আমি ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছানোর কাজ করি; ফুড ডেলিভারি ড্রাইভার। আমাকে রেস্টুরেন্ট এবং ক্রেতার সংযোগ ভাবতে পারেন। কাঁচা বাংলায় দালাল। গরু বাজারে, পাসপোর্ট অফিসে, হাসপাতালে এমনকি সচিবালয়ে আমার প্রজাতিকে পাবেন। তবে তাদের সাথে আমার ব্যবধান হচ্ছে আমি স্বীকৃতি প্রাপ্ত অর্থাৎ সব ধরনের আইন কানুন মেনে দালালি করি। দালালি থেকে আয়কৃত টাকা থেকে সরকারকে নিয়মিত কর পরিশোধ করি। বিনিময়ে কাজে থাকাকালীন সময়ে এবং কাজ বিহীন সময়ে সরকার আমার সুরক্ষা নিশ্চিত করে। আমাদের প্রজাতিকে লোকে ভাল চোখে দেখে না তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, অথচ বিপদে আমাদের স্মরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অনেকের কোন গতি থাকে না।
তবে আজকের গল্প দালালির নয় স্বীকৃত কাজের পুরস্কার এবং প্রসংসার। নামীদামী চেইন রেস্টুরেন্ট যেমন ম্যাকডোনাল্ড, কে এফ সি, বার্গার কিং, নানদোজ, সাবওয়ে, পিৎজা হাট, পিৎজা এক্সপ্রেস, কস্টা, স্টারবাকস, ক্যাফে নিরো ইত্যাদি আমাদের ক্লায়েন্ট, দিনে কয়েকবার এসব রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হয়।
দালাল হিসেবে এসব রেস্টুরেন্টে আমাদের কিছু অধিকার থাকে যেমন লকডাউন এর কারণে অন্য কেউ রেস্টুরেন্ট বাথরুম ব্যবহার করতে না পারলেও আমরা যখন ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারি। করোনার কারণে কাস্টমার ভিতরে ঢুকতে পারে না কিন্তু আমাদের ঢুকতে কোনো বাধা নেই। আমাদের বসার জন্য আলাদা জায়গা আছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার ছাড়াও অন্যান্য সুরক্ষা উপাদান আছে। তাছাড়া আমরা চাইলেই বিনামূল্যে যেকোন ড্রিংকস খেতে পারি। কফি, জুস, কোকোকোলা আমরা চাইলেই রেস্টুরেন্ট দিতে বাধ্য।
আমি সাধারণত যে ম্যাকডোনাল্ড থেকে খাবার সংগ্রহ করি তারা মোটামুটি পরিচিত হয়ে গেছে, হাই হ্যালোর পরেও দুচার বাক্যলাপ আমার এবং স্টাফের মধ্যে হয়। ষাট বছরের এক বৃদ্ধাকে গার্লফ্রেন্ড ডাকি নাম মিস ক্যারোলিনা, সেও আমাকে হানি বলে ডাকে। আমার বয়সের তিন সন্তানের মা। অন্যান্য স্টাফ তাকে এবং আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। আমি ক্যারোলিনাকে বলি ‘ইয়াং লেডি আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ’, সে সম্মতির হাসি হাসে।
গতমাসে একদিন ম্যাকডোনাল্ডে গেলে দেখলাম আমার গার্লফ্রেন্ডের মন খারাপ; কেন জিজ্ঞেস করলে জানাল সে অসুস্থ বোধ করছে, বললাম চলে যাচ্ছ না কেন? সর্ট স্টাফ; ম্যানেজারকে বলতে ভয় পাচ্ছি। ম্যানেজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আমি অনুদার হয়ে গার্লফেন্ডের অসুস্থতার কথা বললাম, কি ভেবে ম্যানেজার ছুটি দিতে রাজী হয়ে গেল।
আমার অর্ডার রেডি হতে কয়েক মিনিট বাকী আমার গার্লফেন্ড রেডি হয়ে এল, আমি বললাম যাবে কিভাবে। বললো বাসে চলে যাবে। বাসে যেতে প্রায় ৪৫ মিনিট লাগে। আমি বললাম চল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। বললো আরে নাহ, তোমার কাজ। আমার অর্ডার ক্যান্সেল করে দিলাম।
অনেকটা জোর করে তাকে গাড়িতে উঠালাম। কিছুদূর যাওয়ার পরে ক্যারোলিনা বললো সে বেশ অসুস্থ বোধ করছে তাকে হাসপাতালে নামিয়ে দিতে, দেখলাম বেশ জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে। আমি বললাম আচ্ছা। হাসপাতাল বেশি দূরে নয় কয়েক মিনিটে পৌঁছে গেলাম, দেখলাম সে তখনো জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হাসপাতালে ফটকে সে নামল বললাম সাথে আসবো নাকি। ক্যারোলিনা বলল; লাগবে না কিছুটা ভালো বোধ করছে। কাউকে ফোন করতে হবে কিনা জিজ্ঞেস করলে জানালো ছেলেকে টেক্সট করে জানিয়ে দিয়েছে।
তাকে নামিয়ে দিয়ে আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পরের এক সপ্তাহ ওদিকে যাওয়া হল না। ক্যারোলিনার খোঁজ খবর নেওয়া হলো না। এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ সেই ম্যাকডোনাল্ড থেকে অর্ডার আসলো। আমি ম্যাকডোনাল্ডে গিয়ে পৌঁছালে যে স্টাফ যেখানে ছিল ছুটে এল। সবাই আমাকে ধন্যবাদ দিতে থাকলো।
আমি কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, পিছন থেকে ম্যানেজার এসে হ্যান্ডসেইক করে একটা কাগজ আমার হাতে তুলে দিল। দেখলাম তাতে লেখা ‘থ্যাঙ্ক ইউ মাই ফ্রেন্ড ইউ সেইভড মাই মাদার্স লাইফ’। এরপরেও কিছু না বুঝলে ম্যানেজার বললো এ চিঠি ক্যারোলিনার ছেলে লিখেছে। কাজে থাকতেই ক্যারোলিনার স্ট্রোক হয়েছিল সময়মতো হাসপাতলে পৌঁছায় এ যাত্রা বেঁচে গেছে।
ম্যাকডোনাল্ডে আমার মূল্য অনেক বেড়ে গেছে, স্টাফ ম্যানেজার সবাই আমার খোঁজখবর রাখে যখন তখন ড্রিঙ্ক অফার করে। ম্যানেজার বলেছে যতদিন সে এখানে আছে আমি যা ইচ্ছা খাবার খেতে পারবো।
গত সপ্তাহ ক্যারোলিনা কাজে ফিরেছে আমাকে দেখেই দৌড়ে এল। আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল ‘আই এম রেডি ফর দি ম্যারেজ’। বলেই সে কি লাজুক হাসি! আমি বললাম ‘ইফ মাই ওয়াইফ লেট মি ম্যারি এগেইন, আই উইল ম্যারি ইউ’। ওকে হানি বলে পুনরায় আমার কপালে চুমু। তার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি, চোখে স্নেহ উপছে পড়ছে ।
loading...
loading...
যাপিত জীবনের অনন্য একটি অভিজ্ঞতা। শুভ কামনা প্রিয় কবি প্রিয় মকসুদ ভাই।
loading...
"আমাদের প্রজাতিকে লোকে ভাল চোখে দেখে না তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, অথচ বিপদে আমাদের স্মরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অনেকের কোন গতি থাকে না।"
একদম খাঁটি কথা। উচিৎ কথা। শুভকামনা থাকলো।
loading...