কখনো কখনো দুপুরকে অসহ্য মনে হয়। মনে হয় বিলুপ্ত ফড়িংয়ের প্রতি যদি আরেকটু মায়া দেখানো যেত, ভয়ে লুক্কায়িত শালিকের প্রতি আরেকটু মানবিক হাত বাড়ানো যেত; তাহলে দুপুরগুলো এত অসহ্য হতো না।
আমাদের রাজত্বে সবারই নাভিশ্বাস। কুদালি ছড়ার তীর ঘেঁষে যে জনপদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে; আমরা তার একচ্ছত্র সম্রাট। আমাদের অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ শ্বাস ফেলতে পারে না। এই যে দুপুরের খাবার খেতে মতিউর শিকদার আসছেন; আমরা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। আমাদের অতিক্রম করতে হলে দু টাকার চকলেট তাকে দিতেই হবে। আমাদের চাহিদার বিপরীতে তিনি অসহায়, পাড়ার বুক চিরে যে রাস্তা তাকে বাসায় পৌঁছায় সেই রাস্তার মহারাজারা দাঁড়িয়ে আছে। রাজাদের সেলামি পরিশোধ না করলে দুপুরের খাবার অসমাপ্ত থেকে যাবে।
এমন না যে প্রতিদিনই আমরা রাজাগীরি ফলাতে যাই বরং অধিকাংশ দিন রাস্তার কিংবা জনপদের দখলত্ব আমরা ভুলে যাই। আমরা ব্যস্ত থাকি ফড়িং দিনে, কিংবা গুগলির নিশানায় শালিক দিনে।
যখন আমাদের কোনো কাজ থাকে না, যখন দুপুরগুলো কচ্ছপে পরিণত হয় তখন আমরা সম্রাট আওরঙ্গজেবের মত গর্দান খসাতে থাকি। আমরা চরম স্বৈরাচারী হয়ে উঠি।
গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটিতে কোন কোন দুপুর আমাদের জন্য আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়। আমরা চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুপুরের নিরানন্দ জংলা পাড়ি দেয়া। আমরা স্কুলে ফিরে যেতে মরিয়া হয়ে উঠি, অথচ স্কুল আমাদের পছন্দ নয়। স্কুলে আমাদের রাজত্ব চলে না; পাঁচ দিনের মধ্যে তিনদিনই ক্লাসের বাইরে নীলডাউন করে ঘণ্টা পার করতে হয়। তবুও বন্ধ্যা দুপুরের আতঙ্ক থেকে বাঁচতে স্কুলের জন্য প্রাণ আনচান করে।
স্বৈরাচারীত্ব মনে জ্বালা ধরাচ্ছে, বিনা প্রশ্নে আদেশ মেনে নিচ্ছে, উঠতে-বসতে সবাই সেলাম ঠুকছে। এসবই ফিকে লাগছে। সবাই যখন আমাদের তোষামোদিতে ব্যস্ত আমরা তখন মৃত ফড়িং কে ঘিরে কান্না করছি। তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। লুকিয়ে থাকা শালিকের কাছে মিনতি করছি অভিশাপ ফিরিয়ে নেয়ার। নিজেদের রাজত্বের বিনিময়ে আতঙ্কের দুপুর থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য কান্না করছি।
আমাদের প্রার্থনা যখন বিলাপে পরিণত হচ্ছে, কাকুতি শোনার গরজ দেখাচ্ছে না কেউ তখন ত্রাতা হয়ে সামনে আসে ‘মকাইশা’ দিন। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে, মনে হয় আমরা শীঘ্র পৌঁছাব।
‘মকাইশা’ দিনের জন্য নিজেদের বিক্রি করতে রাজি ছিলাম তার কাছে রাজত্ব বা রাজমুকুট তুচ্ছ। আমাদের রাজত্বে সাকুল্যে পাঁচটি চাপকল ছিল, প্রতিটি চাপকলের জন্য বরাদ্দ ছিল বিশ মিনিট। ‘মকাইশা’ মাথায় তারা অর্ঘ্য দিত। প্রথম চাপকল থেকে পরবর্তী চাপকলে যেতে সময় লাগত দশ মিনিট, এই দশমিনিট আমরা তার শিষ্য। সেনাপতির পিছনে সারিবদ্ধ সৈনিক দল, যুদ্ধ জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা।
একটু আগেই দুপুরের আতঙ্ক যে কান্না করছিলাম, নিমিষে কান্না উধাও। অনিন্দ্য সুখ ধারায় আমাদের মন প্রফুল্ল, সুখী নৃপতির মত পালকের আসনে বসে উপভোগ করতে থাকি কাঙ্ক্ষিত ‘মকাইশা’ দিন। ‘মকাইশা’ আনন্দের ফল্গুধারা, আতঙ্কের দুপুরে সুউচ্চ পাহাড় ফুড়ে প্রবাহিত মুক্ত ঝর্ণা।
(সত্তর আশির দশকে ‘মকাইশা’ নামে একজন লোক মৌলভীবাজারে ছিলেন, শহরের বিভিন্ন পাড়ায় হঠাৎ দেখা দিতেন। তার অদ্ভুত এক ব্যাতিক ছিল, চাপকল দেখলেই মাথে নীচু করে পানি ঢালতেন। শৈশবে তার মাথায় পানি ঢালার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই ছিল না। তাকে কেউ বলত পীর কেউ পাগল। আমাদের কাছে তিনি ছিলেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা)।
loading...
loading...
জীবনের গল্প। নিজেকে বা নিজের অনুভুতি মিলিয়ে নেবার যথেষ্ঠ অবসর।
loading...