বিশ্রাম

ক’দিন ধরেই মা’র জ্বর। সারাদিন জ্বরকে সামাল দেন, রাতে হেরে যান। শরীরের তাপ বাড়ে। বিছনায় নির্জীব হয়ে পড়ে থাকেন। চোখ সামান্য খোলা, চোখের মণি মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে ওঠে। কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোন। না, ঘুমোন না। মা ঘুম আর জাগরণের মাঝে পেণ্ডুলামের মত দোল খান। দোল খেতে খেতে মাঝে মাঝে কুঁকড়ে ওঠেন, অস্ফুট স্বরে বলেন,
– মাহমুদা, পা’টা একটু টিপে দেরে মা..

মাহমুদা নেই। জ্বরের ঘোরে মা ভুলে যান। অভাবের সংসারে কেইবা থাকে! যতদিন সে ছিল মেয়ের মত হয়েই ছিল। মায়ের ভুল ভাঙাই না। মাহমুদা হয়ে পা টিপে দেই। মাথায় বিলি কাটি। ফিডিং কাপে করে পানি খাওয়াই। ওষুধ খাওয়াই। জ্বরের ঘোরেই তিনি জানতে চান,
– রোকন ফিরেছে! খেয়েছিস তোরা!

মাহমুদা হয়েই ছোট করে উত্তর দেই,
– হু।

ভোর হয়। মা জেগে ওঠেন, কিছুটা অপরাধীর মত করে বলেন,
– আজও জেগে ছিলি!
– হ্যা, তুমি আরেকটু ঘুমাও না হয়।

ঘুমের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে মা বলেন,
– রোকন, মাহমুদাকে কোনোভাবে ফিরিয়ে আনা যায় না!

কোনো উত্তর দেই না। মা জেগে উঠেন, আমার চোখে ঘুম নেমে আসে। রাতজাগার কারণে ঘুম গাঢ় হয়ে আসার কথা, আসেনা। ঘোর ঘোর ঘুমে শুধু চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে, মন জেগে থাকে। ওই ঘুমের মাঝেই ক’দিন ধরে একটা গল্প আসছে। লাইনের পর লাইন লিখছি, কাটাছেড়া করছি প্যারাগ্রাফ ঠিক করছি। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর গল্পটা আর মনে থাকে না।

দুপুরে মায়ের সাথে খেতে বসি। মা জিজ্ঞেস করেন,
– ছুটি শেষ হতে আর ক’দিন বাকী?
– ১১ দিনের মত।
– ও।

আমার পাতে একটুকরো তেলেপিয়া মাছ তুলে দিতে দিতে অনুনয়ের স্বরে বলেন,
– আমাকে ক’দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবি! ক’টা দিন থাকবো, বিশ্রাম নিবো। মনটা খুব টানছে।
– এই বর্ষায় যাবে? চারদিকে পানি আর পানি…

মা কিছু বলেন না। হঠাৎ করেই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়, স্বপ্নে লেখা গল্পটার প্রথম লাইন ছিলো ‘চারদিকে পানি আর পানি..।’ প্রতিটা লাইন এখন একের পর এক মনে পড়ছে। দ্রুত খেয়ে উঠে পরি। টেবিলে বসে লিখতে শুরু করি, ‘চারদিকে পানি আর পানি। অথৈ স্রোতের ঘূর্ণি…।’ লেখা চলছে তরতরিয়ে।

মা টেবিলে চা রেখে গিয়েছিলেন। খেয়াল করিনি। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মাথার ভেতর গল্পের অলিখিত অংশটা ভরে নিয়ে রান্নাঘরে যাই। নতুন করে চা রান্না করি। দুটো কাপে ঢালি। মা’র ঘরে যাই। মা ঘুমোচ্ছেন। শেষ বিকেলের নরম আলোর আভায় মা’র চেহারায় কোমল জ্যোতি, মায়ামায়া। চা খাওয়ার জন্য মা’র ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করেনা।

কোনো শব্দ না করেই কিছুক্ষণ পা টিপি। এরপর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বুঝতে পারি গল্পটা আর লেখা হবেনা। মাকে নিয়ে গ্রামে যেতে হবে। চারদিকে পানি আর পানি, এর মাঝে একখণ্ড শুকনো জমিতে মা’কে রেখে আসতে হবে, মা থাকবেন, মায়ের এখন অথৈ বিশ্রাম।

.
#বিশ্রাম
১০০৮২০২০

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
বিশ্রাম, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৯-০৩-২০২৩ | ২২:১০ |

    আপনার কোন লিখা পাঠ অর্থই হচ্ছে অসামান্য কিছু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...