রিজার্ভ ভালোবাসা (অণুগল্প)

কত সহজে মরে যাওয়া যায়?
মৃত্যুর কতগুলি পথ আছে ভাবতে থাকে। এর ভিতরে সব থেকে সহজ পথটি-ই সে বেছে নিবে। সুইসাইড করতে চাইছে সে। একটু আগে রেজার সাথে প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছে মিলির। রাগের মাথায় মিলি ও বাসা থেকে সোজা বের হয়ে এসেছে। এখন হাইওয়ে রোডের উপর এক ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে।

রেজা ওর হাজবেন্ড। আচ্ছা হাজবেন্ড না বলে বাংলায় বললে কি হয়? তাতে কি মেয়েদের জাত যায়? স্বামী… জামাই… পতি কিংবা ভাতার। একা একা হেসে উঠে মিলি। রেজাকে সে যদি সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘মিট মাই ভাতার, রেজা আহমেদ খান!’ তখন রেজার মুখের অবস্থাটা কেমন হতো? এই চিন্তাটিই ওকে হাসির পিঠে হাসি এনে দেয়। মিলি পাগলের মত হাসতে থাকে। আর তখুনি ওভারব্রীজের উপর দিয়ে এক মধ্যবয়ষ্ক লোক একা একটি মেয়েকে এভাবে হাসতে দেখে একটু ভড়কে যায়। রাস্তার পাগলও ভাবতে পারছে না… ওকে বুঝতে কয়েকবার মিলির পোশাকের দিকে তাকায়। শেষে ওর থেকে নিরাপদ দূরত্বে যেতে দ্রুত পা চালায়।

হাসতে হাসতে মিলির চোখে পানি চলে এসেছে। এই যে পানি চলে আসা- একে একটা নাম দিয়েছে মিলি। প্রি-প্লাবন পর্ব। এর পরের ধাপে রয়েছে সাইক্লোন পর্ব। চোখের পানি মুছে উপর থেকে নীচের দিকে তাকায়। দু’পাশ থেকে দ্রুতবেগে গাড়িগুলো ছুটে চলেছে। এখান থেকে এর যেকোনো একটির উপর আছড়ে পড়লেই তো হয়। তবে কোনোভাবে মিস করলে কোমরের হাড্ডি ভেঙ্গে সেইতো রেজার কাছেই ফিরে যেতে হবে।

আজ এক বছর হতে চললো ওদের বিয়ে হয়েছে। প্রেমের বিয়ে! সেই সময়টা কি যে এক প্রচন্ড ভালোলাগার আবেশে কেটে যেতো!! মুহুর্তগুলো প্রজাপতির ডানার সকল রঙকে শোষণ করে আরো রঙিন… বৈচিত্র্যময় এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। তার ভিতরে ওদের দু’জনের অবিরাম হাত ধরে ছুটে চলা। আর ছুটতে ছুটতে ধরে থাকা হাত কখন যে শিথিল হয়ে গেছে… কখনো সে পিছিয়েছে… কখনো রেজা। কিন্তু একজন আর একজনকে পিছিয়ে পড়ার সময়টুকুতে স্বেচ্ছায় পিছু ফিরে কাছে টানার চেষ্টা করেনি। সামনে দাঁড়িয়ে অন্যজনের পাশে আসার অপেক্ষা করেছে শুধু।

রেজা প্রথম প্রথম রাগ হলে নিজের মনে নিজে রাগ পুষে রাখতো। ধীরে ধীরে তা প্রকাশ করা শুরু করে। প্রথম দিকে এই প্রকাশ শালীনতার বাইরে না গেলেও সময়ের সাথে সাথে যেতে শুরু করে। মিলির আপত্তিটা ছিল ওখানেই। যা বলার তা যেন চার দেয়ালের ভিতরেই থাকে। কিন্তু সময় বয়ে যায়… রেজার গলাও চড়তে থাকে। একই বিল্ডিঙের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারাও এখন অনেক কিছু জানে।

আজও রেজার প্রচন্ড গালিগালাজ শুনতে শুনতে কীভাবে যেন মিলির মাথার তার ছিড়ে গেলো। ওর কথার জবাব না দিয়ে সোজা বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে। মোবাইলটা অবশ্য সাথে নিয়ে এসেছে। মোবাইলটা না আনলে কি ক্ষতি ছিল? সে তো মরতেই এসেছে। মরে যাবার পরে মোবাইল সাথে থাকলে কি আর না থাকলেই কি? তবে কি মিলির মনের কোনো একটা কোণায় রেজার জন্য ভালোবাসাতা সেই আগের মতই রয়েছে গেছে? রেজা ওকে ফোন করবে… ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে মৃত্যুর কাছে থেকে… এজন্যই কি সাথে মোবাইলটা সাথে রাখা?

কিন্তু রেজা তো একবারও ফোন করলো না। কি ভেবে গলায় ঝোলানো মোবাইলের ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে। স্ক্রীণে চোখ বোলাতেই প্রশান্তির একটা পরশ মিলির সারাদেহে বয়ে গেলো। SIM A: 9 missed calls ভেসে উঠলো ওর চোখে। বাটন চাপতেই রেজার পরিচিত নামটি চোখে তৃপ্তি এনে দিলো। কোথা থেকে যেন রাজ্যের অভিমান ভালবাসার কোলে চড়ে ওর চোখে সরাসরি প্লাবন পর্বে রূপ নেয়। কিছু সময় আগের তিক্ত কিছু মুহুর্ত নিমিষেই হারিয়ে যায় মনের ভিতরে রেজার জন্য রিজার্ভ করে রাখা কিছু প্রচন্ড ভালবাসার দ্বারা। সবারই কিছু না কিছু ভালোবাসা দুর্দিনের জন্য রিজার্ভ করে রাখা দরকার।কি জানি কখন কাজে লেগে যায়।

ওভারব্রিজের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মিলি নিজেকে জিজ্ঞেস করে, ‘ তুই না মরতে এসেছিস? ফিরে যাচ্ছিস যে বড়?’ নিজের কাছে একটু লজ্জাও পেলো। তবে এক কথায় তো আর ফিরে যাওয়া যায় না। কিছু একটা উছিলার প্রয়োজন ও রয়েছে। তাই মিলি বলে, ‘ মরার সময় কি শেষ হয়ে গেলো নাকি? এক সময় মরে নিলেই হবে।’ বাসার পরিচিত রাস্তার শুরুর মুখে এসেই আবার মিলি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, ‘ রেজার কাছেই যাচ্ছিস কেন? ওর সাথে না সম্পর্ক শেষ করে এলি? আবার ওর কাছে ফিরে যাবি?’

মিলি কোনো কিছু না ভেবেই বলে, ‘ রেজার কাছে কে ফিরে যাচ্ছে? আজ সোমবার না! স্টার প্লাসে ‘সাথ নিভানা সাথিয়া’ তে গোপি বহুর সিরিয়াল কোনোভাবেই মিস করা যাবে না। ‘ নিজেকে এভাবে প্রবোধ দিয়ে মিলি রেজার কাছে ফিরে যায়। বুকের ভিতর ভালবাসার ফল্গুধারা উদ্দাম নৃত্য করছে। সামান্য সময়ের জন্য দূরে থেকে মনে হচ্ছে কত যুগ যেন সে রেজার থেকে দূরে রয়েছে।
————————————————————————-

.
বন্ধুরা, এটা কোনো গল্প নয়। আমাদের সবার জীবনেই এরকম ঘটনা অহরহ ঘটেই চলেছে। তাই দাম্পত্য জীবনে সংঘর্ষ এড়ানোর সরাসরি কোনো পথ আসলে নেই। ওটা হবেই। তবে আমরা যদি নিজেদের হৃদয়গভীরে আমাদের পার্টনারের জন্য কিছু ভালোবাসা রিজার্ভ রাখি, তবে সংঘর্ষের সময়গুলিতে এই ভালোবাসা আমাদের সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখবে। আমি অনেকবার দেখেছি… একজন মেকুরের সাথে একজন মেকুরানীর এ জীবনে টুকটাক অনেকবারই তো সংঘর্ষ হলো… তবে প্রতিবারই রিজার্ভ ভালোবাসা তাদেরকে আরো কাছে এনে গভীর প্রণয়ে জড়িয়েছে। জীবনের মানে শিখিয়েছে… দূরে থেকেও কাছে থাকা শিখিয়েছে… আরো অনেক কিছু শিখিয়েছে…।।

#রিজার্ভ_ভালোবাসা_অণুগল্প_২৮১

*ছবি: নেট থেকে কপি করা।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৩-০৭-২০১৭ | ১৯:০৯ |

    দাম্পত্য জীবন অথবা পারিবারিক জীবনের অনেক ঘটনা আপনার লিখায় ইতিপূর্বেও উঠে এসেছে। জীবনের স্বাদ বা আস্বাদ বৃত্তাবদ্ধ এই জীবনকে ঘিরেই। জীবন একটাই।

    নিত্যদিন কত শত কথা থাকে আমাদের। শব্দ বা ফরমেটে তুলে আনাই হচ্ছে প্রতিভা।
    গল্পের উপলব্ধিটুকু গ্রহণ করলাম মি. মামুন। অনন্য এবং অসাধারণ। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  2. আনিসুর রহমান : ১৩-০৭-২০১৭ | ১৯:২৭ |

    রিজার্ভ ভালোবাসাটুকুই বোধ করি আসল ভালোবাসা । আর রিজার্ভের বাইরেরটুকু ভালোবাসার অলংকার ।
    ভীষন ভালো লাগলো গল্পে জীবন কথন ।

    GD Star Rating
    loading...