ক’দিন ধরে শীত খুব বেড়েছে। রাত বাড়ে, শীতের আক্রমণ তীব্র হয়। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছি। লাল রংয়ের লেপ, শাদা কভার। মিঠে ওম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো, দেওয়াল ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা। ভীষণ সুনসান। ক’টা কুকুর বিলাপ করছে,
ভীষণ মর্মান্তিক সে বিলাপ!
কুকুরের বিলাপ থামছেই না। বিলাপের সাথে যেনো মিশে রয়েছে ভয়। পায়ের কাছের জানালা খুললেই রাস্তাটা দেখা যায়, ভয়ের কারণ খোঁজা যায়, বিভ্রান্তি দূর করা যায়। কিন্তু ওমের মায়া কাটিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না।
বিলাপ রূপ নিয়েছে গাঢ় কান্নায়। আর সহ্য হলো না, গা থেকে লেপ সরিয়ে উঠলাম। লাইট জ্বালাতে গিয়ে বুঝলাম ইলেক্ট্রিসিটি নেই। শব্দ না করেই জানলা খুললাম, এক ঝটকা বরফ হাওয়া হাঁড় কাপিয়ে ঘরে ঢুকলো। বাইরে ঘন কুয়াশা আর জোছনায় মাখামাখি, তিনটা কুকুর রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, একই দিকে তাকিয়ে বিলাপ করছে।
কুকুরের দৃষ্টি লক্ষ্য করে ওই গলির দিকে তাকালাম। দো’তলার জানলা দিয়ে গলির অনেকখানিই দেখা যায়। কুয়াশা ও জোছনার আবছায়াতে কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু কুকুরের কান্না থেমে গেলো। আরও কিছুক্ষণ জানলা খুলে রাস্তায় থাকিয়ে রইলাম। সব স্বাভাবিক।
লেপের ওম ডাকছে, লেপ মুড়ি দিয়ে শুতেই আবার কুকুরের ভয় পাওয়া করুণ বিলাপ শুরু। শুনশান মাঝরাত এ বিলাপ কৌতূহল রহস্য আর ভয়ের দোলাচালে অসহনীয় অস্থির। বিছানা থেকে উঠে দু’ঢোক পানি খেলাম। এরপর খুব কায়দা করে নিঃশব্দে জানালাটা অল্প একটু ফাঁক করলাম, সাথে সাথেই কুকুরগুলো আমার দিকে মুখ ঘোরালো- অকস্মাৎ এ কাণ্ড দেখে মূহুর্তের জন্য জমে পাথর হয়ে গেলাম, সে ওই মুহুর্তের জন্যই। একটা কুকুর একটু সামনে এগিয়ে এলো, কুর্নিশের ভঙ্গিতে দুই পা সামনে মেলে দিয়ে ফের উঠে দাঁড়ালো, তার কণ্ঠে আতংক,
– একটু নেমে আসো, দয়া করে একটু নেমে আসো।
– কেনো?
– এলেই দেখবে, তোমাকে বিপদে পরেই ডাকছি, দয়া করো..
– আগে বলো, শুনে নেই।
কুকুরের কণ্ঠে আঁকুতি-
– জীবন মরণ সমস্যা, তুমি তো মানুষ, আমরা বিপদে মানুষের কাছেই এসেছি।
নিজের প্রতি রাগ হলো, কেনো যে জানালা খুলতে গেলাম। কুকুরগুলো জানেনা পৃথিবীতে কোন বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠাও জটিলতম প্রক্রিয়া। আমাকে দেখে তারা বিভ্রান্ত, তাদের জানা নেই অবয়ব আর ঘ্রাণ এক হলেই সবাই মানুষ নয়। এর মাঝেই কুকুরটা ডেকে উঠলো,
– মানুষ, একটু নেমে আসো এখানে, করুণা করো।
ঘ্রাণ আর অবয়বের দায় মেটাতে এখন নামতে হবে। মানুষদের বিরক্ত হতে নেই, নকল হয়েও আসল মানুষের অভিনয় করছি, তাই বিরক্তি গোপন করে মোলায়েম স্বরে বললাম,
– অপেক্ষা করো, আসছি।
আভিজাত্যের চোরাটানে যদিও বলি দো’তলায় থাকি, আসলে এটা দেড়তলা। একটা মাত্র বড় ঘর, ঘর খুললেই বিশাল ছাদ। ছাদ পেরুলেই সিঁড়ি। ঘরের দরজা খুলতেই বিরক্তি দূর হয়ে গেলো- তীব্র ঠাণ্ডা আর ঘণ কুয়াশাতেও ঝকঝকে জোছনা, রোদের মত তীব্র নয়, প্রখর মসৃণ। সিড়ি দিয়ে সন্তর্পণে নেমে এলাম- শব্দহীন। কাঠের দরজা খুলে রাস্তায় বেরুতে যাবো, নিচের ঘর থেকে ভেসে এলো আব্বার কণ্ঠ,
– দরজা খুলেছে কে?
– আব্বা, আমি।
– ও। এতো রাতে দরজা খুললে যে! এই রাতেও কি মিছিল হয়!
– না, কুকুরগুলো কান্না করছে, একটু তাড়িয়ে দিয়ে আসি।
আব্বার কণ্ঠে প্রশ্রয়-
– যাও, কুকুর তাড়িয়ে এখনই চলে আসবে। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী মিছিলে যাও বলে ভেবো না বড় হয়ে গেছো। মনে রেখ – তুমি এখনো স্কুলের গণ্ডি পার হওনি।
আব্বাকে কিভাবে বলি, মিছিলের সব হাত সমান, সব কণ্ঠ সমান। বলতে হলো না, আব্বা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, আমি সদর দরজা দিয়ে পথে বের হতেই দরজায় খিল দিলেন। জানি, না ফেরা পর্যন্ত ঘুমাবেন না, এই ঠাণ্ডায় ছাদে পাইচারি করবেন, আকাশ দেখবেন। একটু পর আব্বাকে ডাকতে মা ছাদে উঠবেন, কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবেন, এরপর না ডেকে নিচে নেমে আসবেন। রান্নাঘরে চা বানাবেন, আব্বার সাথে আমিও ভাগ পাবো, ফ্লাস্কে চা থাকবে।
▪️
কুকুর ৩টা আগের জায়গাতেই বসে আছে, গলির দিকে তাদের চোখ, যেনো কিছু দেখছে কিন্তু সামনে যেতে সাহস পাচ্ছে না। ধীর পায়ে সামনে যেতে কুকুরদের মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা গেলো। একটা কুকুর, গায়ের রঙ সাদা-কালোয় মেশানো, হঠাৎ করেই জিভ দিয়ে হাতে চেটে দিলো। বিরক্তিকর, এতো পশুপ্রেমিক এখনও হয়ে উঠিনি, কিন্তু মানুষের মুখোশ মুখে পড়ে আছি বলে কিছু বললাম না। এবার লাল কুকুরটার গলায় আকুতি,
– গলির ভিতরে একটু যাও, নিম গাছের নিচে, করুণা করো, দয়া করো।
প্রাচীন নিম গাছটা নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত আছে- অস্বাভাবিক ভয়ের, ভৌতিক। স্বাধারণত, রাতের বেলা কেউ এই গলি দিয়ে যাওয়ার সাহস পায়না। একে নিমগাছের গল্প, সাথে নৈশব্দ নির্জনতা। ঘরের জানলা দিয়ে ওই গলি দেখা যায়, প্রতি রাতেই ওই গলির দিকে চোখ যায়। ল্যাম্প পোস্টে একটা টিউবলাইট টিমটিমিয়ে জ্বলে, চারপাশে অন্ধকার আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ওই আবছায়া অন্ধকারে এক মাঝরাতে ধ্বস্তাধস্তি হতে দেখেছি। পুরুষ কণ্ঠের চিৎকারে পুরো পাড়ার ঘুম ভেঙে গেল। কৌতূহলের দায়ে ঘুমের রেশ কাটিয়ে ক’জন হালকা চালে গলিতে পৌছানোর আগেই লোকটি চির বিদায় নিয়েছে। হামলাকারীদের পালাতে সমস্যা হয়নি, যেতে যেতে তিন চারটা ককটেল ফুটিয়েছে, কেউ পিছু নেয়নি। এছাড়া ওই গলি অস্বাভাবিক বা অস্বস্তিকর বা ভৌতিক কিছু দেখিনি বলে ভয় কেটে গেছে। কুকুরের আবেদনে সাড়া দিয়ে গলির দিকে পা বাড়ালাম।
▪️
গলির ভেতর ঢুকতেই গায়ে কাঁটা দিল, শাদা উলের সোয়েটারের বুকে লাল-কালো মিকিমাউজও যেনো কুকড়ে যাচ্ছে, এখানে শীত আরও তীব্র। মিকিমাউজটা ফিসফিসিয়ে বললো, ‘সামনে যেওনা, ঘরে চলো, শীত করছে।’ এমন ন্যাকামিকে সবসময় পাত্তা দিতে হয় না, নিম গাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। গাছ পর্যন্ত যেতে হলো না, বিভৎসতা পথ আগলে দাঁড়ালো। দুটো কুকুর ছানা, তুলতুলে, নির্জীব পরে আছে, মাথাগুলো কেউ কেটে নিয়ে গেছে। রক্ত ছড়িয়ে আছে, জমাট বাধছে। কুকুরগুলো পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, কুইকুই করছে।
লাল কুকুরটা এগিয়ে এলো, মৃত কুকুরগুলোর শরীর শুকলো কয়েকবার। এরপর সামনে এগিয়ে আরেকটা সরু গলিতে ঢুকে ডাক দিলো- ‘আসো’। এগিয়ে যেতে দেখলাম আরও তিনটা কুকুরছানা, শীতে আর ভয়ে কাঁপছে। ছানাগুলোকে ঘাড়ে ধরে তুললাম, কুকুরগুলো কিছুই বললো না। যেনো এমনই কথা ছিলো। গলি থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির পেছনে গেলাম, ওখানে ভাঙাচোরা আসবাবের নিচে ছানাগুলোকে নামিয়ে রাখলাম, বাতিল ন্যাকরা আর তয়লা দিয়ে ওমের ব্যবস্থা করা হলো। লাল কুকুরটা এদের মা, বাইরে বসে রইলো পাহারাদারের যেন। অন্য কুকুর দুটো এ পর্যন্ত আসেনি।
▪️
টোকা দেবার আগেই বাবা দরজা খুলে দিলেন। মা ঘরে ঢুকতে দিলেন না, চুলোয় গরম পানি বসিয়েছেন, গোছল করে তবেই ঘরে ঢুকতে হবে। সোয়েটারের মিকিমাউজ আৎকে উঠলো,
– এত শীতে গোছল করবে! ঠাণ্ডায় জমেই যাবো।
বিরক্তি নিয়ে বললাম,
– মনে হচ্ছে তুমিই এখন গোছল করতে যাবে। এমন ন্যাকামি করলে কিন্তু ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে আসবো, হু।
– সর্যি। আমি কি আর আমার জন্য বলি, তোমার জন্যই তো বলি।
– এত চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা, এত চিন্তা করা ভালো না।
মিকিমাউজের কণ্ঠে খুব কষ্ট,
– সাধে কি আর চিন্তা করি! বছরের সাত মাস তো বন্দী করেই রাখো, ওই সাত মাস কত চিন্তা মাথায় আসে।
– বলো কি! তারপর!
– কিন্তু মুক্তির দিন গুনতে গুনতে আয়েশ করে চিন্তাটাও করতে পারিনা, এখন শান্তিমত একটু চিন্তা করা প্র্যাক্টিস করছি, তুমি শুধু ‘ন্যাকামি’ বলে ধমকাচ্ছো।
কথা বাড়ালাম না।
গোছল শেষে বের হতেই মা ভিজে মাথা মুছে দিলেন, দোয়া পড়ে বুকে ফু দিলেন। বাতাসে আলু আর সিম দিয়ে ইলিশের তরকারির হালকা পোড়া ঘ্রাণ। মা একটু ভাত খেয়ে নিতে বললেন। সাদা ভাত, টমেটোর ডাল থেকে ধোয়া উঠছে, ঘণ তরকারির ঘ্রাণে বুঝতে পারলাম প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। মা ভাত বেড়ে দিলেন, তরকারি মাখিয়ে খাচ্ছি, বাবা পাশে বসে চা খাচ্ছেন। বাড়ির বাকীরা গাঢ় ঘুমে অচেতন, আমরা তিন নিশাচর জেগে থাকি, আমাদের ঘুম আসেনা অথবা আমরা ঘুমের কাছে যেতে পারিনা, যাওয়ার জন্য কাতরও হই না।
খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে ফিরলাম, হাতে ফ্লাস্ক ভর্তি চা। রাত ফুরোতে আর দেড়’ঘণ্টা লাগবে, এই সময়টা জেগে জেগেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। একটা গাড়ি খুব ধীরে ধীরে চলে গেলো, সম্ভবত টহল পুলিশের গাড়ি। গাড়ির শব্দের রেশ না কাটতেই কুকুরের চিৎকার কানে এলো। জানালা খুললাম- আগের দুটো কুকুরই গলির দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর আক্রোশে ঘেউ ঘেউ করছে। টেবিলের ড্রয়ারে রাখা আছে ফুটবল খেলার রেফারির হুইসেল বাঁশি, ওটা বের করে খুব জোড়ে বাজালাম। রাতের নির্জনতা ভেদ করে হুইসেল কতদূর গেছে জানিনা, তবে পুলিশ আর নাইট গার্ডরা হুইসেলের জবাবে হুইসেল বাজিয়ে যাচ্ছে।
জানালাটা আর বন্ধ করলাম না, ঘরে কিছু বরফহিম হাওয়া ঢুকুক। ছাদে এলাম, জোছনা ম্লান হয়ে এসেছে। তেলের পুরানো ড্রামে লাগানো গাছ থেকে শিউলি ঝরছে। শেষ রাতের আশকারায় শীত বাড়ছে।। জ্যাকেট খুলে ছাদের মাঝখানে দাঁড়ালাম, ঠকঠক করে কাঁপুনি শুরু হলো, এতেই না কুয়াশা স্নানের আনন্দ। শীত বাড়ছে… বাড়ছে… বাড়ছে…। একটা শিউলি ফুল ব্যাথাতুর স্বরে জানতে চাইলো,
– ঝরবে না কি আমাদের মত।
– জানিনা, ফুল।
– ক্লাশ টেইনকে জানো!
– কোন ক্লাশ টেইন?
– যে একদিন তোমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো, বলতে না পেরে চলে গিয়েছিলো।
– না, জানিনা। সে কি বলতে চেয়েছিলো!
– বাহ! বুঝোনি তুমি?
– না বললে বুঝবো কেমন করে!
শিউলি ফুলের বুক ফুড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো,
– এ এমন কথা যা না বলেও বলা যায়, যে বুঝে সে বুঝে, যে বুঝতে পারেনা, এ কথা তার জন্য নয়।
– ওহ! কি জানি কিসের কথা বলছো!
শীতে জমে যাচ্ছি, জমতে জমতে বরফ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে- ধবধবে শাদা গাঢ় জমাট বাধা বরফ, যে বরফের গলে যাওয়া নেই, যে বরফ গলেনা কখনো ক্লাশ টেইনের মায়াবী উষ্ণতায়।
▪️
#মনসুখিয়া
loading...
loading...
মনসুখিয়া গল্প গ্রন্থ নিয়ে আমার ভীষণ আগ্রহ রয়েছে। গ্রন্থটির কিছু গল্প অনলাইনে পড়ার সুযোগ হলেও পূর্ণ গ্রন্থ সংগ্রহে রাখবার ইচ্ছে আমার আজও অবদমিত হয়নি। শুভেচ্ছা রইলো মি. আবু সাঈদ আহমেদ।
loading...
চমৎকার লেখনী দিয়েই শীতের রিক্তটি।
loading...