মোকাম্মিল বলল সে ভূত দেখেছে; আমরা অবাক চোখে তাকালাম। সে বলল গতরাত বাথরুমে যাওয়ার জন্য যেই উঠানে পা রেখেছে অমনি একটা ভূত টান দিয়ে লুঙ্গি খুলে দৌড়ে পালিয়ে গেছে। আমি বললাম ‘লুঙ্গি খুলে ফেলেছে, নিশ্চয় মেয়ে ভুত’! ফজল বলল ‘তুই ভূতের চেহারা দেখেছিস’? মোকাম্মিল বলল চেহারা ঠাওর করার আগেই পালিয়ে গেল।
বাবুল বলল ‘তুই ভয় পাসনি’?
‘না, আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফু দিয়েছি ভয় পাইনি’।
আক্কাস বলল ‘ভূত কি তোকে ছুঁয়েছে’? ‘
ছুঁয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না।
যদি ছুঁত তুইও ভুত হয়ে যেতি, তোর উপর ভূতের আছর পড়তো।
তাহলে বোধহয় ছোঁয়নি, আমি তো ভূত না। আমি মোকাম্মিল।
জমে উঠলো ভূতের গল্প কে ভূত দেখেছে। ভূতের কাছাকাছি এসেছে বলতে সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠলো।
ফজলের গল্প এরকম- খালার বাড়িতে বেড়াতে গেছে, সন্ধ্যা হয় হয়। খেলার মাঠ থেকে ফিরে পুকুরে গেছে হাত পা ধুতে, হাত পা ধুয়ে যেই ফিরে আসবে অমনি কে তাকে ধাক্কা মেরে পুকুরে ফেলে দিল। কে ধাক্কা দিয়েছে কিছু ঠাওর করতে পারল না। ভিজা কাপড় নিয়ে পুনরায় উঠে আসবে অমনি আবার ধাক্কা। তৃতীয়বারও সেই একই ঘটনা। খালু মাগরিবের নামাজ পড়ে ফিরছিলেন তিনি এসে তাকে পুকুর থেকে উদ্ধার করলেন। খালা তাকে সন্ধ্যার দিকে পুকুরে যেতে বারণ করলেন। খালাত বড় ভাইয়ের সাথে রাতে বিষয়ে আলাপ করলে তিনি জানালেন এ নিশ্চয়ই আব্দুলের ভূত বেশ কয়েকমাস আগে এক সন্ধ্যায় এই পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিল।
বাবুলের গল্পটা আরেকটু বিচিত্র। সে যে ভূত কে চিনে, সে বড় মায়াবী। মায়া কাড়া চেহারা তার। সে কাউকে ভয় দেখায় না, লুঙ্গি খুলে না, ধাক্কা দেয় না। বরং ফুল ছড়িয়ে দেয়। সে এলে ফুলের গন্ধে বাড়ি মৌ মৌ করে ওঠে। ঘটনা এরকম অনেকদিন আগে বাবুলের আম্মা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান, জ্ঞান ফিরলে তিনি বলতে থাকেন, রাবেয়া কে দেখেছেন। রাবেয়া তাকে অনেকগুলো ফুল দিয়ে গেছে। রাবেয়া বাবুলের বোন, অনেকদিন আগে হঠাৎ জ্বরে মারা গেছে। বাবুলের আম্মা ঘনঘন রাবেয়াকে দেখতে থাকলেন। আম্মার দেখাদেখি বাবুলও একদিন রাবেয়াকে দেখতে পেল। তাদের পাক ঘরের জানালার ওপাশে মান্দার গাছে বসে আছে। সে রাবেয়া বলে ডাক দিলে জানলা দিয়ে অনেকগুলো ফুল ছুড়ে দিল। বাবুল এখন প্রায়ই রাবেয়াকে দেখে।
আক্কাস বলল তার উপর ভূতের আছর আছে। তাদের বাড়ির পিছনে তেঁতুলগাছ। একদিন দুপুরে গাছে নীচে পাটি পেতে ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখল তেঁতুল গাছ দুলছে। গাছের দিকে তাকালে দেখল দৈত্যের মত একটা জন্তু গাছে পিঠ চুলকাচ্ছে। তার বিকট চেহারা, মুখ থেকে হাতির মত দাঁত বেরিয়ে এসেছে, রঙ কয়লার চেয়েও কালো। তার কপালে একটাই চোখ। সে বাবাগো বলে দৌড় লাগালে সেই বিকট জন্তু হাত লম্বা করা তাকে থামাল। বলল ঘাড় মটকে খাবে সে চিৎকার করে কান্না শুরু দৌড়ে এল তাদের পোষা কুকুর ভুলু। কুকুর দেখে ভূতটা পালিয়ে গেল।
আক্কাসের গল্প অদ্ভুত লাগছে। প্রথমত দিনের বেলা ভূত দেখা সম্ভব না। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কেউ দিনে ভুত দেখেছে বলে শোনা যায়নি। দ্বিতীয়ত একটা পুচকে কুকুরকে দেখে দানবের মত ভূত পালিয়ে গেল ব্যাপারটা বিশ্বাস যোগ্য না। আক্কাসকে বললাম তুই মিথ্যা বলছিস, সে আল্লাহর নামে কিরা কাটলো। তাতেও যখন বিশ্বাস করছি না তখন বলল ভুলুকে জিজ্ঞেস করে দেখ। ভুলুকে সাক্ষী মানলে আমাদের কিছু করার থাকে না, সে অতি অনুগত, বিশ্বস্ত কুকুর। আমাদের খুব ভালো বন্ধু।
তার কথা বিশ্বাস করা ছাড়া কোন উপায় থাকলো না, তবু একবার বলেছিলাম তুই নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছিস। সে এমন রাগ করল যে তা দেখে ভুলুও ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। আমি আর কথা বাড়ালাম না।
সবাই এবার আমার দিকে তাকালো, আমার ভূতাভিজ্ঞতা জানতে চাইলো। আমার কথা শুনে তারা নিরাশ হলো। আমি এখনো কোন ভূতের পাল্লায় পড়িনি। তারা আমার দিকে অবজ্ঞার চোখে চাইল। তাদের চোখ দেখে বুঝতে পারলাম ভূত দেখিনি অর্থাৎ আমার জীবন ষোল আনাই মিছে।
তাদের সবাই ভূতের অভিজ্ঞতা আছে আমার নেই, এই প্রথম বন্ধুদের কাছে আমার মাথা হেঁট হলো। জীবন অসার লাগলো। বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাতে লজ্জা হল। এগারো বছর বয়সেও ভূতের অভিজ্ঞতা হয়নি; এটাকে কি জীবন বলে!
যে করেই হোক ভূতাভিজ্ঞতা আমার হতে হবে। শুনেছি ভূত রাতের বেলা খাটের নিচে থাকে, আড়াই ফুটি পেত্নীকে কখনো-সখনো বাথরুমে দেখা যায়। এসডিও বাংলার দেয়াল ঘেঁষে যে বটগাছ তার ডালে ডালে নাকি ভূতের বাস। ভূতের খুঁজে সম্ভাব্য সব জায়গায় রাতে-বিরাতে হানা দেওয়া হল, ফলাফল শূন্য। ভূতের দেখা মিলল না, ভূত আমার সাথে মোলাকাতে রাজি হলো না।
আমি ঠিক করেছি ভূতাভিজ্ঞতা না নিয়ে বন্ধুদের কাছে যাব না। কিন্তু কিভাবে অভিজ্ঞতা হবে ভেবে কোন কুল পাচ্ছি না। কার কাছে একবার শুনেছিলাম গোরস্থান ভূতের বাড়ি, ভাবলাম গোরস্থানে গেলে নিশ্চিত ভূত পাওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
একদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে দরজা খুলে গোরস্থানের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। আধা মাইল দূরের গোরস্থানে পৌঁছে দেখলাম শুধুই অন্ধকার। কোথাও কোনো ভূত নেই, নিরাশ হয়ে ফিরে আসবো এমন সময় দেখলাম একটা কবরের কাছে আলো জ্বলছে আর নিভছে। হঠাৎ আলোয় দেখলাম ধোঁয়া উড়ছে। আলো লক্ষ করে কাছে পৌঁছালে দেখলাম চারজন লোক গোল হয়ে বসে তামাকের মত কি একটা টানছে, বাতাসে বদ গন্ধ। আমি যে তাদের এত কাছে চলে গেছি কেউ খেয়াল করলো না, আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম এই তোরা কি ভূত। আমাকে দেখে তারা ভূত দেখার মত চমকে উঠলো, তারপর যে যেদিকে পারে দৌড়।
ভূতের দেখা না পেয়ে ফিরে আসছি, হঠাৎ এক কবরে আমার পা আটকে গেলো। যতই উঠাতে চাই ততই দেবে যায়, শেষমেষ হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। আমি ভীতু না, খুব কম ভয় পাই কিন্তু কবরে ঢুকে ভীষণ ভয় পেলাম। কবর অবশ্য খালি কয়েকটা হাড় ছাড়া আর কিছুই নাই। অনেক চেষ্টা করেও উপরে উঠতে পারলাম না। কান্নাকাটি চিৎকার-চেচামেচি করেও কোন ফল হলো না। শেষমেষ হাড় গুলো একপাশে সরিয়ে ওখানেই শুয়ে পড়লাম।
সকালে আমাদের বাসায় হুলুস্থুল অবস্থা। ছেলে চুরি হয়ে গেছে, আম্মা ভাই-বোনদের কান্না শুনে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই হাজির, তারপর খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য পাওয়া গেল, প্রাতঃভ্রমণে বেরোনো একজন কবর থেকে উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। পরবর্তী কয়েক দিন বিড়ম্বনার মাঝে কাটল। বাসার দরজার লক বদলে গেল, চাবি চলে গেল আম্মার বালিশের নীচে। যে কোন দিন শাসন করার চিন্তাও করেনি আমার তিন বছরের ছোট ভাই সেও আমাকে শাষন করে গেল। এত ঝামেলার পরেও আমার ভূতাভিজ্ঞতা হল না, আফসোস…
loading...
loading...
স্বতন্ত্র ধারার লিখাটি পড়লাম প্রিয় কবি আবু মকসুদ ভাই।
loading...