নীলার আপন আধার

FB_IMG_1484642276269
প্রায় দুপুর হয়ে গেলো । নীলা কিছুটা বিষণ্ণ বোধ করলো । হয়তো আসবে না। এতো বছর পর । নীলা কি ওকে চিনবে ? ছবিতে যেমন দেখায় সামনাসামনি তেমন হবে ? যদি এসে থাকে আর নীলা না চিনে থাকে ! কাউকে কি জিজ্ঞেস করা যায় ? ওদের কাছে ডিপার্টমেন্ট ভিত্তিক লিস্ট আছে । কে কে আসবে ।
নীলা টেবিল ছেড়ে দরজার সামনের ডেস্কটায় গিয়ে দাঁড়ালো ।
একটু নার্ভাস লাগছে ।
হাসলো ।
রিসেপশন এর দায়িত্বে কিছু স্কাউট আছে। স্কাউটরা বেশ আত্মবিশ্বাসী হয় । স্কাউট দের মধ্যে একজন স্বাভাবিক দৃপ্ততায় নীলার সামনে টেবিলের ঠিক ওপাশে হাসিমুখে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো , ” কিছু করতে পারি আপনার জন্য ?
নীলা মৃদু হাসলো ।
‘যারা আসবে তাঁদের নামের লিস্ট দেখতে পারি ?’
ছেলেটা মাথা খানিকটা নোয়ালো , ‘জ্বী , অবশ্যই … ‘
নীলা রেজিস্ট্রেশন করা নামগুলি পড়তে থাকলো ।

পরিচিত দুই একটা নাম পড়া হতেই একটা চেনা গালায় নিজের নাম শুনে ঘুরে দাঁড়ালো … নাম মনে আসছে না … হাসতে লাগলো নীলা … বান্ধবী হাসতে হাসতে এসে নীলার হাত ধরল , ‘ নীলা , আমি মিমি , মনে নাই একদমই ! কেমন আছিস? আমার সাথে আমার দুই বাচ্চা আছে । একজন অসুস্থ , আনি নাই । তোর ছেলেমেয়ে আসে নাই ? …’ প্রশ্নের স্রোতে ভাসতে ভাসতে নীলার মেমোরি মিমির ইতিহাস খুঁজে পেলো । উচ্ছ্বল হয়ে উঠলো দুজন । কথার ফাঁকে ফাঁকে নীলার চোখ অন্য সব বন্ধুদের মধ্যে শিহাবকে খুঁজতে থাকলো । ‘ সত্যিই আসেনি !’
মিমি নীলার চোখের দিকে খেয়াল করলো , ‘কাকে খুঁজিস?’
নীলার মুখ বন্ধ হয়ে কান লাল হয়ে গেলো । মিমি হেসে উঠলো।
‘ আয়’
নীলার হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়ে গেলো স্টেজের পিছনে । মিলন , রেখা , শিহাব । নীলার রক্ত চলাচল ধীর হয়ে গেলো। হাসছিল তখনো । যার দিকে তাকিয়ে আছে তাকে দেখছে কিনা সন্দেহ । বাকিরা হাসছে তাও দেখছে না।

শিহাব স্বভাবসুলভ মৃদু স্বরে জানতে চাইলো ,’ ভালো আছো?’
নীলা ও প্রায় একই সাথে জিজ্ঞেস করলো ,’ কেমন আছো ‘
প্রায় থেমে থাকা সময় থেকে তাদের ভাবনার স্রোত বয়ে গেছে অনেক বছর আগের কোন সময়ে …
যে যার স্মৃতির ভিতর কোন অনুভূতিকে খুঁজতে খুঁজতে টুকিটাকি দু একটা কুশল বিনিময় হতে থাকলো ।
আর কোনো কথা খুঁজে পায় না ওরা… কি বলবে … কি বলা উচিত এই সময়গুলোতে?
লিখে ভাষা যত সহজে প্রকাশ করা যায়, সামনে এলে কেন যায় না?
দৃষ্টি কি অনেক বেশি কিছুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় মানুষকে ?
কি ভাবছে আধো আনমনা দুজন !

সারাটা দিন শিহাবের সাথে সাথে রইলো নীলা। আরো অনেক বন্ধু-বান্ধব থাকার পরেও শিহাবও নীলার সাথে সাথে। বন্ধুদের নীরব হাসি এবং কারো কারো স্পষ্ট অন্য ইঙ্গিত- কোনোটারই পরোয়া না করে দুজন সকলের ভিতর থেকেও একান্তে অনেকক্ষণ কাটালো।

সময়গুলো যেন সুপারসনিক জেটে করে চলে গেল।
এরকমই হয়। ভালো সময়গুলো থাকতেই চায় না… বেশীক্ষণ। দুঃসময় যেতে চায় না… যেন থাকে চীরকাল।
স্টেজে উঠে নীলা গাইলো-
‘রোদন ভরা এ বসন্ত…’ সখি কখনো বুঝিনি আমি আগে…’
শিহাবের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়… পুরনো স্মৃতিগুলো ওকে বড় বেশী এলোমেলো করে দিয়ে যায়। নস্টালজিক ভাবনায় বুদ হয়ে থাকে। বিএল কলেজের পিছন দিকের খেয়া ঘাটে একদিনের কথা মনে পড়ে। নৌকায় সে আর নীলা… পরিচিত মাঝি… ফুরফুরে বাতাস… নদীর জলের মন মাতাল করা গন্ধের সাথে ছলাৎ ছলাৎ ছল… বৈঠার একই তালে আওয়াজ … এসব কিছুকে ছাপিয়ে যায় নীলার কণ্ঠের রবীন্দ্র সঙ্গীত। নদী যেখানটায় এসে ভৈরব থেকে রূপসায় নাম নিয়েছে, সেখানে এসে একবার মনে হল নীলাকে মনের কথাটা বলেই দেয়। কিন্তু প্রকৃতি-নীলা আর ওর মাঝে এমন এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিলো যে, না বলা কথাটা আর বলাই হল না।

শিহাবকে কয়েকবার মাইকে ডাকা হল। কিন্তু ভাবনায় এমন বুদ হয়েছিল যে শুনলোই না। নীলা এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই চমকে তাকায়।
একটু লজ্জা ও পায়। সকলে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আরো একটু অবাক হয়।
আবারও মাইকে ওর নাম ভেসে আসে। কলেজ জীবনে সে খুব ভাল গান গাইতো। এখন আর চর্চা না থাকায় কোনো অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়ে উঠে না। জেসমিনের অনুরোধে বাচ্চাদের জন্মদিনে তাও একেবারে নিজস্ব মানুষদের সামনে সে গায়। আজ একটু লজ্জা এবং কেমন এক বিব্রত ভাব জাগা মন নিয়ে স্টেজে উঠে সে।

নীলার সারা তনুমন কেমন এক ভাললাগার আবেশে জড়িয়ে আছে… শিহাবের সাথে আজ সারাটা দিন থাকার ফলে এই ভাললাগা! আর এখন ওর গলার গান সেটাকে আরো গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। নীলার খুব প্রিয় একটা গান সে গাচ্ছে-
‘আবার এলো যে সন্ধ্যা… শুধু দুজনে’
নীলাও শিহাবের প্রিয় একটা গান ইচ্ছে করেই গেয়েছিল। ও কি সেটা বুঝেছে? তার প্রমাণ দিতেই কি নীলার পছন্দের গানটি গাইছে?

সব কিছুরই শেষ বলে একটা কিছু থাকে। কিন্তু শেষ হইয়াও হইলো না শেষ… এরকম অনুভুতিতে আচ্ছন্ন নীলা … কষ্ট পাচ্ছে… একটু পরেই শিহাবকে ছেড়ে যেতে হবে। ইকবাল আসবে ওকে তুলে নিতে। সকালে সে ই তো ওকে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে। দুজনেরই মিলনমেলায় আসার কথা ছিল। কিন্তু ইকবাল সোজা না করে দিয়েছে। তবে ওকে দিয়ে যাবার এবং নিয়ে যাবার ব্যাপারে মুখ গোমড়া করে রাজী হয়েছিল।

শিহাব এখন নীলার কাছেই আসছিল। এই মাত্র গান শেষ করে স্টেজ থেকে নেমেছে। বাদলের ডাকে একটু থামল। কিন্তু চোখ আর মন রয়ে গেছে নীলার দিকে। বাদলের মোবাইল নাম্বার নিয়ে হাল্কা দু’একটা কথা বলে দূরে একা বসে থাকা নীলার দিকে তাকায়।
নীলা!
ওর জীবনের এক সময়ের বহু আকাংক্ষিত এক নারী… একজন প্রেমিকা… একজন ছলনাময়ী… এমন এক ছলনাময়ী যাকে পাবার জন্য সমস্ত পৃথিবীটাকে লন্ড-ভণ্ড করে দিতে পারত! মনটা একই সাথে ভাল এবং খারাপ হয়ে গেল। মিশ্র একটা অনুভুতি নিয়ে নীলার সামনে দাঁড়ালো।
নীলা বসে থেকেই ওর দিকে তাকায়।
চোখে চোখে কথা হয়…
নীলার একটা হাত ধরতে ভীষণ ইচ্ছে হয় শিহাবের।
কত কাছে… এইতো পাশে… তবুও…

নীলা বুঝতে চেষ্টা করে শিহাবের মনে কি চলছে। একসময় ওর দিকে তাকালেই সে বুঝতো শিহাব কি চায়। টেলিপ্যাথি জাতীয় কিছু একটা পাওয়ার ছিল নীলার ভিতরে… ভালবাসার উদ্দাম সেই দিনগুলোতে।
কিন্তু শিহাবের সাথে ওর চরম বিশ্বাসঘাতকতা আজ ওর সেই পাওয়ার কেড়ে নিয়েছে। আজ ওর চোখে সে কেবলি এক বোবা ভাষা ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না।
ভালবাসা!
একটু ও কি নেই ঐ চোখে?
ওর জন্য…
কেন অতি পরিচিত সেই চোখ দুটিকে আজ গ্রানাইট পাথরের মত লাগছে? ভালবাসা সেখানে আজও রয়ে গেছে… তবে তা ভিন্ন কারো জন্য।
শিহাবের চোখে এখন শুধুই জেসমিন… বিরাজমান… এমনটাই মনে হল নীলার।

আরো আধা ঘন্টা একান্তে কাটায় ওরা দু’জন। নীলা ওর বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব ওকে জানায়। শিহাবও ওর এখনকার জীবনের টুকরো কিছু কিছু নীলাকে বলে। একসময় নীলার মোবাইল বেজে উঠে। ইকবালের ফোন। রিসিভ করে… বলে, ‘ আসছি’।

শিহাব নীলার মোবাইল নাম্বার সেভ করে নেয়। ওরটা নীলাকে দেয়। উঠে দাঁড়ায় মুখোমুখি।
নীলা জিজ্ঞেস করে,
: আবার কি দেখা হবে?
: হওয়া কি উচিত?
: তুমি বল!
: জানি না! সময় ই বলে দিবে…
: আসি তাহলে!?
কিছু বলে না শিহাব। কি বলবে এই কথার উত্তরে… যদি বলে যেও না , নীলা কি থেকে যাবে? আর নীলা থেকে গেলে সে কি ওকে রাখতে পারবে?
অনেক দিনের একটা ইচ্ছে এবং না বলা সেই কথাটি প্রায় মুখ দিয়ে বের হয়েই যাচ্ছিল… নীলার মুখের একটা পাশ আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল-
: কেন নীলা?…
যে কথাটি এতোদিন ধরে হৃদয়ে পাক খাচ্ছিল আজও সেটা পুরোপুরি ওকে বলতে পারলো না। কিন্তু নীলা ঠিকই বুঝে নিলো শিহাব কি বলতে চায়।

ইকবালের গাড়ীর হর্ণ বেজে উঠছে… সামনে দাঁড়িয়ে অটল পর্বতের মত শিহাব… নীলার একসময়ের ভালবাসা যাকে সে ইচ্ছে করে ছেড়ে গেছে…কি বলবে সে ওর প্রশ্নের উত্তরে? নিজেও কি সে জানে কেন সে ছেড়ে গেছে সেই সময় শিহাবকে!
একবুক ভালবাসা নতুন করে উথলে উঠে নীলাকে কাঁদিয়ে দিতে চাইছে… অনেক কষ্টে সেটা দমিয়ে একবারও শিহাবের দিকে না তাকিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। ইকবাল সেখানে অপেক্ষা করছে।

একটা অতীত বর্তমানে এসে শিহাবকে নস্টালজিক করে দিয়ে গেলো । ওরই সামনে দিয়ে সেই আগেরবারের মতো নীলা ইকবালের সাথে চলে যায়। অনেকক্ষণ শিহাব চেয়ে থাকল ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া ওদের গাড়ীর টেইললাইট এর দিকে… একসময় ঝাপসা হয়ে গেল সামনেটা…

নীলা ওর আনন্দের সেই একমাত্র জায়গা বারান্দায় বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে শিহাবকে ফোন করেছিল। দায়সারাভাবে উত্তর দিয়ে সে ফোন রেখে দিয়েছে। ওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও অ্যাক্সেপ্ট করে নাই। করলে এতক্ষণে করেই দিতো। একটা প্রচন্ড কষ্ট বুকের ভিতর থেকে উঠে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে আবার বুকের ভিতরেই ফিরে গেল।
একটু হাসল নীলা…
সেই বা কি অদ্ভুত ভাবে শিহাবের কাছে কিছু একটা চায়?
আজ যে কষ্ট সে অনুভব করছে এর সবটুকুই কি তার নিজের তৈরী নয়?
কেন তবে শিহাবকে দোষ দিবে?
নাহ! সে শিহাবকে দোষ দিচ্ছে না। সে কাউকেই এখন আর দোষী মনে করে না। সবাই ই যার যার জায়গায় ঠিক আছে।
একবার প্রিয় জায়গাটি ভালভাবে দেখে… বাইরের আকাশ এবং সেখানে থালার মতো চাঁদকেও মন ভরে দেখে নিলো। একটা সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে সে নিয়ে নিয়েছে… মুখে একটু মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।
ধীর পায়ে ইকবালের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
এই প্রথম মনে হয় অনেক বছর পরে ইকবালের রুমের দিকে আনন্দ নিয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে সে। নিজের ভূবনে… আপন আঁধারে। যেখানে এক চিলতে আলো ছিল এতোদিন। আশার জানালা দিয়ে আসতো সেই আলো। কিন্তু আজ তাও শেষ হয়ে গেছে।।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৭-০১-২০১৭ | ১৬:২৮ |

    নতুন ব্লগের প্রথম গল্প। শিহাব যেন খুব চেনা একটি চরিত্র।
    অনুপম লিখা। আশা করবো লিখাটি আপনার নতুন গ্রন্থতে সংযোজিত হয়েছে। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৭-০১-২০১৭ | ১৬:৩০ |

      ধন্যবাদ ভাইয়া।
      না, নতুন গ্রন্থে সংযোজিত হয়নি। বইমেলা ২০১৮’র জন্য অপেক্ষা করছে।
      ভালো থাকুন সবসময়।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ১৭-০১-২০১৭ | ১৬:৩৬ |

        ওকে। ২০১৮ বইমেলার অপেক্ষা থাকবে মি. মামুন। থ্যান্কস।

        GD Star Rating
        loading...
    • মামুন : ১৭-০১-২০১৭ | ১৭:৪৯ |

      স্বাগত আপনাকে Smile

      GD Star Rating
      loading...
  2. মোঃ খালিদ উমর : ১৭-০১-২০১৭ | ১৮:৩৭ |

    মামুন ভাইয়ের লেখা সব গল্পই আমার কাছে জীবন নাটক বলেই মনে হয়।
    সুন্দর!

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৭-০১-২০১৭ | ২১:৫৪ |

      জেনে অনেক ভালো লাগলো।
      ধন্যবাদ প্রিয় খালিদ ভাই।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. সালজার রহমান সাবু : ১৭-০১-২০১৭ | ২২:৪২ |

    অসাধারণ ….

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১৭-০১-২০১৭ | ২৩:২১ |

      ধন্যবাদ।

      GD Star Rating
      loading...