গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু, বাপ, দাদার আদি পেশা জুতা সেলাই; অর্থাৎ তারা মুচি। তার বাবা কাকারা চৌমুহনার মোড়ে ঝুপড়ি ঘরে বসে জুতা সেলাই করে।
মুচির ছেলের সাথে বন্ধুত্ব তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় সম্ভব ছিল না, এখনো সম্ভব নয়; তবুও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অবশ্য হওয়ার বিবিধ কারণ ছিল।
প্রধান কারণ হচ্ছে গৌরাঙ্গ ছিল দরাজ দিল, বন্ধুদের জন্য খরচ করতে কৃপণতা দেখাতো না। আমরা সপ্তাহে পাঁচ শিকা খরচ করতে পারতাম না, সে অনায়াসে পাঁচ সাত টাকা খরচ করে ফেলত। অন্য কারণের মধ্যে ছিল সে ভালো গান গাইতো, ভালো ছবি আঁকতো। পদ্য লেখায় তার বেশ মুন্সিয়ানা ছিল।
সে ছিল তার ঠাকুরদার আদরের নাতি। তাদের পরিবারের কেউ জীবনে স্কুলে যায়নি। জন্ম থেকেই তাদের জুতা পাঠ শেখানো হয়, অক্ষর পাঠ তাদের জন্য বিলাসিতা। গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা দেখলেন এই ছেলের জুতা পাঠে মন নেই, জুতা সেলাই করতে দিলে এই ছেলে সুঁই দিয়ে মাটিতে ছবি আঁকতে লেগে যায়। জুতা সেলাইয়ের চেয়ে গানে মনোযোগ বেশি, মুখে মুখে বেশ ভাল পদ্য বানাতে পারে।
ঠাকুরদা নাতির প্রতিভায় মুগ্ধ। ভাবলেন একে স্কুলে পড়াতে পারলে নিশ্চয় বংশের গৌরব হবে। চাই কি কালে কালে জজ ব্যারিস্টার হয়ে যেতে পারে। একদিন সন্ধ্যায় তিনি ঘোষণা করলেন নাতীকে তিনি স্কুলে পাঠাবেন; তাঁর এই অদ্ভুত ঘোষণায় গৌরাঙ্গের বাবা, কাকারা অবাক হল। স্কুল কেন আরেকটু বড় হলে তো পুরোদস্তুর রোজগারে লেগে যেতে পারবে। কিন্তু বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস তারা করল না।
স্কুলে ভর্তি হবে বললেই তো আর হলো না, মুচির ছেলে অন্ত্যজ জাত; অভিজাত যারা তারা নিশ্চয়ই চাইবে না মুচির ছেলে তাদের ছেলেদের সাথে পড়ুক। নাতিকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে গৌতমের ঠাকুরদা অনেক ঝামেলায় পড়লেন।
অনেক স্কুলে সিট নাই অজুহাতে ফিরিয়ে দেওয়া হল কিন্তু হাল ছাড়লেন না গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা। আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা, দেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে এসময় জাতপাত, উঁচু-নিচু চিন্তা করে আর বিভাজন বাড়ানো যাবে না। গৌরাঙ্গকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলেন। গৌরাঙ্গ তৃতীয় শ্রেণীতে আমাদের সহপাঠী হয়ে গেল। আমাদের কোনো কোনো অভিভাবক গাঁইগুঁই করেছিলেন বটে কিন্তু প্রধান শিক্ষকের প্রতাপের কাছে পরাস্থ হতে হল।
প্রধান শিক্ষক তাকে সাদরে গ্রহণ করলেন ঠিক, আমরা করলাম না। জুতা সেলাই এর ছেলেকে বন্ধু ভাবতে কোথায় যেন দ্বিধা থেকে গেল। অথচ আমাদের কারোরই বয়স দশ হয়নি।
সমাজ বাস্তবতা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, বোধে এমনিতেই এসে যায়। জুতা সেলাই যে অতি নিম্নমানের কাজ, মুচিরা যে অতি নিম্ন জাত দশ বছর হওয়ার আগেই এসব জেনে গেছি।
গৌরাঙ্গের সাথে কেউ মিশে না, পাশে বসে না, সে একেবারে পেছনের বেঞ্চে একা বসে থাকে। কিছুদিন পরে দেখা গেল তার হাতে অফুরন্ত টাকা। আমরা চার আনার বাদাম কিনতে পারি না, সে দিব্যি এক টাকার বাদাম কিনে ফেলে। বাদামের লোভে আমরা তার পাশে ভিড়লাম, সে আমাদের নিরাশ করল না; ভাগ দিতে শুরু করল। ক্রমে সে আমাদের বন্ধু, আমাদের একজন হয়ে গেল।
গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা বেশ মালদার ছিলেন, তিন পুত্রের রোজগারে তাঁর দিন ভালই কাটছিল। আদরের নাতির পকেট খরচের জন্য প্রতি সপ্তাহে দশ টাকা বরাদ্দ রেখেছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে তাদের বাড়িতে চোলাই বাংলা মদের আসর বসতো। ঠাকুরদা, বাবা, কাকারা একসাথে বসে মদ্যপান করত, কখনো কখনো মা, কাকীরাও সঙ্গ দিতে হাজির থাকতো। মদের আসরে বাচ্চাদের হাজির হওয়ার কোন বিধি-নিষেধ না থাকলেও গৌরাঙ্গের ঠাকুরদা তাকে কাছে ভিড়তে দিতেন না। মদ্যপান কিংবা বিড়ি-সিগারেট থেকে দশ হাত দূরে রাখতেন।
অচিরেই গৌরাঙ্গের অন্যান্য প্রতিভা আমাদের সামনে প্রকাশ হতে থাকল। গান, আঁকা, পদ্য লেখায় সে অনন্য ছিল। আন্তস্কুল বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সে স্কুলের জন্য সুনাম কুড়াতে লাগল। আমরা তার বন্ধু থেকে ভক্ত, গুণমুগ্ধে পরিণত হলাম। নেতৃত্ব দেওয়ার একটা সহজাত গুণ তার ছিল; একদিন লক্ষ করলাম সে আমাদের দলপতি হয়ে সামনে হাঁটছে, পিছন পিছন আমরা তাকে অনুসরণ করছি।
নবম শ্রেণী পর্যন্ত গৌরাঙ্গ আমাদের বন্ধু ছিল, দলপতি ছিল কিন্তু এর পরে তার প্রতি আমাদের মোহ ভঙ্গ হল। সে যে অন্ত্যজ শ্রেণী প্রমাণ রাখল। তার ঠাকুরদা কিংবা বাবা-কাকারা আদতে যে মুচি কোন সন্দেহ থাকল না।
রিতা রায়ের বাবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট। রীতা রায় সুন্দরী, স্মার্ট সে আমাদের প্রেমিকা। আমাদের প্রত্যেকের মনে রীতা রায় থাকে। এই রীতা রায় কে প্রেমের আহ্বান জানালো মুচির ছেলে গৌরাঙ্গ। রীতা রায় অবাক হলো ঠিকই কিন্তু উত্তেজিত হলো না কিম্বা রাগ করল না, শুধু গৌরাঙ্গ কে ডেকে বলল ‘এ হবার নয়’।
রীতা রায় রাগ করেনি কিন্তু আমরা ক্রোধে ফেটে পড়লাম, মুচির ছেলের এত সাহস রীতা রায় কে প্রেমপত্র লিখে। রীতা রায় কে প্রেমপত্র লেখার অধিকার একমাত্র আমাদের। মুচির ছেলের স্পর্ধার একটা হেস্তনেস্ত অবশ্যই হতে হবে। নিমিষেই ভুলে গেলাম সে আমাদের বন্ধু, গত কয়েক বছরে হাজার টাকার বাদাম সে আমাদের খাইয়েছে। ভুলে গেলাম আমরা তাকে দলপতি মেনে অনেক অসম্ভব কে জয় করেছি।
ইতোমধ্যে দেশে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে, সবকিছু নতুন করে শুরু করার স্বপ্ন নিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধা প্রধান শিক্ষক স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি অবসরে চলে গেছে। যে স্বপ্নবান পুরুষ স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে জাতিকে একটা দেশ উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে একদিন সূর্যোদয় হয়েছিল এখন স্থায়ী অমাবস্যা আসন গেড়েছে। আশা জাগানিয়া শুরু দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
আমাদের শহরের সবচেয়ে দুষ্টগ্রহ, মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে যে পাকিস্তানের লেজুড় ছিল সে এখন স্কুলের দায়িত্বে। ম্যাজিস্ট্রেটের মেয়েকে প্রেমপত্র লেখার দায়ে গৌরাঙ্গের বাবা-কাকারা জেলে। রাজাকার প্রধান শিক্ষক গৌরাঙ্গের ঠাকুরদাকে আসতে বলেছে। মুচির বাচ্চাদের পায়ের নিচে থেতলে দিতে হবে।
গৌরাঙ্গকে সাথে নিয়ে ঠাকুরদা এলে প্রধান শিক্ষকের কথায় রীতা রায় স্কুলের বারান্দায় থুতু ফেলেছে। গৌরাঙ্গ এবং তার ঠাকুরদা রীতা রায়ের থুতু চেটে খেয়েছে। মুচির বাচ্চার জন্য স্কুলের বারান্দা চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের গুস্সা প্রশমিত হওয়ায় বাবা চাচারা শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছে।
গৌরাঙ্গ তার বংশের জন্য সুনাম কুড়াতে পারেনি। সে এখন চৌমুহনার ঝুপড়ি ঘরে একমনে জুতা সেলাই করে। আমরা কখনও কখনও তার ঝুপড়ি ঘরে হাজির হই, জুতা পালিশ করতে সে কসুর করে না।
(সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)
loading...
loading...
যাপিত জীবনে অনন্য এক হৃদয়স্পর্শী লিখা।
loading...