একালের রামায়ণ

(নিছক রূপকথা নাও হতে পারে)

দশানন রাবণের দশ মাথার মতো পরেশ লালের দশ মাথা আছে বললে অত্যুক্তি হবে না, বরং রাবণের চেয়ে কয়েক মাথা বেশি হবে তার। দশবার আক্রমণের পরেও যে বহাল তবিয়তে থাকতে পারে তার প্রতি রাবণাশীর্বাদ আছে এটা অস্বীকার করার কোন জো নেই।

পরেশ লাল বারবার বেঁচে যায় এবং তার বেঁচে যাওয়া উদযাপন করতে গিয়ে একটি করে লাশ পড়ে। এই জনপদে পরেশ লাল সাক্ষাত রাবণ, সে এমন রাবণ যে যাবতীয় রাম তার ভয়ে কম্পমান।

রাজাও কিছু নিয়ম-কানুনে বন্দি থাকে, অত্যাচারী রাজাও চাইলে যে কারো মস্তক খণ্ডন করতে পারে না; তাকে কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যার মস্তক খণ্ডনের খায়েশ জেগেছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে হয়, পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে নিতে হয় প্রহসন হোক তবু বিচারের মুখোমুখি করতে হয়। এসব লোক দেখানো শেষ হলে তবেই না মস্তক খণ্ডন।

পরেশ লালের অত ধৈর্য নেই, অপেক্ষা তার দুচোখের বিষ; ওঠ ছেমড়ি তোর বিয়ের মত মস্তক খণ্ডনের খায়েশ হলে ততক্ষণাত কার্য সমাধা। অন্যের গড়িমসি দেখে নিজেই বেশ ক’বার মস্তক খণ্ডন করেছে।

পরেশ লাল ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দী নয় বরং স্বয়ং ঈশ্বর। জনপদে তার আদেশ অলঙ্ঘনীয়। জনপদের উপসনালয়ে ঈশ্বরের গুণকীর্তনের সময় পাওয়া যায় না, ঈশ্বরের মহিমা প্রচারে মানুষ বিমুখ এটা বলা যাবে না তবে পরেশ ঈশ্বরের ভয়ে মানুষ আসল ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ করতে পারে না।

আপনারা হয়তো ভাবছেন এসবই গাঁজাখুরি গল্প; বর্তমান সময়ে প্রকাশ্যে মস্তক খণ্ডন করে কেউ কী পার পেতে পারে! আপনাদের কাছে এসব অবিশ্বাস্য গল্প, অলস মস্তিষ্ক লেখকের বিকৃত চিন্তা। এসব গল্প অসত্য নাও হতে পারে।

আমাকে যখন প্রথম গল্প শোনানো হয় আমিও অসত্য ভেবেছিলাম, বর্ণনাকারী কে উন্মাদ ভেবেছিলাম। একজন মানুষ যতই উন্মাদ হোক না কেন তার চোখের ভয়ে কিছু সত্য লুকানো থাকে, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা মিথ্যার নিচে কিঞ্চিৎ সত্য না থাকলে বর্ণনাকারীর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।

আমি বর্ণনাকারী কে উপেক্ষা করতে পারতাম, উন্মাদের প্রলাপে মনোনিবেশ করার কোনো দায় আমার ছিলনা কিন্তু মানুষ হিসাবে আমিও কিঞ্চিৎ উন্মাদ। মিথ্যার আড়ালে যে সামান্য সত্য লুকিয়ে আছে তা উদঘাটনের কৌতুহল আমার জন্য কাল হয়েছে।

বর্ণনাকারীর জনপদ দেখার কৌতূহলে তার সঙ্গী হলাম, খবরের কাগজের একটা মোহর আমার কাছে ছিল ভাবলাম বিপদে এই মোহর উদ্ধার করবে।

জনপদে পৌঁছার দ্বিতীয় দিনে ঘটা করে আগুন খেলা হচ্ছিল, পরেশ লালের সাঙ্গাতরা রাধারানী নামে এক বিধবাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাধারানী স্বেচ্ছায় যাবে না তাই এই টানা-হেঁচড়া। ঈশ্বরের আদেশ লঙ্ঘন কত ভয়াবহ হতে পারে একটু ক্ষণ পরে টের পেলাম।

বিধবা রাধারানী স্বেচ্ছায় যাবে না টানা হেঁচড়া করতে গিয়ে সাঙ্গাতরা গলর্দম, যখন বোঝা গেল সহজে কর্ম সমাধা হবে না তখন সাঙ্গাতদের একজন রাধারানীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিল, ঈশ্বরের আগুনে রাধারানী পুড়ছে দেখে তাদের যে কি আনন্দ!

জনপদের মানুষ স্বাভাবিক, কি ভয়াবহ ঘটনা তাদের সামনে ঘটছে তারা বুঝতেই পারছে না অথবা তারা এসব ঘটনায় অভ্যস্ত। আমি অভ্যস্ত নই তাই দৌড়ে গেলাম, আমার দৌড়ানোতে সাঙ্গাতরা অবাক হল; কয়েকটা চড় থাপ্পড় মেরে আমার গলা চেপে ধরল দুজন সাঙ্গাত। চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল রাধারানী।

আমাকে যখন পরেশ লালের দরবারে হাজির করা হলো, লাল মহাশয় জিজ্ঞেস করলেন ‘কে বেটা তুই’?
জবাব দিলাম ‘আমি সাংবাদিক’।
‘কি সাংঘাতিক? আমিও সাংঘাতিক
কেমন সাংঘাতিক এক্ষুনি টের পাবি’।

পরেশ লালের আদেশে আমার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলা হলো, বাম চোখ অন্ধ করে দেয়া হলো। খবরের কাগজের যে মোহর আমাকে বাঁচাবে বলে ভেবেছিলাম, সে মোহর আমার শিশ্নে ঝুলিয়ে দেয়া হলো।

বর্ণনাকারী আমাকে উদ্ধারকারী ভেবে নিয়ে গিয়েছিল, ইতোমধ্যে যে দশজন ব্যর্থ হয়েছে তার কিছুই জানায়নি। যখন জানলাম তখন অনেক দেরী। তবু হতোদ্যম হলাম না, উন্মাদদের মৃত্যুভয় কিছুটা কম। বৃদ্ধাঙ্গুল বিহীন এক চোখ অন্ধ আমি শিশ্নের অপমান বরদাস্ত করতে পারিনি তাই দশের পরে পুনরায় চেষ্টা করলাম, বলাবাহুল্য রাবণ বধে আমিও ব্যর্থ।

আজ আমাকে বধ করা হচ্ছে। পরেশ লাল নিজ হস্তে আমার মস্তক খণ্ডন করবে। আমি ঈশ্বরের নাম জপতে থাকি কিন্তু দেখলাম ঈশ্বরের নাম স্মরণে আসছে না, আমার মুখ থেকে পরেশ লাল পরেশ লাল আওয়াজ বেরুচ্ছে…

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
একালের রামায়ণ, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৫-০১-২০২২ | ১৮:২৪ |

    একরাশ শুভকামনা প্রিয় কবি প্রিয় আবু মকসুদ ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. ফয়জুল মহী : ১৬-০১-২০২২ | ০:৪৪ |

    অজস্র ভালোবাসা ও শুভ কামনা রইলো আগামীর জন্য।

    GD Star Rating
    loading...