মকাইশা মোকাম্মিল

মোকাম্মিলকে আমি ডাকি ‘মকাইশা’, আমরা যখন ছোট তখন মকাইশা নামে এক অদ্ভুত, অলৌকিক মানুষ আমাদের পাড়ায় আসতেন। তিনি আমাদের খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন; তাঁর বিচিত্র আচার-আচরণের জন্য। আমাদের পাড়ায় যতগুলো টিউবওয়েল ছিল প্রত্যেক টিউবওয়েলে তাঁর একছত্র রাজত্ব। টিউবওয়েলের পানি তাঁর কথা শুনতো তিনি যা চাইতেন টিউবয়েলের পানি তাই করতো, ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর মাথায় পানি ঝরতেই থাকতো, ঝরতেই থাকতো।

টিউবওয়েলের পানি যেভাবে তাঁর অনুগত ছিল, আমরাও ঠিক সেভাবে তাঁর অনুগত, ভক্ত ছিলাম। তিনি যা বলতেন আমরা তাই করতাম। আমাদের যে ছোটখাটো রাজত্ব ছিল, আমরা তাঁকে সেই রাজত্বের রাজা হিসাবে স্বীকার করেছিলাম। তিনি ছিলেন আমাদের জন্য হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, তাঁর বাঁশির ডাকে আমরা ছুটে বেরিয়ে আসতাম। তিনি বললে আমরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।

আমরা বড় হতে শুরু করলে তিনি তিরোহিত হলেন, কিন্তু তাঁর চিহ্ন থেকে গেল আমাদের হৃদয়ে। বন্ধুবান্ধব যখনই একত্র হই মকাইশাকে খুঁজতে থাকি, ইচ্ছে করে পুনরায় শৈশবে ফিরে যাই, ইচ্ছে করে টিউবওয়েলে ঘন্টার পর ঘন্টা মাথায় পানি ঢালি।

মোকাম্মিলের মাঝে মকাইশার কিছু চিহ্ন আছে। সেও অদ্ভুত স্বভাবের, তার সম্মোহনের ক্ষমতা অসাধারণ! একদিন লক্ষ্য করলাম আমরা তাকে অনুসরণ করছি। একদিন সে আমাদের দলনেতা হিসেবে দেখা দিল।

দেশে গেলে মোকাম্মিল ছাড়া আমার জীবন অচল। বিশ্বাস করুন এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না, মোকাম্মিল ছাড়া দেশের কোন আকর্ষণ নেই। আমি যদি বাসা থেকে এক ফুট দূরত্বে যাই, মোকাম্মিলকে সাথে থাকতে হয়। যদিও আমি দেশ থেকে বড় হয়ে এসেছি তবুও কেন জানি মনে হয় মোকাম্মিল সঙ্গে না থাকলে আমি হারিয়ে যাব। অথবা কেউ আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে। যতদিন দেশে থাকি নিজের চেয়ে মোকাম্মিলের উপর ভরসা করতে হয় বেশি।

ব্যক্তিগতভাবে মোকাম্মিল আমার ওস্তাদ। আমার জীবনের ‘প্রথম’ অনেক কিছু তার কাছে শিখেছি। দু একটা উদাহরণ দেই: সিগারেট খাওয়া ক্ষতিকর সবাই জানি, আমাদের পারিবারিক শৃঙ্খলার মাঝে সিগারেটের কোন স্থান নেই। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকে। আমাদেরও ছিল; কিন্তু নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে স্বর্গচ্যুত না হওয়া কীভাবে সম্ভব মোকাম্মিল সেটা শিখিয়েছিল। সিগারেট খেয়ে কচি লেবুর পাতা কতক্ষণ চিবুলে সিগারেটের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায়, হাতের আঙ্গুলেও যাতে নাসির বিড়ির দুর্গন্ধ না থাকে সেজন্য কচি লেবুর পাতার রস বানিয়ে হাতে মাখতে হয়।

দুই টাকার বিনিময়ে কুসুমবাগে সিনেমা দেখা যায় সেটাও তার কাছে শেখা। কুসুমবাগের তখনকার যে টিকেট কন্ট্রোলার ছিলেন, তাকে দুই টাকার ঘুষ দিলে তিনি আমাদের থার্ড ক্লাসে বসিয়ে দিতেন, বিরতির পূর্বে শুধুমাত্র ১৫ মিনিটের জন্য বাইরে আসতে হতো তখন হল মালিকের নির্বাচিত লোক পরিদর্শনে আসতো, পরিদর্শন শেষ হওয়া মাত্র পুনরায় সিনেমা দেখার সুযোগ পেতাম।

শবেবরাতের নফল নামাজের জন্য মসজিদের প্রতিটি কোনা যে কভার করা লাগে সেটাও মোকাম্মিলের কাজ থেকে শেখা। আল্লাহ তাঁর রহমত মসজিদের কোন কোনায় বর্ষণ করছেন সেটা আমরা জানি না, সব কোনা কাভার হয়ে গেলে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হলাম না পরীক্ষা পাশও সহজ হয়ে গেল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক যে শেখ মুজিবুর রহমান এই সত্য সে-ই আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। তখন খাল কাটার জমানা, বাজারে সাধারণ জ্ঞানের অসংখ্য বই বেরিয়েছে। আমাদের জায়গীর মাস্টার চাকরির ধান্দায় এসব বই গোগ্রাসে গিলছে। সাধারণ জ্ঞানের এক বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে দেখেছিলাম সানগ্লাস মেজরের নাম।

মোকাম্মিল বলেছিল এসব মিথ্যা; মেজর কোনভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারে না তার সেই অধিকার নেই। স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার একমাত্র বঙ্গবন্ধুর, তখন গুগল জামানা ছিল না তাই দলিল, দস্তাবেজ দেখিয়ে প্রমাণ করার সুযোগ ছিল না কিন্তু যাকে সাক্ষী মেনে ছিল তাঁর সত্যবাদীতার কাছে হাজারটা গুগল পৌঁছাতে পারবে না। সাক্ষী ছিলেন সৈয়দ আমজাদ আলী, মোকাম্মিলের পিতা। সত্যবাদিতা এবং সৈয়দ আমজাদ আলী সমার্থক ছিলেন। আমাদের শহরে তাঁর সত্যের সামনে দাঁড়াতে পারে এমন কেউ ছিল না। সত্যের মূর্তপ্রতিক যখন বললেন শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক; সন্দেহ করার তিল পরিমাণ অবকাশ থাকল না।

মোকাম্মিল সম্পর্কে আমার চাচা, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কোনদিনই চাচা ভাতিজায় রূপ নেয়নি। সেরকম সম্ভাবনা ছিল না। আমাদের জন্ম প্রায় একসাথে দু-চার দিনের কম বেশি হতে পারে, বাসা পাশাপাশি। আমরা যখন বড় হই তখন কে কোন বাসার সে চিন্তা মাথায় আসেনি আমি যেমন অনায়াসে তাদের পাক ঘরে ঢুকে খাবার খেতে পারতাম, সে ঠিক তেমনি আমার সাথে এক পাতে খেতে বসে যেত। মোকাম্মিল আমার বন্ধু, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। যে গোপন কথা বিবাহিত বউকে বলা যায় না; সে গোপন কথা মোকাম্মিলের সিন্দুকে আজীবন নিরাপদ থাকে।

আমার গায়ের রং কৃষ্ণ অর্থাৎ কালো মোকাম্মিল ফর্সা, মহাভারতের জমানা হলে সব গোপিনী আমার জন্য পাগল হতো কিন্তু এটা কলিকাল। এটা বুক ফেটে যাওয়ার জমানা; আমার ভাগ্যে কোনদিনই কোন গোপিনী জোটেনি, যাকে পছন্দ করি সেও আমার সামনে দিয়ে মোকাম্মিলের হাত ধরে চলে যায়। তবে ভাতিজার জন্য, প্রাণের বন্ধুর জন্য মোকাম্মিল চেষ্টা করেছে অনেক, তাকে পছন্দ করা গোপিনীদের আমার কাছে ভিড়াতে চেয়েছে, কিন্তু কলিকালের কারণে কেউ রাধা হতে রাজী হয়নি।

আমার দুঃখের এক বয়ান দিয়ে এই লেখার সমাপ্তি করি। মোকাম্মিলের সাথে ঢাকায় যাচ্ছি, ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে এমন সময় এক তরুণী আমাদের কামরায় উঠে এলো তরুণীর আলোয় ঝলমল করে উঠলো কামরা। মোকাম্মিল এবং আমি সামনাসামনি বসেছি। আমার পাশের সিট খালি, মোকাম্মিলেরও। তরুণী একবার আমার দিকে তাকিয়ে মোকাম্মিলের দিকে তাকাল, তারপর বলল ‘ভাইয়া আপনার পাশে কী একটু বসতে পারি’। মোকাম্মিল সায় দিলে বসে পড়ল, একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে আমার দিকে চেয়ে বলল ‘চাচা কী ঢাকা পর্যন্ত যাচ্ছেন…’

আমার তখন মরমে মরে যাওয়ার অবস্থা…

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
মকাইশা মোকাম্মিল, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৯-১২-২০২২ | ২০:০১ |

    যাপিত জীবনের কথকতা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...