একে তো প্রচন্ড গরম। তার ওপর বাসে প্রচন্ড ভিড়। ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসতেই বাস থেকে নেমে এলো আসাদ। প্রচন্ড জ্যাম। বাসগুলি একইদিকে তিনটা লাইন করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। বিপরীত দিক দিয়ে যে অন্য যানবাহনগুলি আসবে, সে পথও রাখেনি। তাই কোনো দিক দিয়েই কোনো গাড়ি আসা-যাওয়া করতে পারছে না। সন্ধ্যা নেমে এসেছে বেশ কিছু আগেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনো তারা দেখতে পেল না। আজ আকাশের ও মন খারাপ। কেমন গুমোট হয়ে আছে। তাই গরমটা আজ অনেক বেশী। নিজের মনে হাসে আসাদ। আকাশের মাঝে মধ্যে মন খারাপ হয়। কিন্তু ওর নিজের মন তো সেই গত ছ’মাস থেকেই খারাপ। বাবার থেকে সব সম্পর্ক চুকিয়ে বের হয়ে এসেছে সে ছ’মাস আগে। সেই থেকে এক মন খারাপের বেলাভূমিতে একপ্রকার বন্দী হয়েই আছে সে। সবে আঠারো বছরে পড়ল সে।
আঠারো বছর!
সামনের বাসটির টেইল লাইট জ্বলে উঠতেই সবগুলি বাস-টেম্পু-ট্রাকের গর্জনে কেমন এক উন্মাতাল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যারা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের তাড়াহুড়ায় যার যার গাড়িতে উঠবার ব্যস্ততা দেখে আরেকবার হাসি পায় ওর। শেষে নিজেরও যে উঠতে হবে খেয়াল হতেই ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়া বাসটির দিকে আগাতে যেতেই বাঁধা পায়। কয়েকজন দরজার পাদানিতে ঝুলে রয়েছে। তাদের ঠেলে ভেতরে যাওয়াটা দৃষ্টিকটু এবং ভেতরের অবস্থা জানালা দিয়ে যা দেখতে পেলো, তাতে করে সেখানে ঢুকতে পারলেও সে ঢুকতো না।
আজ বৃহস্পতিবার। তার ওপর শনিবার কিসের যেন এক বন্ধ আছে। সেজন্য গোলামির জিঞ্জিরে বাঁধা সকলে জীবনের ঘানি টানা থেকে কিছু মুহুর্তের মুক্তির আশায় যার যার শেকড়ের টানে ফিরে চলেছে। তাই আজ এত বড় ট্রাফিক।
কিছু না ভেবেই লাফ দিয়ে চলন্ত বাসটির ছাদে উঠার লোহার সিঁড়ি ধরে ফেলে আসাদ। কাঁধে ঝোলানো সাইড ব্যাগ আর অন্য হাতে ছাতাটি দৃঢ় ভাবে ধরে উপরে উঠে যেতে থাকে। ছাদেও বেশ কয়েকজন বসে আছে। তাদের ভেতরে গিয়ে এক কর্নারে বসে পড়ল। কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। সামান্য সময়ের জন্য এক দমকা হাওয়া ওকে সহ ওপরের সকলের দেহ-মন জুড়িয়ে দিয়ে যায়!
আঠারো বছরে পড়েছে সে। এই আঠারো বছর নিয়ে সুকান্তের একটা কবিতা আছে না? অসহ্য অলস গতিতে বাস থেমে থেমে চলছে। যানবাহনের বিচিত্র আওয়াজ আর মানুষের পারষ্পরিক কথা-বার্তার শব্দ মিলে মিশে এক জগাখিচুড়ি ‘সাউন্ড-সিস্টেমের’ ওয়েভে আশপাশটা ভরিয়ে তুলেছে। কেন জানি মনের ভেতরে ভালোলাগার আমজে ভরে উঠলো। সুকান্তের সেই কবিতাটি নিজের মনে আবৃত্তি করতে থাকে-
‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়–
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা … …’
আবৃত্তি শেষ হলে দেখতে পায়, ওর দিকে কয়েকজন তাকিয়ে আছে। যতই শব্দ হোক না কেন, তার ভেতরেও মানুষের গলার আওয়াজ পাশের মানুষের কানে পৌঁছায়-ই। লোকগুলি হরেকমাল বিক্রী করে। ভ্রাম্যমান ফেরিওয়ালা। ওদের পাশেই যার যার মালামালের গাট্টি। একটু লজ্জা পায় আসাদ। তবে অপরিচিত মানুষগুলির বিস্ময়বোধটুকু বেশীক্ষণ থাকে না। চলার পথে এরা এরকম অনেক কিছু দেখেই অভ্যস্ত। তাই কোনো কিছু-ই তাদের জীবনে বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। কেবল একটা জিনিস-ই তাদের মনে দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেটা ক্ষুধার যন্ত্রণা। এই একটা জিনিসের তাড়নায়ই তারা এখান থেকে ওখান, এই দিক থেকে ঐ দিক ছুটে চলে। ঘরেতে অভুক্ত পেটগুলির নিরব চাহনি তাদেরকে এভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
এই যে সে আজ নিজের মেস থেকে এত দূরে এসেছে, তা ও তো ক্ষুধা নিবারণের জন্যই। একজনের কাছে এসেছিল, ওর রুমমেটদের একজন ওকে একটা গ্যারেজে কাজ আছে বলে পাঠিয়েছে। সেখানে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে থেকে থেকে কেবল হয়রান-ই হয়েছে; কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। মালিক লোকটির শ্যালিকার ছেলের বার্থ-ডে। সেখানেই চলে গেছেন তিনি সেই দুপুর বেলায়। তাই আজকের দিনটা মাটি হলো আসাদের। টুকটাক কাজ যা পায় গত ছয় মাসে সেটা-ই করে নিজের পেট চালিয়েছে। সে কাজগুলির কথা না হয় না-ই ভাবলো।
ইন্টার পরীক্ষাটা আর দেয়া হল না। বাবার সাথে থাকাও হল না, পড়ালেখাও তুঙ্গে উঠলো। আর এখন দু’বেলা খাবারের জন্য ওকে কি কষ্টটা-ই না করতে হচ্ছে। অথচ ওকে ননীর পুতুল বললেও কম বলা হবে।
একই জায়গায় পঁচিশ মিনিটের মত দাঁড়িয়ে থাকার পর অস্থির হয়ে আরো কয়েকজনের সাথে বাসের ছাদ থেকে নামতে উদ্যত হয় সে। বসা থেকে উঠতে গিয়েই সাইড ব্যাগটির বেল্টের জয়েন্ট ছিড়ে যায়। মনটা আরো তেঁতো হয় ওর। এখন হেঁটে যেতে হবে। আর এই সময়-ই কি না ব্যাগটাও ছিড়ে গেলো। কি আর করা। ওর পাশের লোকটি তার মোবাইলের আলো জ্বেলে ওকে সাহায্য করলো। কোনোমতে ব্যাগের কাপড়ের হাতলের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিলো। কোনো মতে কাঁধে নেবার ব্যবস্থা করে ছাতা হাতে ধীরে ধীরে বাস থেকে নেমে আসে। ঠিক এই মুহুর্তে ওকে দেখলে যে কেউ একজন বিয়ের ঘটক-ই মনে করবে ওকে। রাহেলাপু যদি দেখত!
অন্যদের সাথে একেবারে ফুটপাত ঘেঁষে হেঁটে চলার সময় নিজের দিদির কথা মনে করে হৃদয়ে এক প্রচন্ড ব্যথার জন্ম হয়। কেমন আছে দিদি এখন?
নিজের মেসে যখন ফেরে আসাদ, তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘন্টাখানিকের মত কেবল হাঁটতেই হয়েছে ওকে। পায়ের দু’জায়গায় ছড়ে গেছে স্যান্ডেলের নিচে। পরিশ্রান্ত দেহে যখন মেসের ঘুমন্ত বাকীদেরকে জাগিয়ে রুমে প্রবেশ করল সে, তখন দেহ-মন কেমন এক বিবশ শ্রান্তিধারায় নুয়ে পড়বে পড়বে করছে। দরজা খুলেছেন শিপন ভাই। ওকে দেখে চোখ কচলে বলে ওঠেন-
‘ এতো রাতে আসলা? আমরা তো মনে করছি আজ আর আসবা না। খাবার তো কিছু-ই নাই। কেমন ব্যাপার হলো দেখতো।‘
‘ আপনি চিন্তা করবেন না শিপন ভাই। আমি আসার পথে কিছু খেয়েছিলাম। ক্ষুধাও তেমন নাই।‘
মিথ্যা বলার জন্য নিজের ভেতরে একটু খচ করে উঠলেও এই ভালোমানুষটির লজ্জিত মুখ দেখে আসাদের কেমন মায়া লাগে। তাই মিথ্যা বলতেও সে কুন্ঠিত হয় না। এই লোকটি-ই ওকে বিপদের দিনে আশ্রয় দিয়েছেন। না হলে আজ মাথার নিচে এই ছাদটুকু-ই বা সে কোথায় পেত। সে অনেক লম্বা কাহিনী। এখন সেটা নিয়ে ওর ভাবতে ইচ্ছে হলো না। পেটের ভেতরে সর্বগ্রাসী ক্ষুধার আগুন। শরীরে নাই একফোঁটাও জেগে থাকার শক্তি। ঘুম আর ক্ষুধা মিলে ওকে কেমন নেশাতুর করে ফেলতে চায়। নিজের শরীরের মাপের চৌকিটায় গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে। অন্ধকারে ছারপোকারা এসে ওকে ঘিরে ধরে। একটুও টের পায় না সে। ধীরে ধীরে চোখ বুজে আসতে চায়। কতক্ষণ এভাবে পার হয়েছে বলতে পারবে না। দরোজায় মৃদু আঘাত। আসাদের ঘুম খুব পাতলা সেই বাবু বেলা থেকেই। নিঃশব্দে উঠে দরজা খোলে। করিডোরের পঁচিশ পাওয়ারের আলোয় মধ্যরাতের এক নারীর মুখ দেখতে পায়। প্রথমটায় সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তবে কয়েক মুহুর্ত কেটে গেলে ওদের বিপরীত পাশের রুমের ভাবীকে দেখে একটু অবাক হয়। ওদের এই মেস বাড়িটি ব্যাচেলর এবং ফ্যামিলি মিলিয়ে মিশিয়ে ভাড়া দেয়া হয়েছে। আসাদদের পাশটা সব ব্যাচেলর। লম্বা এইচ টাইপের বিল্ডিং। ওপর পাশে ফ্যামিলি কোয়ার্টার। কোয়ার্টার মানে এক রুমের বাসা। ভেতরে টয়লেট। ব্যস, এই-ই। প্রতি পাঁচটি রুমের জন্য আলাদা রান্নাঘর। আর ব্যাচেলরদের জন্য রান্না করার বুয়া রয়েছে। এভাবেই চলছে হাবিব সাহেবের এই মেস-বাড়ি।
ভাবী এক ছেলে নিয়ে একা-ই থাকেন। তার হাজবেন্ড প্রচণ্ড নেশাখোর একজন মানুষ ছিলেন। নেশা করে এসে প্রায় রাত-ই ভাবীকে মারধোর করতো। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজে পাশের অন্য রুমগুলির মানুষেরও রাতের ঘুম নষ্ট হতো। এভাবে আর কতদিন সহ্য করা যায়। শেষে বাড়িওয়ালার হস্তক্ষেপে ভাবী তার স্বামীকে ডিভোর্স দেয়। নিজে পাশের একটা পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে একমাত্র ছেলে সহ এক অন্য ভূবনের বাসিন্দা হন। মরিয়ম ওনার নাম।
আসাদ মরিয়মের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এত রাতে? কোনো সমস্যা ভাবী?’
– নাহ, সমস্যা না। তোমাদের কথা শুনলাম তো। কিছু খেয়ে আসনি, তাই তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এলাম।
ওনার হাতে একটা প্লেটের ওপর আর একটি দিয়ে ঢাকা। সেটা আসাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যাবার জন্য ঘুরে বলেন,
– তুমি খেয়ে নিও। সকালে এসে আমি নিয়ে যাব।
ভাবীর চলে যাওয়া দেখে আসাদ। এক যুবতী নারী আঠারো বছরের এক যুবককে খাবার দিতে এসেছে এক মধ্যরাতে। ভাবীর পেছনটা দেখতে দেখতে কেমন যেন এক বিহবলতায় আবিষ্ট হতে থাকে সে। ওর ভেতরের আঠারো বছরের পৌরুষ মুহুর্তে ওকে এক কঠিন পুরুষে পরিণত করে তুলতে চায়! ভাবী নিজের রুমে ঢুকবার আগে কেমন করে যেন ওর দিকে তাকায়। তাতে আরো জ্বলে ওঠে আসাদ। ওর ভেতরে ভাঙাচুরার খেলা চলে। ভাবের ক্রমশঃ উষ্ণতর সোপান থেকে আরো উর্ধতর সোপানে সে পারদের উর্ধগমনের মত উঠে যায়। হাতের থালার দিকে চোখ পরতেই অন্য এক অনুভবে প্রগলভ হয়ে উঠে সে। নিজের দিদির কথা মনে পড়ে। কত রাতে দিদিও ওকে এভাবে ঘুম থেকে জাগিয়ে বিছানায় খাবারের থালা নিয়ে পাশে বসে ওকে খাইয়েছে। ভেতরের পৌরুষের জ্বালা-পোড়া নিমিষে দূর হয়। সেখানে এখন এক বালকসুলভ অনুভূতি শান্ত এক নদীর জলে অবগাহনের অনুভবে আসাদকে শীতল করে তোলে।
নিজের মনে হেসে মেস রুমের দরজা বন্ধ করতে করতে সে ভাবে, ‘পুরুষ মানুষ কেবল গরম হতেই জানে। নারী আর নির্জনতা দুই-ই পুরুষকে কামাতুর করে তোলে। অথচ নারী যখন মা, বোন কিংবা মেয়ের রুপে এই একই নির্জনতায় পাশে থাকে, তখন পুরুষ বালক হয়ে যায়। কেবল এই তিন রুপের ভিন্নতায় একজন বালকও সাহসী পুরুষে পরিণত হয়।‘
(ক্রমশঃ)
loading...
loading...
আজকের পর্ব অন্যান্য পর্ব থেকে বেশ স্বতন্ত্র।
উপন্যাসের ধরণই এমন। পরিচ্ছেদ পাল্টালে একেকটি চরিত্রেরও যথার্থ রূপায়ণ ঘটে।
শুভেচ্ছা জানবেন মি. মামুন। ধন্যবাদ।
loading...
সুন্দর বলেছেন ভাইয়া।
রাহেলা এবং আসাদ চরিত্র, উপন্যাসের অন্যতম মূল চরিত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
সাথে থাকার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানুন।
loading...
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
** সুকান্তের এই কবিতা এখনো নাড়া দেয়।
ভালো থাকুন প্রিয় শব্দ শিল্পী…
loading...
যথার্থ-ই বলেছেন আপনি।
সাথে থাকার শুভেচ্ছা রইলো।

loading...
আসছি এই উপন্যাসের সাথে।
loading...
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...
উপন্যাসের ধারাই এমন। একটা লাইনও বাদ পরে গেলে সম্পূর্ণ ঘটনাটাই অজানা থেকে যায়,
মাঝে নানা স্থান, চরিত্র আসে যায় কাজেই কার কি ভুমিকা বোঝা যায় না।
loading...
অনেক ধন্যবাদ প্রিয় খালিদ ভাই।
loading...