ঝক্কি ছিল। তখনকার বাসগুলো ছিল মুড়ির টিনের’ মত। এগুলোকে স্টার্ট দিতে এক ধরণের লম্বা হ্যান্ডেল ব্যবহার করতে হত, যেটি বাসের বাহির দিয়ে একেবারে সামনের একটি ছিদ্রতে ঢুকিয়ে ক্লক-ওয়াইজ ঘুরালেই তবে স্টার্ট হত। আর যাতায়াতের অনেকটা পথ নৌকায় করে বিষখালি নদী দিয়ে যেতে হত। আব্বা আমার ছেলে বেলায় একটি লোহার চেয়ার তৈরী করিয়েছিলেন, নৌকার দুলুনিতে যাতে আমি ভারসাম্যহীন হয়ে না পড়ি, তাই সেই চেয়ারে বসিয়ে আমাকে একটি বেল্টের সাথে আটকে রাখতেন। আজ ৪৩ বছর ধরে সেই চেয়ারটি আমার কাছে সযতনে রয়েছে!
দাদাকে আমার আম্মাও দেখেন নাই। আর দাদীর স্মৃতি খুব অল্পই মনে আছে আমার। আমরা দাদা বাড়ি গেলে তিনি আমার এক চাচাকে পুকুর থেকে খেজুর এর ছড়া তুলে এনে আমাকে দিতে বলতেন। গাছ থেকে খেজুর ছড়া সহ কেটে পাকাবার জন্য পুকুরে ভিজিয়ে রাখা হত। আর আজ কার্বাইডের বিষাক্ত ছোবলে কোনো ফলই খাবার উপায় নেই। দাদীর কথা আমার এটুকুনই মনে আছে।
আমার প্রথম দুর্ঘটনাঃ
তখন গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিলনা। হারিকেন, কেরোসিন কুপি যাকে আমরা ল্যাম (আসলে হবে ল্যাম্প) বলতাম আর কোনো অনুষ্ঠানের সময় হ্যাজাক বাতি ব্যবহার করা হত। এই ল্যামের সলতের পোড়া অংশ কিছুটা স্ফীতাকারে দলা হয়ে থাকত। এগুলোকে আমরা ছোটরা বলতাম ফুল। এই ফুল খেতাম। একদিন আব্বার এক দূর সম্পর্কের ভাই, মেনহাজ নাম ছিল ওনার, তিনি দাদা বাড়ি অবস্থানের সময় আমার দেখাশোনা করতেন; তিনি বললেন, ‘ এই ফুল না খাইয়া কেরোসিন খা’। তিনি আসলে রসিকতা করে বলেছিলেন। কিন্তু শিশুদের সাথে এমন কোনো বিষয় নিয়ে রসিকতা করাটা যে কতটা বিপদজনক, তিনি সেদিন সেটি বুঝেছিলেন। আজ ভাসা ভাসা মনে পড়ে, তার কথামত ল্যামের ভিতরের সবটুকু কেরোসিন আমি খেয়ে ফেলেছিলাম। এরপরের ঘটনা অনেক উদ্বেগজনক। সেই সময়ে প্রত্যন্ত গ্রামে আশেপাশে কেন, বহুদূর পর্যন্ত কোনো ডাক্তার ছিল না। মুরব্বিদের হাতুড়ে চিকিৎসায় আর পরম করুনাময়ের অশেষ রহমতে আমি সুস্থ হতে পেরেছিলাম।
আর একটি স্মৃতি মনের মুকুরে দোলা দিয়ে যায়। তখন দেশীয় প্রজাতির মাছে হাওড়,খাল-বিল সয়লাব ছিল। সেগুলোর স্বাদ যেমন ছিল, তাদের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। বর্ষা মওসুমে দাদা বাড়ির সামনের ধানি জমিগুলো বিলে পরিণত হত। তখন সেখানে হরেকপদের মাছে টইটুম্বর করত। আমার আরো এক চাচার নাম ছিল ‘চান মিয়া’। আমরা ডাকতাম চান্দু কাক্কু বলে। তিনি আমাকে নিয়ে নৌকায় করে সেই বিলে কই মাছ ধরতে যেতেন। যাবার সময় আম্মা বড়শিতে দোয়া পড়ে ফুঁক দিয়ে দিতেন, যাতে বেশী বেশী মাছ ধরা পড়ে।
নগরজীবনে প্রবেশঃ
আব্বার পোষ্টিং তখন ছিল খুলনায়। তিনি আমাদেরকে সেখানে নিয়ে এলেন। আমার আর একটি ভাই তখন পৃথিবীতে এসেছে। মাছুম, আমি আর আবা-আম্মা- এই চারজনের নগরজীবন শুরু হল। তখন তো আর নগরজীবন এতো জটিল এবং সবুজবিহীন কংক্রিটের হয়ে উঠেনি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমল তখন। আমরা খুলনার খালিশপুরের এক ভাড়া বাসায় উঠে এলাম।
এখানেই আমার জীবনের প্রথম বন্ধুর দেখা পেলাম।
সে একজন মেয়ে ছিল। রুপা তার নাম। আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, তার ঠিক সামনেই ছিল ওদের বাড়ি।সুদৃশ্য দোতলা বাড়ি। আর আমরা থাকতাম একটি টিনশেডের ভাড়া বাসায়।সেখানে আরো দুটি পরিবারও থাকতো। তো এহেন সামাজিক মর্যাদার বিস্তর ব্যবধান স্বত্বেও আমি আর রুপা বন্ধু হয়েছিলাম। বিকেলে রুপার ভাই এবং তার অন্য বন্ধুদের সাথে আমিও খেলতে যেতাম। রাবারের টেনিশ বল দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় আমরা খেলতাম। আর যখনই বলটি ড্রেনে পরে যেত, রুপার ভাই মুন্না আমাকেই বলটি তুলে আনতে বলত। আমি যে ছিলাম সেই সময়ে সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে সব থেকে নিচুতে। আমি তুলে আনতাম, আর মনে মনে ভাবতাম, সব সময় আমাকেই কেন তুলে আনতে বলে? রুপা কষ্ট পেত। একদিন সে সরাসরি বলেই ফেলল, তুই আর বল তুলে আনবি না।’ সেই ছেলেবেলায়ই শ্রেণী বৈষম্য আমার চেতন মনে না বুঝেই ধরা দিয়েছিল… আর রুপাই আমাকে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিল। জানি না আজ এই বন্ধুটি কোথায় আছে, কেমন আছে!
এখানে বেশ বড় একটি দিঘী ছিল। অনেক দূর পর্যন্ত তার শান বাঁধানো ঘাটলা পানির গভীরে নেমে গেছে। আমি বিকেল বেলা অন্যদের সাথে ঝাপাঝাপি করতাম। আম্মা ছোট ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমার খোঁজখবর তেমন নিতে পারতেন না। আব্বা পাঁচটায় অফিস থেকে এসেই আমাকে না পেয়ে পুকুরে চলে যেতেন। অফিসের কাছেই আমাদের বাসা ছিল। আমাকে পুকুর থেকে ধরে বাসায় নিয়ে আসতেন। আমার চোখ লাল হয়ে থাকতো। এটা দেখে আব্বা প্রচন্ড রাগ হতেন। আমাকে ‘মাইরও’ দিতেন বেশ করে। তারপরও প্রতিদিন একই সময়ে পুকুরে না ডুবালে কেন জানি শান্তি পেতাম না। আর আব্বার সামনে যাতে লাল চোখ নিয়ে যেতে না হয়, সেজন্য জলকেলির এক পর্যায়ে দুহাতে পানি নিয়ে অন্যজনকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘ লাল না সাদা?’ অপরজন সব সময় সাদা-ই বলত। আর পরক্ষণেই সেই ‘সাদা পানি’ দিয়ে নিজের চোখে ঝাপটা দিতাম। আর মুহুর্তেই চোখ সাদা হয়ে যেত। আমাদের কচি হৃদয়ে সেই সময়ে এমনটি-ই আমরা ভাবতুম। কিন্তু তারপরও কেন যেন চোখ লাল এর জন্য আব্বার ‘মাইর’ থেকে রক্ষা পেতাম না।
এখান থেকে বাসা বদল করে আমরা খুলনার রায়ের মহলে চলে এলাম। এখানে এসে আমার দুরন্তপনা আরো বেগবান হয়েছিল। কলা পাতাকে ঘোড়ার কেশরের মত দু’পাশে ছিড়ে বানিয়ে সেটিকে ঘোড়ায় পরিণত করে তাতে চড়ে দিনভর রায়েরমহলের মাটির রাস্তায় দৌড়ে বেড়াতাম। এখানে এই এলাকায় তখন ঘোড়া দিয়ে মালামাল টানার কাজটি করা হত। গরুর গাড়ির বদলে ঘোড়ার গাড়ির বহুল ব্যবহার ছিল। ঐ সময়টিতে আমি নিজেকে একটি ঘোড়া ভাবতাম।
আমার আনুষ্ঠানিক প্রথম স্কুল ছিল এইখানে। রায়েরমহল প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে আব্বা আমাকে একদিন ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা আমার জন্য সুখকর ছিল না। একজন মহিলা টিচার ক্লাশ নিতে এলেন। অন্য সকলকে পড়া জিজ্ঞেস করলেন, সাথে আমাকেও। আমার আজ প্রথম দিন! কিভাবে পারব? কিন্তু তিনি অন্য সবার সাথে আমাকেও কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। পরের পিরিয়ডে সোজা বাসায় চলে এলাম। আর গেলাম না ঐ স্কুলে। সেই ছিল আমার একদিনের জীবনের প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা। সব শুনে আব্বাও আর ওখানে যেতে জোর করলেন না।
গত কোরবানির ঈদে আমার মেয়েদেরকে নিয়ে সেই স্কুলটি দেখিয়ে এনেছি। সেদিন এতোগুলো বছর পরে যখন স্কুলের সামনে গেলাম, পুরনো সেই মুহুর্তগুলো কেন জানি এক অন্য আবেশে আমাকে আন্দোলিত করছিল…সেদিনের সেই বিব্রত মুহুর্তটি কেন জানি এক অনাবিল সুখের উচ্ছ্বাসে নিজেকে প্রগলভ করে তুলল। এক টুকরো অতীত যেন অন্ধকার ফুঁড়ে সহস্র সূর্যের আলোকমালায় সজ্জিত হয়ে মনের গহীনে সেই সুরটি-ই বাজিয়ে তুলল-
‘পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়…’
… …
শুধুমাত্র আমাকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য আব্বা রায়েরমহলের বাসা থেকে টুটপাড়া দেলখোলা রোডের আর একটি ভাড়া বাসায় শিফট হয়ে এলেন। আমাকে খুলনা সেইন্ট জোসেফস হাই স্কুলে ক্লাশ ওয়ানে ভর্তি করে দেয়া হল। নিরবচ্ছিন্নভাবে আমার স্কুল জীবন চলতে লাগল।
এই পর্বে বেশ কিছু নতুন বন্ধু হয়েছিল আমার। তাদের ভিতর দোলন ভাই এবং তার বোন চাঁপার সাথে বন্ধুত্ব টুকু একটু গাঢ় ছিল।
জীবনের প্রথম মুদ্রা চিনলাম এই সময়ে। তখন নতুন দশ পয়সার প্রতি আমার খুব লোভ ছিল। আমি এটিকে বলতাম রাঙা পয়সা। আব্বার কাছে এই ‘রাঙা পয়সার’ আব্দার করতাম। তিনি দিতেনও। তবে চাহিবা মাত্র দিতে বাধ্য থাকিবেন, এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।
আমার জীবনের প্রথম পোষা পাখি নিয়ে আনন্দ এবং কান্না করার যুগপৎ অভিজ্ঞতাও লাভ করি এই টুটপাড়ার বাসায়ই। আব্বা একদিন আম্মার জন্য একটি ময়না পাখি কিনে এনেছিলেন। আম্মা সেটির খুব যত্ন নিতেন। একটি বাঁশের তৈরী খাঁচায় কালো কাপড় দিয়ে ‘ওকে’ ঢেকে রাখা হত। আর কথা বলানোর জন্য আমাদের সে কি প্রচেষ্টা! এভাবে ছ’মাসের বেশী সে আমাদের চারজনের পরিবারের পঞ্চম সদস্য হিসাবে বেঁচে ছিল।
একদিন ময়নার শেষ সময় উপস্থিত হল। আমার আজো স্পষ্ট মনে আছে সেই বিকেলটির কথা। বাসার ছাদের ওপর আম্মা মৃত ময়নাটিকে ছাদের মেঝেতে রেখে আলতো করে হাত দিয়ে ছুঁয়ে আছেন। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা… প্রচন্ড বাতাসে আম্মার চুলগুলো উড়ছে…মৃত ময়নার শরীরের পশমগুলো ও… আম্মার দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে নীরবে জলধারা বহমান… আমিও কাঁদছি। এমন একটি বিকেল আমাদের মা-ছেলেকে বেদনায় আপ্লুত করে রেখেছিল দীর্ঘক্ষণ।
তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলের শেষ দিক। প্রায়ই প্লেন থেকে কাগজ ফেলা হচ্ছে। তখন কি আর রাজনীতি বুঝতাম? [ এখনো যে বুঝি, তাও কিন্তু নয়] ঐ কাগজের পিছনে আমি, দোলন ভাই আর চাঁপা দৌড়ে বেড়াতাম। প্লেনের পেট থেকে কি পড়ল, তাকে লাভ করার জন্য অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতাম সেই দিনগুলোতে!
জীবনের প্রথম টিকা দেয়ার ভীতিকর অভিজ্ঞতা লাভ হল এখানেই। তখন জোর করে ধরে হাতের উপরিভাগে ক্ষত করে যে চিকিৎসা সেবাটি দেয়া হত, তার প্রতি আমাদের শিশু সমাজে অনেক আতংক বিরাজ করত। মনে আছে, যন্ত্রনায় আব্বার কোলে বসে অনেক কেঁদেছিলাম।
আবারো জীবনে পরিবর্তন এলো আমাদের। আব্বা খুলনার ছোট বয়রাতে চার কাঠা জায়গা কিনে সেমি পাকা গোলের ঘর করে সেখানেই চলে এলেন। নিজেদের বাড়ি! বাসা থেকে আমাদের বাড়িতে উত্তরণ হলেও, আমার কচি হৃদয় এভাবে বার বার জায়গা বদলে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েছিল। পরিচিত মহল, চেনা বন্ধু এবং খেলার সাথীদেরকে ছেড়ে আসার কষ্টটা অনেক বেধেছিল হৃদয়ে।
এই এলাকাটি ছিল তখন জঙ্গলে পরিপুর্ণ। সবুজে সবুজে এমনভাবে ছেয়ে ছিল যে, দিনের বেলায়ও গা ছমছমে অনুভূতির উদ্রেক করত। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে একটি ইটের সলিং বিছানো পথ, এর দু’পাশে নতুন তৈরী হওয়া বাড়ি-ঘর। এভাবেই জায়গাটি জেগে উঠছিল। সেই নিজেদের বাড়িতে আমার তিন নাম্বার ভাই মাসুদ পৃথিবীতে এলো। খুব সুন্দর ছিল সে। এখনো সুন্দর। তাই ওকে সবাই ডাকতো হিরো। আমার দিন কেটে যেত এই ছোট ভাইটিকে ঘিরে।
নতুন এই জায়গাটিতে নতুন করে বন্ধু জুটিয়ে নিলাম। আমার সেই সব বন্ধুরা ছিল সবাই গরীব ঘরের। এদের সাথে আমাদের ভিতরকার শ্রেনী ব্যবধান ছিল, খালিশপুরে রুপাদের সাথে আমাদের যতটুকু ব্যবধান ছিল- সেরকম। আমি নাক দিয়ে অনবরত জল বেরিয়ে থাকা সেই সব ছেলেদের সাথে দিনভর খেলে বেড়াতাম। বেয়ারিং এর চাকা দিয়ে কাঠের তক্তার সাথে লাগিয়ে এক ধরণের গাড়ি তৈরী হত। অনেক পঙ্গু ভিক্ষুক এমন তিন চাকাওয়ালা গাড়িতে এখন ঘুরে বেড়ায়। আমি আমার শ্রমিক পরিবারের সেই বন্ধুদেরকে নিয়ে আমাদের ইটের রাস্তায় বেয়ারিং গাড়ি নিয়ে টইটই করে বেড়াতাম। কখনো আমি বসতাম, ওরা ঠেলতো; কখনো ওদের কেউ বসতো, আমি ঠেলতাম। আব্বার চোখে অনেকবার আমি ঠেলছি এই অবস্থায় ধরা পড়েছি। বাসায় এসে প্রচন্ড বকা শুনেছি, পরের দিন আবারো সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমার এই বন্ধুরা কখনো আমার বাসার পড়ার টেবিলটি দেখারও সুযোগ পায় নাই। সেই ছেলেবেলা থেকেই আমি শ্রমজীবি মানুষের কাছে থাকতে ভালোবাসতাম। আল্লাহপাক সেজন্যই বুঝি বা আজ আমাকে শ্রমিকদের কেন্দ্র করেই কাজ করার জন্য নির্বাচিত করেছেন।
রাস্তা থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট টোকাইদের মত করে টোকাতাম। চাড়া (ভাংগা মাটির পাত্রের টুকরা) দিয়ে তাস খেলার জন্য। এই খেলাটি আমার খুব নেশার মত ছিল। গোল্ড ফ্লেক নামের সিগ্রেটটির মান সবচেয়ে বেশী ছিল। কিছুটা লম্বাটে হলুদ রঙের এই প্যাকেট রাস্তায় কিংবা ময়লা আবর্জনার ভিতরে দূর থেকে দেখলেই আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হত। কে কার আগে নিবে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলত, এই প্যাকেটটির মান ছিল ১০০০। আর একটি প্যাকেট যেটি কে-টু নামে পরিচিত, এর মান ছিল ৫০০।
মার্বেল খেলতাম রাস্তার পাশে বসে। দু’ভাবে খেলা হত। আঙটি মাইর এবং খচা। আঙটি মাইর খেলায় নির্দিষ্ট একটি মার্বেলে লাগালেই সেটি যে লাগাতে পারত তার হয়ে যেত। আর খচা সিষ্টেমে অনেক মার্বেল একটি নির্দিষ্ট দাগের ওপারে ফেলতে হত। এরপর সেখান থেকে একটিকে লাগানোর জন্য নির্দিষ্ট করে মারতে হত। ঐ নির্দিষ্টটি ছাড়া অন্য কোনো মার্বেলে লাগলেই ‘ডিসকোয়ালিফাইড’ হয়ে যেত। এই খেলাটিতে অনেক মার্বেল লাগতো। কুলায় করে কয়েশ’ মার্বেল মেরেও খেলেছি আজ মনে পড়ছে।
আর একটি বিপদজনক খেলা খেলতাম। সেটি ছিল ডাংগুলি। এটি অভিভাবকেরা আমাদেরকে সহজে খেলতে দিতে চাইতেন না। এই খেলা খেলতে গিয়ে অনেকের চোখ নষ্ট হয়েছে।
লাটিম ঘুরানো একটি আর্টিষ্টিক খেলা হলেও, এটি নিয়েও প্রতিযোগিতা চলত। অভিভাবক মহলে এই খেলাটির প্রতিও কিছুটা বিধি-নিষেধ জারি হয়েছিল। তবে আমাদের দেশের ধুমপানের বিরুদ্ধে প্রনীত আইনের প্রয়োগ এর মত ছিল সেই নিয়ম-কানুন। আমরা মোটেই মানতাম না। রঙ বেরঙের মার্বেল কিনতে বাসের পিছনে ঝুলে ঝুলে বয়রা থেকে খালিশপুর পর্যন্ত চলে যেতাম। বিনে ভাড়ায় এভাবে ভ্রমন ছিল আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। যদিও এটি খুব-ই রিস্কি ছিল।
সব চেয়ে মজার খেলা ছিল জঙ্গলের ভিতরে টারজান টারজান খেলা। নিজেকে টারজান ভাবতাম। একটি কাঠের ছুরিও বানিয়ে নিয়েছিলাম। আর টারজানের ছবি আঁকতে পারতাম একটানে। সেই ব্যাক ব্রাশ করা চুলের ছবির টারজান আমাদের শিশুমনে দীর্ঘদিন রাজত্ব করে গেছে।
তখন এলাকায় মাত্র একটি বাসায় টেলিভিশন ছিল। প্রতিদিন বিকেলে সেই বাসার জানালায় দাঁড়িয়ে কার্টুন ছবি দেখতাম। সেজান, ক্যাপ্টেন স্কার্লেট (এই নামটি ভুলও হতে পারে)। আর নতুন কুঁড়ির আসর, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, দ্য বায়োনিক ওম্যান এগুলো না বুঝেই দেখতাম।আব্বা এভাবে মানুষের বাসার জানালায় দাঁড়িয়ে টেলিভিশন দেখা পছন্দ করলেন না। তিনটি রিক্সা ছিল আমাদের, ভাড়ায় খাটত তখন। সেগুলো বিক্রি করে একদিন নতুন টেলিভিশন কিনে আনলেন। সেদিনের আনন্দের কথা লিখে আর কি প্রকাশ করব!!!
আমাদের বাড়ির পায়ে হাঁটা দূরত্বেই ছিল রেডিও অফিস। সেখানে যেতাম ছড়া বলবার জন্য। অন এয়ার সেই অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে…”আপা, আমি একটি ছড়া বলব… আমার ছড়ার নাম… লিখেছেন…”- বাসায় কতবার যে প্র্যাকটিস করেছি! যেভাবে ভুলতে পারিনা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে স্কুল থেকে গিয়ে বিব্রত হবার ঘটনা। তখন ক্লাশ ফোরে পড়ি। কবি আল মাহমুদের নোলক কবিতা ছিল ঝাড়া মুখস্ত। ষ্টেজে উঠে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে প্রথম লাইনটি বলেই আর দ্বিতীয় লাইন মনে আসলো না…।
টেলিভিশন আসার আগে বিনোদনের কাজটি ছিল মূলতঃ রেডিও তে দুর্বার আর ছায়াছবির গান শুনে শুনে। আজও দুর্বার অনুষ্ঠানটি শুনলেই সেই ছেলেবেলার মুহুর্তগুলোই কেন জানি মনে পড়ে যায়। আর ছায়াছবির গানের ভিতরে বদনাম ছবির প্রয়াত জাফর ইকবালের গলার সেই ‘হয় যদি বদনাম’ গানটি সেই যে হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল, আজো চির ভাস্বর- চির উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। আর তুফান সিনেমাটির গানগুলোর কথাও কেন জানি মনে রয়ে গেছে।
রিক্সার পিছনে ঝুলে ঝুলে বৈকালি সিনেমা হলে [এখন এই সিনেমা হলটি আর নেই] যেতাম থার্ড ক্লাশে ছবি দেখতে। সিনেমা দেখাকে আমরা বলতাম বই দেখা। ৭৫ পয়সা ছিল একজনের থার্ড ক্লাসের টিকেটের দাম। দুই টাকা যোগাড় করে দুই বন্ধুর টিকেটের টাকা হয়েও ২৫ পয়সার বড় পিয়াজু খেতে পারতাম ইন্টারভ্যালের সময়ে। ফিরতি পথ আবারো রিক্সার পিছনে ঝুলে ঝুলে, না হয় পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরা।
ঐ সময়ে কালো কুচকুচে রঙের একটি পুরনো আমলের অ্যানালগ টেলিফোন ছিল আমাদের বাসায়। আব্বা ছোট্ট একটি তালা দিয়ে রাখতেন। আজ মনে পড়ছে এই সেটটির কথাও।
বিশ্ব রাজনীতি তখন পাকিস্থানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসি রদ করা নিয়ে জেনারেল জিয়াউল হকের কাছে চাপ প্রয়োগ আর অনুরোধ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। আব্বা প্রতিদিন ইত্তেফাক পেপার নিয়ে আসতেন। সেখান থেকে পড়ে আমাদেরকে শুনাতেন প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভুট্টোকে অবশ্য পরবর্তীতে ফাঁসি-ই দেয়া হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে বছর নিহত হলেন, আমি তখন হাফ প্যান্ট পরে রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াই। এক সকাল বেলা শুনি রেডিওতে কোরআন তেলাওয়াত হচ্ছে। একটু অবাক হলাম। পরে জানলাম আমাদের প্রেসিডেন্টকে মেরে ফেলা হয়েছে।
অনেকেই ছোট্ট টিনের তৈরী লঞ্চ নিয়ে খেলেছে। যার নীচে তেল রাখার একটি কম্পার্টমেন্ট থাকতো। সেখানে আগুন ধরিয়ে দিলে লঞ্চের একেবারে নীচ দিয়ে ভিতরে রাখা পানি পিছন দিকে বের হত, আর লঞ্চটি সামনের দিকে এগিয়ে যেত। আমার এরকম একটি লাল রঙের লঞ্চ ছিল। আমি সেই সময়ে এই মডেলের একটি বড় লঞ্চ বানানোর স্বপ্ন দেখতাম। যাতে করে খুলনা থেকে একা একা আমি আমার নানা বাড়ি চলে যেতে পারি।
প্রথম ক্লাশ ফাইভে থাকতে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে নানা বাড়ি চলে গেছিলাম। বাসায় সবার সে কি চিন্তা। পরে আব্বা মটর সাইকেল চালিয়ে খুলনা থেকে খবর পেয়ে নানা বাড়ি চলে এসেছিলেন। সেই ছিল আমার প্রথম বাড়ি থেকে একটু অন্যরকম মুক্তির স্বাদ পেতে পলায়নের ঘটনা। এক বছরের ভিতর আমি এভাবে তিনবার পলায়নপর মনোবৃত্তি নিয়ে কাজ করেছিলাম। অবশ্য তার মূল্যও আমাকে আব্বার হাতে প্রচন্ড মাইর খাবার দ্বারা চুকাতে হয়েছিল।
আমার শৈশব শেষ হয়ে গিয়েছিল, যখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে চান্স পেলাম। ১৯৮৪ ইং সাল। ২১ তম ইন্টেক এর খায়বার হাউসের ক্যাডেট ছিলাম আমি। সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু সেখানে পাঠানোর দ্বারা আমার সোনালি অতীত- হিরন্ময় অতীত- আমার টারজান টারজান খেলার সেই মহামূল্যবান সময়কে জোর করে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল।
তবে সেখানেই বাপ্পী লাহিড়ির ‘সোনার অক্ষরে লেখা’ গানটি হৃদয়ে এতোটা বসে গিয়েছিল যে, আজ ও সেই আবেদন একটুও ম্লান হয়নি। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে কতবার যে চোখ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এসেছে… হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে… না লিখলেই মনে হয় ভালো হত। কেন ইচ্ছে করে হৃদয়কে ফেলে আসা স্মৃতির শাণিত কৃপাণে চিরে ফালা ফালা করা!!
এই ছিল আমার হীরার কুঁচিতে জাজ্বল্যমান সোনালী শৈশব, যা এখন হরিদ্রাভ বিষন্নতায় বিবর্ণ! আজ সকলের সাথে আমার অনেক না বলা স্মৃতি রোমন্থন করলাম। রুপালী আলোর জালে জড়ানো আঁধারের মত আমার শৈশব, আমার হৃদয়ে অজানা রাতের মত নীরবেই থেকে যেত; যদি না আজ ফেসবুকে প্রকাশ করতাম।।
#আমার_শৈশব_ফেলে_আসা_দিনের_স্মৃতি
১ ( কবিতাঃ দেখা, কাব্য গ্রন্থঃ হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ, কবিঃ শঙ্খ ঘোষ)
২ (রাশেদ রউফঃ বাংলাদেশের খোকা তুমি)
loading...
loading...
জীবন স্মৃতি গুচ্ছের সাথে নিজের জীবনের অতীতটাও এই সুযোগে মিলিয়ে নিলাম।
ভালো থাকবেন মি. মামুন। শুভেচ্ছা রাখি।
loading...
খুবই ভালো লিখেছেন।
loading...