৫টি অণুগল্প

[ লেখক যখন উত্তম পুরুষে/ প্রথম পুরুষে লেখেন, তখন সেটা লেখকের নিজের জীবনের বলে ধরে নেয়াটা ভুল হবে। লেখক তার আশেপাশের চরিত্রদের অনুভব করেন, সেখান থেকে গল্প নেন, লেখার সাবলীলতার স্বার্থে প্রথম পুরুষে লেখা হয় কখনো কখনো।
পাঠককে মনে রাখতে হবে বিষয়টি। ]

একটা পুরো বোতল ফেন্সিডিল খেয়ে নিয়েছি। তারপর কারওয়ান বাজার থেকে আনা ‘জিনিসের’ চারটা স্টিক। চরম!! আমার সমস্ত শরীরে চনমনে চিনচিনে অনুভব! দু’চোখ বুজে আসছে। দেহে অদ্ভুত এক শ্রান্তি। পুলক। চরম আবেশ!

অগ্রহায়নের এক মাঝদুপুরে আমি হাইওয়ের পাশে দাঁড়ানো। নীল আকাশ। রোদটুকু শরীরে কোমলানুভূতির উদ্রেক করছে। রোদের কণার উষ্ণ পরশে আমি ভিজে যাচ্ছি.. ডুবে যাচ্ছি.. ক্রমশ:।

কিন্তু আমার দেহের এই অনুভব আমার মনে একটুও লাগছে না। গত আটমাস ধরে আমি একা। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন এখন বদলে গেছে। আটমাস আগের আমি বোধহয় এখন আর সেই আমি নই।

হুটকরে এক বিকেলে ডেকে নিয়ে আমাকে অব্যহতি পত্র হাতে ধরিয়ে দেয়া হল! কষ্ট পাবার চেয়ে অবাক হয়েছিলাম বেশী। স্টাফ হবার কারণে, এতগুলি বছর টানা জব করেও যাবার বেলায় একেবারে শূণ্য হাতে চলতি মাসের বেতন নিয়ে বাসায় ফিরতে হল আমায়। এই অমানবিক আইন কারা বানিয়েছে জানি না। সংস্কার করলে ভাল হয়।

আমার বউয়ের সাথে টুকটাক ঝগড়া লেগেই থাকত। তবে এর মানে এমন নয় যে আমাদের ভিতর ভালবাসা ছিল না। ছিল। অনেক ভালবাসতাম আমি। সে ও। তবে বউটা ছিল সোজা ধরণের। যে যা বলত সহজেই বিশ্বাস করত।

আমার দু:সময়ে বউয়ের কাছের মানুষদের চেহারা পালটে গেল। যেভাবে চাকরিটা যাবার পরে, পরিচিতদের পালটে ছিল। এমনই কেন হয়? মানুষ মানুষের দু:সময়ে কেন তাকে করুণার চোখে দেখে? কেন মনোভাব একই থাকে না! ভিতরের মানুষটা একবার ভালবেসে আবার সেই একই হৃদয় নিয়ে কাউকে ঘৃণা করে কিভাবে?

বউটা আমার সরল বলেই অন্যের কান কথায় মজে গেল। আর পরিবেশ পরিস্থিতিও ছিল আমার প্রতিকূলে। একটা চাকরিও পাচ্ছিলাম না। ইন্টারভিউ দিয়েই যাচ্ছিলাম। হচ্ছিল না। মানসিক ভাবে আমি দিন দিন ভেংগে ক্ষয় হচ্ছিলাম কেবলি। ঘর ভাড়া দিতে পারছিলাম না। মুদি দোকানে অনেক বাকি হওয়ায় অন্য পথে বাসায় ফিরতে হত। মাছবাজারের রাস্তা-ই ভুলে গেলাম।

ফ্ল্যাটের অন্যরা জেনে গেছে। আগে চলা-ফেরায় সামনা সামনি হলে কথা হত। মৃদু সৌজন্যতার প্রকাশ স্বাভাবিক ভাবেই হত। আজকাল কিংবা কিছুদিন আগে থেকে আমি যেন সবার কাছে অচ্ছুতে পরিণত হলাম।

যা বলছিলাম, একদিন ইন্টারভিউ দিয়ে বাসায় ঢুকতে গিয়ে তালাটা চোখে বড্ড কঠিন লাগল। চাবি ছিল না আমার কাছে। মোবাইলে কল করেও বউকে পেলাম না। মোবাইলের সুইচড অফ। কি করব ভাবছিলাম, পাশের ফ্ল্যাটের ভাবী দরজা খুললেন। আমাকে দেখে আবার ভিতরে গিয়ে চাবি এনে দিলেন। বউটা আমার যাবার আগে চাবিটা ওনার কাছে রেখে গেছে।

বউ বুদ্ধিমতী হয়েছে দেখলাম। আমার বিছানায় একটা নোট রেখে গেছে। দু’লাইনের।
‘তোমার সাথে আমার আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। চলে গেলাম আমি।’

তাই বলে কি আমাকে নেশায় বুদ হয়ে থাকতে হবে.. ফেন্সিডিলের বোতলে সুখ খুঁজতে হবে? – এটাই বলবেন তো?
হ্যা! আমার দেশে যতদিন এই মাদক প্রবেশ করবে, আমি সেবন করব। সিস্টেমের আমূল পরিবর্তন করুন আগে, সিস্টেম যারা রক্ষা করছেন, আগে তাদের ভিতরের লোভটুকু দূর করুন, তবেই মাদকের মত এমন জীবন ধ্বংসকারী উপকরণ আসা বন্ধ হতে পারে।

পদক প্রাপ্ত বিখ্যাত কেউ কেউ যদি নেশা করতে পারেন, বিখ্যাত ঔপন্যাসিকেরা যদি সুরার মত্ততার অনুভবে বিলীন হতে পারেন, তবে একজন আমজনতা হিসাবে আমি ও ফেন্সিডিল খেতে পারি। এ ব্যাপারে আমাদের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামত জানতে পারলে ভাল লাগত। টক শোতে তো প্রায়ই দেখি-শুনি, বিভিন্ন ব্যাপারে ওনারা গুরুগম্ভীর ব্যাখ্যা প্রদান করছেন। এ বিষয়টি নিয়েও নিশ্চয়ই তাদের ভাবনা চিন্তা রয়েছে।

একটা চব্বিশ বাজে। প্রায় পৌণে এক ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আর ভাবছিলাম এসব আবোলতাবোল একা একা।

আমার মা আসছেন। আজ অনেক বছর পরে আসছেন তিনি। আমি ডাকিনি তাকে। আমার এই দু:সময়ে আমি কাউকে ডাকিনি। নিজের থেকেও আসেনি কেউ। এমনই হয়?

মা বাসা চিনেন না। আমার অন্য আত্মীয় স্বজনদের মত? নাহ! মা আসলেই চিনেন না। তাই এই ঘোর দুপুরে, হাইওয়ের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। মোবাইলে কথা হয়েছে। এখনো অনেকটা দূরে। আমাকে এতক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়ানো দেখে, অদূরের চা’র দোকানের খদ্দের এবং অন্যরা বোধহয় কিছু ভাবছিল। আমি কয়েকবার তাদের দিকে তাকালে, প্রতিবার হাসিমুখে তাদেরকে আমার দিকেই তাকানো দেখতে পেয়েছি।

প্রচন্ড চা’র তেষ্টা পেয়েছে। আগেই খেয়ে নেয়া যেত। একবার মোবাইল ডিস্পলেতে সময় দেখি। মাকে ফোন করে জেনে নেয়া যায়, কোথায় আছেন এখন। কিন্তু ফোন করলাম না। যদিও চা আর সিগ্রেটের জন্য ফিলটা কমে যাচ্ছে। এমন মনে হলেও গেলাম না। ডান দিক থেকে মা আসবেন। সেদিকে তাকিয়ে থেকে থেকে আমার ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল। তবুও আমার মা আসছেন বলে কথা।

‘তুমি কি বিশাল মা ভক্ত?.. ‘মা অন্তপ্রাণ কেউ?. – নাহ! যা ভাবছেন তা নয়। আমি প্রচন্ড মা বিদ্বেষী। মাকে ভাল লাগে না আমার। মা আমার বিয়েটা মেনে নেন নাই। তবে মা তারপরও কেন জানি আমার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে থাকেন। যখন প্রচন্ড কষ্টে থাকি আমি, আমার চেতন-অবচেতনে মা থাকেন। আমি নিরন্তর মাকে ঘৃণা আর ভালবাসায় ওলটপালট করতে থাকি.. অনুভুতির ব্যবচ্ছেদ করতে থাকি..।

হাইওয়েতে মা’র অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে পড়ল, বায়েজিদ বোস্তামী ছেলেবেলায় ঘুমন্ত মায়ের শিয়রে পানির গ্লাস হাতে সারা রাত দাঁড়িয়ে ছিলেন।

‘তুমি ও কি বায়েজিদ বোস্তামী হতে চাইছ?
হাসলাম আমি। প্রশ্নকর্তাকে জানাই — এভাবে ফেন্সিডিল খেয়ে খেয়ে?
নাহ! আমি বায়েজিদ বোস্তামী হতে চাই না। আমি কিছুই হতে চাই না। একসময় মানুষ হতে চাইতাম। কিন্তু…

একটা ট্যাক্সি ক্যাব ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার ঘোর কাটে না। সব কিছুকে আরো অবাস্তব মনে হয়। হ্যালুসিনেশন! সব উদ্ভ্রান্তির খেলা। মায়ের পাশে কেউ বসে নেই। আমি ভুল দেখছি।

আমার বউ মায়ের পাশের দরোজা খুলে বের হয়। আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার হাত ধরে হেসে বলে, ‘চলো বাড়ি যাই’।।

#আমার_বাড়ি_ফেরা_অণুগল্প_১৮৮

★★
এখন অনেক রাত।
আমি রুপা.. একাকী সামনের বারান্দায় বসে আছি। শরীরে এবং মনে এক অদ্ভুত আবেশ জড়ানো। নিশ্চুপ এই মাঝ রাতে কত কিছুই যে মনে হচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত আমাদের ভিতরের খরা কেটে গেছে। কিছুক্ষন আগে বৃষ্টি নেমেছিল… তবে কোনো ঝড় ছিল না। একটানা ঝির ঝিরে বৃষ্টি। মিনহাজের সাথে যে দূরত্ব টুকু এই ক’মাসে তৈরী হয়েছিল, নতুন করে ভালোবাসার শান্ত লেকে ইঞ্জিন ছাড়া নৌকায় করে সময় কাটিয়ে সেই দূরত্ব আমরা নিমিষে পার করেছি… ঢেউয়ের তালে তালে কখনো মিনহাজ … কখনো আমি…।

মিনহাজ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গোসল করার পরে চুলগুলো না আঁচড়ানোতে ওকে আরো আকষর্নীয় লাগছে। ল্যাপটপটা আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে সে বললো,
-নেও।

আমি ওর দিয়ে তাকিয়ে হাত দিয়ে সেটা সরিয়ে দিয়ে বললাম,
– নাহ। ওর কাজ ফুরিয়েছে।
– কেন? রাত জেগে সুজনের সাথে চ্যাট করবে না? ঘুম আসবে তোমার?

আমি হাসলাম। মন থেকেই। আগে হলে কি করতাম জানি না। তবে এই মুহুর্তে এই অপ্রিতীকর প্রশ্নেও হেসে বললাম,
– হ্যা! আসবে। তুমি আছো না।
এরপর দু’লাইন গেয়েও শোনালাম ওকে ওর প্রিয় গানের কলি-‘যখন তুমি আছো আমার সনে’

মিনহাজ আমার চোখে চেয়ে থেকে আমার হাত ধরে কাছে টেনে আনে… একটা পুরুষালি তৃষিত অধর তৃষ্ণা মেটাতে খুব কাছাকাছি চলে আসে আমার!
নিশ্চুপ মাঝ রাতে… কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু ভালোবাসা অন্ধকারের হাত ধরে জোনাকি হয়ে ভেসে বেড়ায়। আমি স্বেচ্ছায় সাড়া দেই ভালোবাসায় ভিজে ভিজে।
… … …

আমি সুজন।
স্ট্যাচুর মত বিছানায় বসে আছি।
আজ রুপাকে নেটে না পাওয়াতে ওর মোবাইলে ফোন দিয়েছিলাম। অনেক কথা হলো। এখন একটা বিচ্ছিন্ন অনুভুতি নিয়ে আমি চিন্তা করছি। রুপা আজ আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, সে কেবলি আমার একজন ফেসবুক ফ্রেন্ড। অন্য কিছু যেন ভেবে আমি কষ্ট না পাই। গত ছ’মাস ধরে আমাদের ভিতর যেটা চলে আসছিল- তাকে কি নাম দেয়া যায়? ভালোবাসা বা প্রেম তো বলা যাবে না। প্রেম আমি করেছি আমার বউ মিলির সাথেই। তবে কেন রুপার সাথে এই নতুন করে আবেগের শিকলে আটকে যেতে চাইছি আমি? কবেকার কয়েকটা ভুলের প্রকাশের ভিতরেই কি শেষ হয়ে যাবে আমার হৃদয়ের সকল ভাললাগা?
এতই ঠুনকো ভালোবাসা!

আবার এটাও মনে হলো আমার, আজ রুপা ওর মনের ভিতরের চাওয়াটাকে শেষ করে দেয়াতেই কি এই ভাবে ভাবছি আমি মিলিকে নিয়ে?

তবে ভাবনার জগতে আর একটা নতুন দিকের সন্ধান ও পেলাম অবশ্য। রুপা বলেছে, মিনহাজের সাথে যতো কিছুই হোক না কেন, তাকে সে ভালবেসেছে… একবার ভালবাসলে তাকে আর ত্যাগ করা যায় না। সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো মরে না। সেটা পলিতে আটকে যেতে পারে। কিন্তু তুমুল বৃষ্টি বা ঝড়ে সেই পলি ভেসে গিয়ে ভালবাসার নতুন ঝকমকে চেহারাটা ঠিকই ফুটে উঠে।

বিদ্যুৎ চমকের মত আমি ও তখন রুপার জায়গায় মিলিকে বসাই। সে ও তো আমাকে ভালবেসেছে। তবে আমার ধারনাটা সম্পুর্ণ ভুল ছিল। মিলি এখনো আমারই রয়ে গেছে। কাগজের কয়েকটা টুকরোর উপরে কয়েক লাইন লেখা দিয়ে কি সেটা ঢেকে দেয়া যায়?

মিলি হয়তো এক সময়ের ওর ভাললাগাকে সম্মান দিতে ঐ চিঠিগুলিকে গুলোকে রেখে দিয়েছে। একটা গোপন মধুর স্মৃতি হিসেবে… যদিও সেই স্মৃতি আমার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। তবুও স্মৃতি তো, হোকনা মিলির আগের জীবনের অন্য কারো সাথে সম্পর্কযুক্ত।

নিজেকে বড্ড ছোটলোক বলে মনে হলো আমার কিছুদিন আগের ভাবনা-চিন্তা মনে করে।

মিলি শুয়ে শুয়ে কি যেন পড়ছিল। সেদিকে তাকিয়ে আমি এক পরম মমতা অনুভব করি! মুহুর্তে যে হৃদয় রুপার দিকে ঝুকে ছিল সেটা দিক পরিবর্তন করে মিলি অভিমুখী হয়ে পড়ে। ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন…

মিলি বই রেখে আমারর দিকে তাকায়। ওর চোখে সেই পুরনো আলো জ্বলে উঠতে দেখে হৃদয়ে হাজার পাওয়ারের বাল্বটা আমার আবার জ্বলে উঠে। হৃদয় ভেসে যায় আবেগের টানে! দুটি হৃদয় দু’দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভালোলাগা যা আমাদের জন্য ছিল না- সেটার মায়া কাটিয়ে এক হয়ে যায়…
একটা ঝড় উঠে… অনেক দিনের পরে।

এরপর শুধু একটানা বৃষ্টি…। আমি ভেসে চলি মিলির উষ্ণ প্রস্রবণের ছোঁয়ায় পরম আবেশে! ওর নি:শ্বাসে নি:শ্বাসে বের হওয়া ভালোবাসায় আমি গলে যেতে থাকি।।

#কি_কথা_তাহার_সনে_অণুগল্প_৬৮

★★★
মায়ের পাশে বসে শায়লা বেশ ভালোলাগা অনুভব করে। এই বয়সেও ‘মা মা’ এক ঘ্রাণে এখনো আপ্লুত হয়। মায়ের দিকে তাকায়। মা হাসেন। হাসি কেন জানি সংক্রামক। শায়লাও হেসে ফেলে। মা ওর হাতে নিজের হাত রাখেন। আলতো চাপ দেন।
আদর? ওকে আশ্বস্ত করেন! পাশে আছেন এটাই কি বুঝান?

শায়লার পাশে এখনো কেন মাকে থাকতে হবে? ওর পাশে থাকার একজন মানুষ তো বাবা পছন্দ করে-ই দিয়েছেন? বিয়েও হয়ে গেছে। হ্যা, আকদই তো বিয়ে। এরপর যা রয়েছে, সেটা তো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

আচ্ছা, ইমতিয়াজকে বাবা পছন্দ করেছেন, এই ভাবনাটা ওর মনে কেন এলো? শায়লা কি তবে ইমতিয়াজকে পছন্দ করেনি?

#মামুনের_অণুগল্প_২৩_পছন্দ

★★★★
– নাস্তা দিয়েছি। খাবে এসো।

বউয়ের ডাকে ভাবনার জগত থেকে শিপন ফিরে আসে। প্রবেশ করে ওর নিজের তিন সদস্যের একান্ত ভূবনে। ডাইনিং টেবিলে বসে মোবাইল সেটটি পাশে রাখতেই সুমি জিজ্ঞেস করে,

– কার সাথে কথা বললে?
– বাবা-মা’র সাথে
– ও

ব্যস। এইটুকুই। সুমি শিপনের বাবা-মায়ের ব্যাপারে কখনোই এর বেশী আগ্রহ দেখায় না। এই একটি শব্দ ‘ও’ অনেক অপ্রকাশিত কথাকেই তুলে ধরে যেন। ছোট্ট একটি শব্দে সুমির শ্বশুর শ্বাশুড়ির ব্যাপারে ওর নির্লীপ্ততারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ঠিক এই মুহুর্তগুলোতে শিপন দীর্ঘশ্বাসও ফেলে না। সুমি সব লক্ষ্য করে। শিপনের ব্যাপারে সব কিছুই সে সুক্ষ্ণ ভাবে অনুভব করে। তাই নিজের কষ্টগুলোকে শিপন বড্ড নির্মমভাবে গিলে ফেলে। হৃদয়ে কষ্টকর অনুভূতিগুলোর নগ্ন খোঁচাগুলোও সে সহ্য করে যায় হাসিমুখে।
সুমি কি এসব বুঝে?

মহানগরের একটি সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে এক দম্পতি নিজ নিজ চিন্তা-চেতনায় বেঁচে থাকে। যার যার মত করে। জীবনের আসল দিকটি এখন আয়নার অপর পীঠে পরিণত হয়েছে যেন। তাই ইদানিং বিপরীত দিকটিকেই আসল ভাবে তাঁরা। নিরন্তর এক যান্ত্রিক সুখানুভূতিতে ভেসে যেতে যেতে ওরা নিজ নিজ হৃদয়ের ওপরেও কেমন এক প্রলেপ ফেলে যাচ্ছে। আয়নার পিছনের পারদের মত। তাই এখন সেখানে নিজেদেরকে ছাড়া অপর কেউই আর তাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। নিজেদেরকে নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত তারা। তবে শিপন এই মুখোশ জীবনের ভিতরেও আরো একটি মুখোশ পরে থাকে। সেই মুখোশটি আসল। আর মেকী মুখোশ থেকে সময়ে সময়ে সে বের হয় এবং জীবনের আসল দিকটি দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সুমি এসবের কিছুই জানতে পারে না।

আসলে সে জানার চেষ্টাই করে না। জীবনের একমুখী রাস্তায় একেলা ড্রাইভ করতেই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

#ওয়ান_ওয়ে_স্ট্রিট_অণুগল্প_২৪

★★★★★
বাবা-মা’র সাথে মোবাইলের মাধ্যমে রিপনের সাথে যোগাযোগটুকু রয়েছে। প্রতিদিনই সে কয়েকবার ওনাদের সাথে কথা বলে। অদৃশ্য এই যোগসূত্রটিকে সে কঠিনভাবে ধরে রেখেছে। নিজের জীবিকার প্রয়োজনে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় রিপনকে। তারপরও বাবা-মা’র উপস্থিতি সে নিজ হৃদয়ে ধারণ করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। মোবাইল ফোন এই কাজটি করতে ওকে সাহায্য করে।

দুই ঈদের একটি সে গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের সাথে করে। অন্যটি রোমানার বাবা-মায়ের সাথে। কালেভদ্রে ঢাকায় আসেন তাঁরা। তখন রোমানার সময়গুলো খুব ভালো যায়। তবে তার মানে এই নয় যে, এখন বা বছরের অন্য সময়গুলো খুব খারাপ কাটে। রিপনও সময়টা খুব উপভোগ করে। ওদের শূন্য ফ্ল্যাটটি তখন বেশ জমে উঠে। রোমানার আনন্দে রিপনও আনন্দিত হয়।

কিন্তু রোমানা কি রিপনের আনন্দকে এভাবে উপভোগ করে? সে কি আসলেই জানে কিসে তাঁর আনন্দ? কিংবা রিপন কি চায়? সেভাবেই কখনোই কি রোমানা ভাবে?

তবে এগুলো নিয়ে রিপন দুঃখ করে না। সে খুবই বাস্তববাদী মানুষ। যথাসম্ভব সব দিক মানিয়ে চলার চেষ্টা করে। সংসারের সুখ শান্তি যাতে বজায় থাকে,সেই চেষ্টাই করে যায় সবসময়। ওর জীবন দর্শণ হল, এক একটি দিন করে করে বেঁচে থাকা…সবাই মিলে… আনন্দের সাথে।

#এইতো_জীবন_অণুগল্প_২৫

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১০ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৪-০২-২০১৭ | ১৩:৩৬ |

    একসাথে ৫টি অণুগল্প উপহার দিয়ে পোস্টকে অনেক বেশী সমৃদ্ধ করেছেন।
    বড় গল্পে মানুষের সামান্য অনীহা থাকলেও অণুগল্পে তেমন থাকে না।
    আমি অন্তত ছোট ছোট লিখাকে পছন্দ করি। ধন্যবাদ মি. মামুন।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৪-০২-২০১৭ | ২০:৪৩ |

      অণুগল্প এবং আমি অনেক ভাগ্যবান ভাইয়া Smile আপনার মনোভাব নি:সন্দেহে আনন্দদায়ক।

      অনেক চাপের ভিতরে আছি, ঝামেলায় কোনো কিছুই ঠিকভাবে করতে পারছি না। আশা কছি ইনশা আল্লাহ ঠিক হবে দ্রুত।

      ভাল থাকুন আপনি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ০৪-০২-২০১৭ | ২১:৩৬ |

        ধন্যবাদ মি. মামুন।

        GD Star Rating
        loading...
    • মামুন : ০৫-০২-২০১৭ | ১:১৫ |

      স্বাগত ভাইয়া।

      GD Star Rating
      loading...
  2. নাজমুন নাহার : ০৪-০২-২০১৭ | ১৬:২১ |

    অনুগল্পে আমার ভালোলাগা খুব । মাশাল্লাহ ভালো লিখছেন এবং পরিশ্রমী লেখক । খুব ভালো লাগলো প্রথম চারটা । শেষেরটাও ভালো তবে প্রথম চারটা বেশ ছুয়ে গেলো ।
    শুভকামনা জানবেন ।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৪-০২-২০১৭ | ২০:৪৪ |

      আপনার ভালোলাগার অনুভূতি জেনে অনেক ভালো লাগলো।
      লেখার প্রেরণা হলো।
      অনেক ভালো থাকুন সবসময়।
      https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. মোঃ খালিদ উমর : ০৪-০২-২০১৭ | ২১:৪৮ |

    গল্প, উপন্যাস বা নাটক-সিনেমা কিংবা কবিতা বা গান যাই বলেন না কেন আমার ধারনা মতে তার ৫০% ই বাস্তব। বাস্তব ছাড়া কোন কাহিনী হয় না। সে কেও স্বীকার করুক বা না করুক। এই যেমন ধরেন “কফি হাউজের আড্ডা” গানের কথাই বলি, সেই কফি হাউজ এখনও কলকাতার বুকে সসম্মানে দাঁড়িয়ে আছে, সেই সুজাতাও বহাল তবিয়তে সুখেই আছে (সুজাতার কয়েকটা ছবি আমার কাছে আছে) প্রায় অধিকাংশ ঔপন্যাসিকের প্রথম লেখা উপন্যাস তার নিজের জীবনকে কেন্দ্র করেই রচিত হয় তবে হয়ত বাস্তবের সাথে কিছু কল্পনার মিশেল হতে পারে।
    চালিয়ে যান বন্ধু, বেশ লাগে পড়তে। একদিন যে এই মামুন ভাই কোন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হবে না তা কি কেও বলতে পারে? এমনটা আশা করি। শুভকামনা।

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৫-০২-২০১৭ | ০:৪৩ |

      আপনার সাথে সহমত প্রিয় খালিদ ভাই।
      বাস্তব এবং নিজের জীবন অপরের জীবনের চেয়ে অনুভবে সহজতর বিধায় অধিকাংশ লেখক সহজ পথটি বেছে নিতে চান।

      আমি ছোটগল্প, উপন্যাস এবং কাব্যগ্রন্থ বের করেছি। ১০০০ অণুগল্প নিয়ে অণুগল্প সংকলন বের করা আমার শেষ ইচ্ছে। এরপর অণুগল্প কতভ্যারিয়েশনে এবং কম লাইন ( এখন তিন বাক্যে লেখা যাচ্ছে) বা বাক্যে শেষ করা যায়, তা নিয়ে কাজ করে যাবো।

      ভালো থাকুন। শুভ রাত্রি।
      https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

      GD Star Rating
      loading...
  4. মনা পাগলা : ০৪-০২-২০১৭ | ২৩:১৮ |

    মামুন ভাই…মামুন ভাই….মামুন ভাই…..একজনই মানুষ। যিনি সবই পারেন। সত্যিই অদ্ভুদ লাগলো। জীবনের সাথে এমন অদ্ভুদ মিল, এই প্রথম পেলাম। শুভকামনা মামুন ভাই…
    এই পাগলের পক্ষ থেকেhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ০৫-০২-২০১৭ | ০:৪৬ |

      অনেক ভালোবাসা প্রিয় মনা ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

      আমিও একজন পাগল https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gif
      পাগলেরা বোধহয় সবকিছুই পারে।

      ভালো থাকুন ভাই।

      GD Star Rating
      loading...