পুরাতন ভৃত্য কিংবা নতুন মোবাইল

মোবাইল ফোনে আমি টুকটাক লেখালেখি করি। প্রযুক্তির উৎকর্ষ আমাকেও প্রভাবিত করেছে। কলম আর কাগজের সঙ্গম যেন ভুলে গেছি, হয়তো বিশ্বাস করবেন না; চেষ্টা করে দেখেছি কাগজে লিখতে গেলে কলম চলে না, যদিওবা চলে পড়তে গিয়ে অক্ষর গুলো চিনতে পারিনা। হাতের লেখার এমন দুরবস্থা হয়েছে যে ব্যস্ত ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনও আমার চেয়ে সহজবোধ্য মনে হয়। চর্চার অভাবে হাতের লেখা মরে গেছে, মরে গেছে লেখার গতি।

মোবাইল অথবা আইপ্যাডে লিখতে যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি কাগজ-কলমে এখন আর তেমন স্বচ্ছন্দতা আসে না। অর্থাৎ কাগজ কলমে লিখে আগের মত আরাম পাই না। কাগজের বুকে সোনালী অক্ষরের জন্য মনটা কাঁদে; কিন্তু নিরুপায়। প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু ধ্বংস করে ফেলেছে, অনেক অকৃত্রিম জিনিস কৃত্রিম প্রযুক্তি গিলে ফেলেছে। যেমন ইচ্ছে করলেও শৈশবের পুকুরে সাঁতার কাটতে পারিনা কৃত্রিম ঝর্ণায় এখন মুক্তি খুঁজি।

মোবাইল ফোনে মাঝেমধ্যে লেখি, কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে আমার ফোনটা আগের মতো সাড়া দিচ্ছে না। আমি যে তালে আংগুল টিপে যাচ্ছি সে তালে অক্ষর গুলো স্ক্রিনে ভেসে উঠছে না। আমি ভাবলাম সমস্যা কী আমার না ফোনের। আমার বয়স পঞ্চাশের উপর শরীরের উচ্ছলতা অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। মনের উচ্ছলতা যদিও পনেরো-ষোলো বছরের কিশোরের মত তবু মোবাইল ফোন হয়তো আমাকে বৃদ্ধই ভাবছে।

মোবাইল ফোন আমাকে বৃদ্ধ ভাবছে ব্যাপারটা আমার অহং এ আঘাত করল। আমি বৃদ্ধ নই প্রমাণ দিতে মোবাইল ফেলে আইপ্যাডে লিখতে শুরু করলাম, দেখলাম আইপ্যাডের সাড়া মন্দ নয় আমার সাথে সমান তালে পাল্লা দিতে পারছে। বুঝা গেল মোবাইলে আমার বৃদ্ধত্ব সমস্যা না সমস্যাটা মোবাইলের।

হিসাব করে দেখলাম আমি বৃদ্ধ হইনি বৃদ্ধ হয়েছে মোবাইল। প্রায় পাঁচ বছর ধরে একই মোবাইল ব্যবহার করছি। তার যা নির্ধারিত আয়ু আমাকে সার্ভিস দিতে গিয়ে ব্যয় করে ফেলেছে। এখন সে আর আগের মত পাল্লা দিতে পারছে না। রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ পড়তে গিয়ে মনের ভিতরে যে বেদনা জেগেছিল এখন সে বেদনা অনুভব করছি। আমার প্রিয় মোবাইল প্রভুর বেদনা উপশম করতে গিয়ে নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিল। পাঁচ বছরের সাথী মোবাইলকে ফেলে দিতে হবে। তার সাথে যত সময় কাটিয়েছি নিজের স্ত্রীর সাথে ভাব, ভালোবাসায় তত সময় কাটাইনি। তাকে ফেলে দিতে ব্যথিত হচ্ছি কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার এর কোন উপায় নেই। বাস্তব হচ্ছে অচল মাল চলে না। মানুষ মানুষকে ফেলে যায়, পরিত্যাগ করে। একদিন আমাকেও হয়তো এভাবে কেউ ফেলে দেবে; আর মোবাইল তো এক নিষ্প্রাণ যন্ত্র, পরিত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোন সমাধান নেই।
আমার মোবাইল ঠিক মতো কাজ করছে না খাবার টেবিলে এমন কথা দুই একবার উচ্চারণ করেছি; দেখলাম কেউ কোনো সাড়া দিচ্ছে না। আমার পকেটের অবস্থা ভালো না কিছুদিন হলো দেশ থেকে ফিরেছি। ধার দেনা হয়ে গেছে এসব শোধ না করে নতুন মোবাইল কেনা সম্ভব না। ভেবেছিলাম স্ত্রী-সন্তানদের কেউ দয়াপরবশ এগিয়ে আসে; দেখলাম এই ব্যাপারটায় কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। পুনরায় ভাবনা মনে এলো আমি নিজেও কি বৃদ্ধ হয়ে গেছি, অচল হয়ে গেছি; আমাকেও কি ফেলে দেয়ার সময় এসেছে! পাত্তা না পেয়ে অভিমানে কাজে চলে গেলাম।

রাতে কাজ থেকে ফিরেছি, স্ত্রী যথারীতি খাবার নিয়ে হাজির। কোন ভনিতা ছাড়াই খাবার খেলাম। কথাবার্তা আজ আর তেমন এগুলো না। রাত বারোটার পরে টেলিভিশনের ক্রাইম পেট্রোল গিলে যখন ঘুমোতে গেলাম বালিশে মাথা রাখতে গিয়ে শক্ত কিছু অনুভব করলাম। স্ত্রীর সাথে ঝগড়ার ইচ্ছায় যেই চিৎকার দিতে যাব দেখলাম চৌকা একটা প্যাকেট বালিশে ঘুমিয়ে আছে। প্যাকেট খুলে আমি অবাক, নতুন মডেলের মোবাইল। আনন্দে চোখে জল এসে গেল।

কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার পরেই ছেলে মেয়ে এবং স্ত্রী মিলে পরিকল্পনা করেছে কিভাবে আমাকে সারপ্রাইজ দেয়া যায়। আমার ছেলে মেয়েরা বাংলা পড়তে পারে না, স্ত্রী ডিগ্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তে না পারলেও বাবার লেখালেখি যাতে নির্বিঘ্নে হয় সে ব্যাপারে সবসময় সচেষ্ট। আমি রাত জেগে লেখালেখি করলে স্ত্রী ঘুমোতে যাবার আগে কফি বানিয়ে যেতে ভুলে না।

পুরাতন মোবাইলে আগের মতো সার্ভিস দিচ্ছে না এটা তাদেরকেও চিন্তিত করেছে তাই লেখালেখি এবং অন্যান্য কাজ নির্বিঘ্ন করতে তৎক্ষণাৎ নতুন মোবাইল ক্রয় করে এনেছে। বাবার প্রতি ছেলে-মেয়েদের এমন ভালোবাসা পুনরায় আপ্লুত করেছে।

মানুষ হওয়ার একটা সুবিধা আছে এক মানুষ অন্য মানুষের জন্য মায়া, আদর, ভালবাসা অনুভব করে। ভালবাসার উপর বিশ্বাস রাখতে গিয়ে মনে হল, বৃদ্ধ হলে আমাকে হয়তো ফেলা হবে না আদর করে কবরে শুইয়ে রাখা হবে। পুরনো মোবাইলকে আমি ফেলে দিতে পারিনি, সযত্নে একটা কৌটায় রেখেছি; যেখানে আরো কিছু মূল্যবান জিনিষ রাখা আছে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
পুরাতন ভৃত্য কিংবা নতুন মোবাইল, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৬-০৭-২০২২ | ৭:৩১ |

    যাপিত জীবনের অনন্য এক কাহিনী উঠে এসেছে আপনার লিখায়। শুভেচ্ছা রইলো। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...