★
মিলি শুক্রবার সাধারণত কোথাও যান না । ছুটির দিনে ছেলে মেয়েরা, তাদের বাবা কোন না কোন ভাবে ঘরের বাইরেই সময় কাটায়। একা বারান্দায় বসে থাকতে তাঁর ভালো লাগে । টি ভি দেখার অভ্যাস নাই । কখনো বই পড়েন । কখনো লেখালেখি করেন । আজ একটু ভিন্ন হচ্ছে সব । ছেলেমেয়েরা বাসায় থাকবে । মিলি আর ফরহাদ নেভাল বিচ যাচ্ছেন । ফরহাদের কয়েকজন স্কুল ফ্রেন্ড জোড়ায় জোড়ায় আসবেন । মেয়ে বন্ধুদের মধ্যে দু’জন একা আসবেন । একজন বিয়ে করেন নি । অন্যজনের বিয়েটা টিকে নি। ছেলেদের মধ্যেও একজন একা আছেন । কেন একা তা’ মিলি জানেন না । ফরহাদের সাথে মিলি বেশ কিছুদিন হলো কোথাও যাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন । নির্দিষ্ট কোন ঘটনা ছিল কিনা তাঁর মনে নেই ।
বিয়ের প্রথম বছরের কিছু ঘটনা মনে এলো তাঁর । ফরহাদ অফিসে যাচ্ছিলেন । মিলি তাঁর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো । কিছু নিয়ে হাসছিলেন । ঠিক কোন কারণে বোঝা গেলো না , হঠাৎ ফরহাদ মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন,
– সব মেয়েই মেয়ে, স্পেশাল বলে কিছু নাই।
কথাটা শুনে যত অবাক হলেন মিলি ফরহাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেলেন । মানুষটার মুখে কঠিন ভাব । আহত মনে চুপচাপ সরে দাঁড়ালেন … কিছু হয়েছিলো ফরহাদের । মিলি জানতে পারেন নি । কিছু হয়েছিলো মিলির। ফরহাদ জানতে পারেন নি। সেই এক পা সরে আসাটা ছিল ফরহাদের জীবন থেকে মিলির আরেক পৃথিবীর দিকে সরে আসা।
বিচ্ছেদের শুরু কি এই মুহূর্তটাতে হয়েছিলো? নিশ্চয় তারও আগে । মিলি জানে না। মনে পড়লো ঘৃণায় বিকৃত একটা মুখ । ফরহাদের বন্ধু । মিলির আত্মীয় । বিয়ের বহু আগে এক রাতে এই লোকটা তাঁর দরজা খোলা পেয়ে বিছানায় উঠে এসেছিলো সাপের মতো নিঃশব্দে । একটা শব্দ করতে পারেনি মিলি সেদিন। তাঁর একটা শব্দে ওই লোভী লোকটা তার আশ্রয় হারাতো। শহরের পথে পথে রাত কাটাতে হতো তাকে। খেতে পেতো না। লোকটার অসহায় মা বোনের চেহারাগুলি মনে করে দাঁত চেপে সয়েছিলো। ভুল করেছিলো। ভুলের মাশুল দিয়েছে দিনের পর দিন..
লোকটা ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে তাকে। আর রাতে দিনে যখন তখন সুযোগ খুঁজে বের করেছে। শেষ পর্যন্ত একদিন মিলি সেই সম্পর্কটা অস্বীকার করতে পেরেছিলো। সেদিন থেকে যতবার সামনে পেয়েছে মিলিকে লোকটা ‘ পঞ্চাশ টাকার মেয়ে’ কথাটা না বলে সামনে থেকে সরেনি। এমন কি ফরহাদের সামনেও। আর ফরহাদ নির্বিকার তার সাথে গল্প করেছে, বন্ধুত্ব রেখেছে। একটা বারের জন্য নিঃশব্দেও একটু রাগ তার চেহারায় প্রকাশ পায়নি। মিলি জেনে নিয়েছে মিলির অপমান ফরহাদের অপমান নয়।
এমন হাজার ঘটনা , হাজার স্মৃতি খড় কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় সুখের মুহূর্তগুলিকে। বিশ্বাস মরে যাবার পর ভালোবাসা থাকে? শুধু শরীরটা থাকে। শুধু নিয়ম গুলি থাকে। পৃথিবীতে সব মানুষের একই নিয়ম, একই জীবন – এই বিশ্বাস হবার পর মিলি আর ফরহাদের সংসার ছাড়ার চিন্তা করে না। ভিতরের মানুষটা একা হয়ে গেছে। বাইরের জীবনে কী আছে নেই তাতে খুব বেশি কিছু আসে যায় না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিলি বারান্দা ছেড়ে বেডরুমে গেলেন। রেডি হতে হবে। ফরহাদের জন্য। ও কিভাবে চায়.. পছন্দ করে এতদিনে কি জানা হয়নি ওর?
সেই সন্ধ্যায় মিলি যখন ভালোলাগা আবেশ চোখে ঢেউ আর আকাশের মিতালী দেখছিলেন,, খুব কাছাকাছি বসে ঘোরলাগা চোখে ফরহাদ ও তাঁকে দেখছিলেন। আনমনা মিলি তাকে এক পলক দেখলেন। কাছে এগিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন। কাছাকাছি। নতুনভাবে?
মুখে অস্ফুট হাসিটুকু রয়ে গেল, আজ ফরহাদ অনেক বছর পর সেটা দেখতে পেলেন।।
#মামুনের_অণুগল্প_সম্মতি
★★
‘সম্পর্কের ভিতরে থেকে আসলে সম্পর্কের স্বরূপ বুঝা যায়না..’
এই কথা সে আমাদের দু’জনের দেখা করার দিনগুলির যে কোনও একদিন বলেছিল। শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকেছিলাম আমি। হৃদয় ভেংগেছে তার আগে একবার। ভাংগা হৃদয় জোড়া দিতে শেষে আমার কাছে। সেই থেকে সে আমার মেঘবালিকা!
ওর লাইনগুলি মাথায় ঘুরপাক খায়। তাই জিজ্ঞেস করি তাকে,
– খুব সুন্দর একটা লাইন। আমি কি তোমার এই কথাটা আমার লেখায় ইউজ করতে পারি?
– অবশ্যই, যদি তুমি মনে কর। আমার মেঘ বালকের কথা শুনতে চেয়েছিলে। এখন বলি?
– হ্যা!বলো।
একটুক্ষণ চুপ থাকে। নিজের মনে গুছিয়ে নিয়ে বলে,
– ‘ওর’ জীবনে সুখ জিনিসটা খুব কম। কোথায়ও শান্তি পায় না সে… ওর মনের তল আমি পাইনি। নাহ! এভাবে বলাটা ঠিক না। আমি সে চেষ্টাই হয়ত করি নি। সে আমার জন্য অনেক কিছু করেছে… অনেক কিছু!
মুহুর্তগুলি নিশ্চুপ থাকে। আমরা ও। আমি-ই নিরবতা ভেংগে জানতে চাই,
– কেন কষ্ট পাচ্ছ?
– আসলে আমার মনের অপরাধবোধ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে! ও অন্য এক বালিকার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে… ওদের কাছে আসা… ওদের মিলন এ সব কিছুই আমার জন্য পেইনফুল ছিল। … আমি হিংস্র হয়ে উঠেছিলাম। রাক্ষসের মত তাকে গিলে খাবার চেষ্টা করেছিলাম!
– তুমি উত্তেজিত হয়ো না।
– আর উত্তেজনা… এখন আর কিছুই অনুভব করি না।
– এটা ও খারাপ। তোমার ভিতরের বোধগুলোকে মরে যেতে দিও না।
আমার চোখে তাকায় সে নিরবে। ঐ চোখের মৃদু তিরষ্কার অনুভব করে লজ্জা পাই। সে হেসে বলে,
– তুমি দু’রকমের কথা বললে না? এই বললে উত্তেজিত হয়ো না। আবার বলছ বোধগুলোকে মরে যেতে না দিতে?
– কষ্ট পাবার ক্ষেত্রে উত্তেজিত না হতে বলেছি। কিন্তু অন্যান্য বোধ যেমন ভালবাসা, হাসি-কান্না, সুখ-দুখ, এগুলো – মানে তোমার রেসপন্স যেন নষ্ট না হয়।
– ‘এখন আমার সব কিছুই আছে, ভালোবাসা, শুধু ভালোবাসা নেই’- তপনের এই গানের সুরেই বললাম।
এবার আমি হেসে তাকাই তার পানে, সামান্য রংগ করার লোভ ছাড়ি না,
– মেঘ বালিকারা তপনের গান ও শুনে নাকি?
– হি হি হি.. কেন মেঘ বালিকা হয়েছি বলে আমার মনের খোরাক নেই নাকি?
– নাহ, তা বুঝাই নাই। তুমি ও তো দেখছি মেকুরদের মেকুরাণীদের মত কথার মারপ্যাচ করছ?
– মেঘ বালিকা না আমি? মেকুরাণী আর আমি তো একই প্রজাতির।
– ঠিক আছে। বুঝলাম। অন্য কোনো মেঘ বালককে কেন গ্রহন করছ না?
– আর ঐ পথে উড়তে চাইছি না।
আবারো সব কিছু থেমে যায়। শুধু ওর হৃদয়ের সিস্টোল-ডায়াস্টোলের ফলে কম্পনহেতু সৃষ্ট শব্দ শুনতে পাই। বন্ধুর মত ওর হাত ধরে বলি,
– অবশ্য এটা তোমার ব্যাপার। তবে একবার পথ হারালে যদি পথকেই ভয় পাও, তবে চলবে?
– আর কোনো বালককে যে আমি ‘ওর’ মত অনুভব করতে পারি না! তোমাকে কীভাবে বুঝাব?
– আমি বুঝতে পারছি…
– নাহ! তুমি পারছ না। তুমি না পাওয়ার বেদনা কি সেটা কখনো বুঝেছ?
– তোমার মত হয়ত পারছি না। কিন্তু প্রত্যেকের জীবনেই না পাওয়ার বেদনা রয়েছে। তবে সেটা আলাদা আলাদা। সব কিছু মিলিয়ে আর কি। তুমি বললে না, “সম্পর্কের বাইরে এসেই আমি সম্পর্কের মূল্য বুঝেছি…”
– হ্যা, বলেছি।
– কি বুঝলে?
– বুঝলাম, সুখের চেয়ে শান্তি ভালো… প্রেমের চেয়ে বন্ধুতা!
– সত্যি কথা বলতো… এটা কি তুমি পাওনি বলে মনে হচ্ছে? নাকি অরিজিন্যালিই বন্ধুতা ভাল?
– আমি আমার কথা বলতে পারি..
– তোমার কথা-ই তো শুনতে চাচ্ছি
সে আমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। মুখোমুখি আমার সামনে বসে। আমার দুই কাধে হাত রেখে, চোখের পানে চেয়ে হাসে। ওর মন কেঁদে চলে, তাই হাসিতে আধার মিশে থাকে। চোখের আলোয় জ্বলে ওঠে না। নিস্প্রাণ সবরে বলে যায়,
– প্রেম করে দেখেছি…শান্তি পাইনি
– শান্তি কিসে সেটা কি আগেই নির্ধারণ করে নিয়েছিলে?
– নাহ! এখন আমি সত্যি সত্যি আমার জীবনটা উপভোগ করছি…
– এটা ও তোমার মুখের কথা নয় তো? হৃদয় হয়ত অন্য কিছু বলছে?
– হতে পারে।…
দূরকে কাছে করার যন্ত্র বেজে ওঠে। কিছুক্ষণ হু হা করে সে আমার দিকে তাকিয়ে ক্ষমা প্রার্থণার হাসি হেসে জানায়,
– শোন, আজ যেতে হচ্ছে আমায়। তুমি কিছু মনে করলে নাতো?
– না, না। মনে করার কিছু নেই। আবার কবে দেখা হবে?
– জানি না। তবে পৃথিবীটা তো ছোট। হয়ত কোথাও না কোথায়ও দেখা হয়েই যাবে। তোমার সাথে সময় কাটিয়ে ভাল লাগল আজ। নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হচ্ছে।
– ভাল থেকো বালিকা! তোমার মনের ভিতর থেকে সকল বিষন্নতা দূর হোক!
বালিকা পরম মমতায় আমার মাথার চুলগুলি এলোমেলো করে দিয়ে ওর গন্তব্যের দিকে হেটে যায়… আজ খুব সুন্দর ভাবে সেজে এসেছিল সে!সুন্দর!!
আমি ছাদে বসে রইলাম একা একা… ওর গমন পথের দিকে তাকিয়েভাবছি- কেন এতো বিষন্নতা এই নজরকাড়া সুন্দরের ভিতর!!!
#মামুনের_অণুগল্প_সম্পর্কের_ভিতর_বাহির
★ Photo Credit: Noen Laine
loading...
loading...
দুটো অণুগল্পই ভাল লেগেছে। অনেক বেশি ভাল। আসলে আপনার অণুগল্পের আবেদন আমার কাছে সব সময় অন্য রকম।
ভাল থাকবেন মামুন ভাই
loading...
আপনার অনুভূতি জেনে অনেক ভালো লাগলো প্রিয় আনু ভাই।

কৃতজ্ঞতা জানবেন।
loading...
পঞ্চাশ টাকার মেয়ে’ কথাটা না বলে সামনে থেকে সরেনি””।
ভীষন রকম অকৃতজ্ঞ এক জাতি – যার অনুকম্পায় বেঁচে রইলো তাকেই ছোট করতে একটুও দ্বিধা করেনা । সমাজের কিছু ইতর মানুষের এই রূপ সামনে আনার জন্য ধন্যবাদ ।
ভালো লাগলো অনুগল্প । শুভকামনা জানবেন ।
loading...
হ্যা, নারীকে নারীর আসল মর্যাদাটুকু দিতে কেন জানি কুন্ঠা বোধ করে এই অকৃতজ্ঞ সমাজ। আমিও এই সমাজের একজন

আপনার অনুভূতি অনেক প্রেরণা দিলো।
ভালো থাকুন।
loading...
চমৎকার দুটি অণুগল্প পড়লাম
loading...
জেনে অনেক ভালো লাগলো।
loading...
দুটো গল্প একত্র হওয়ায় পড়ার জন্য পোস্টটি ভালো হয়েছে।
শুভ সকাল মি. মামুন। অনেক ভালো থাকুন।
loading...
আপনার ভালোলাগার অনুভূতি জেনে অনেক খুশী হলাম।


শুভেচ্ছা ভাইয়া।
loading...
“বাহির বলে দূরে থাকুক
ভিতর বলে আসুক না…“
দু`টি গল্পেই দুইটি জুটি তুলে এনেছেন। যাদের কাছে সবচেয়ে সহজ হলো ভালবাসা— সবচেয়ে দুর্লভ ভালবাসা।
সবশেষ ভালবাসার জয় হোক; পাওয়া না পাওয়ার বেদনা একটু না হয় থাক!
শুভেচ্ছা এবং ভালবাসা জানবেন মিতা।
loading...
আমার অনেক প্রিয় গান মিতা।

বরাবরের মতো আপনার মন্তব্যে অণুপ্রাণিত হলাম মিতা।
loading...
মামুন ভাই আপনার অনুগল্পগুলো বেশ নাড়া দিয়ে যায়…দারুণ লিখেন আপনি। ভাবছি আপনার মতোই অনুগল্প লেখা শুরু করবো…প্রেমের গল্প…যদিও পাগলদের জীবনে প্রেম মানেই পাগলামি। সেই পাগলামির কথা লিখলে কেউ পড়বে কি-না সন্দেহ।
ভালো লাগল। ধন্যবাদ মামুন ভাই। শুভেচ্ছা নিরন্তন
loading...
আমরা সবাই-ই কোনো না কোনো ভাবে পাগল প্রিয় মনা ভাই। লেখকেরা সব চেয়ে বড় পাগল


লেখার পাগল না হলে লেখা যায় না।
আপনার সুন্দর মন্তব্যে অনেক অনুপ্রাণিত হলাম।
শুভেচ্ছা।
loading...
ভালো লাগল। ধন্যবাদ মামুন ভাই। শুভেচ্ছা জানবেন …..
loading...
আপনার ভালো লাগার অনুভূতি জেনে অনেক ভালো লাগলো ভাই।
শুভেচ্ছা।
loading...