১.
ডিসেম্বর, ১৯৯১। কলেজে ছুটি চলছে। শীতের দুপুরগুলো খুব দ্রুত বিকেলে গড়ায়। এমন এক হবো হবো বিকেলে ল্যাণ্ড ফোন বেজে উঠলো, রিসিভার কানে দিতেই প্রিয় কণ্ঠের ফিসফিস-
: হ্যালো, নটরডেম?
: ভিকারুননিসা! এই অসময়ে তুমি!
: সবাই ঘুমোচ্ছে। কোচিং নেই। তাই ফোন দিলাম।
: তাই বলো– একদিন শীত দুপুরে আমরাও এমন ঘুমাবো আর আমাদের মেয়ে..
কথা শেষ করার আগেই ভিকারুননিসার লাজুক কণ্ঠ–
: ইশশ! শোনো নটরডেম, কাল একবার বেইলি রোডে আসবে?
: কেনো গো?
: কতদিন তোমাকে দেখিনা, প্লিজ কাল আসো। তোমাকে না দেখলে ঠিক ঠিক মরে যাবো। আসো প্লিজজজজ…
: আহা রে! কটায় আসবো?
: শার্প সাড়ে তিনটায়। আর শোনো, স্কাই ব্লু জিন্স, হোয়াইট পুলওভার গেঞ্জির সাথে ছাইরঙা ব্লেজারটা পরে আসবে। চুল ভালো করে ব্রাশ করবে– মনে থাকবে!
: মনে থাকবে। কিন্তু শেরোয়ানি পড়ে এলে ভালো হতো, তাই না!
: শখ কত!! ফাজিল একটা। চুপ।
: আচ্ছা চুপ করলাম কিন্তু।
: ঢং কত! নটরডেম, আমি কি পড়ে আসবো বলবে?
: ভিকারুননিসা, তুমি গরু রচনাটা পড়ে এসো, ইংরেজীতে দ্য কাউ।
ঢাকা কলেজের এক সিনিয়র গরু যেভাবে তোমার পিছনে লেগেছে! গরু সম্পর্কে জানা থাকা দরকার..
: হিহিহি, আচ্ছা, তাই করবো। কাল দেরী কোরোনা– এক মিনিট দেরী হলে আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।
২.
বিকাল তিনটা। বেইলি রোড। নটর ডেম অপেক্ষারত। ভিকারুননিসা আসে তিনটা বিশে। ফাস্টফুডশপে মুখোমুখি দুজন–
: ভিকারুননিসা, আকাশী আর শাদা কম্বিনেশনের কার্ডিগানটা বেশ সুন্দর তো! গর্জিয়াস।
: আব্বু আয়ারল্যান্ড ট্যুরের সময় এনেছিলেন। আজ প্রথম পড়লাম। সত্যি সুন্দর?
: হ্যা, সুন্দর।
: আমি কি সুন্দর নই?
: না, তুমি সুন্দর নও।
ভিকারুননিসার মন খারাপ হয়, স্বরে অভিমান এনে বলে-
: তবে কে সুন্দর?
: ‘কে’ সুন্দর জানিনা। ‘কি’ সুন্দর জানি।
: কি সুন্দর বলো নটরডেম?
: আমার বিছানাটা জানালার পাশে। রোজ সকালে একফালি রোদ তেরছাভাবে বিছানার কোনায় লুটিয়ে পড়ে। আর কিছু অংশ ফ্লোরে। সে রোদ সুন্দর।
: ওহ! আর?
: ছাদের রেলিংয়ে পিপড়ার সারি দেখেছো! সারি ছেড়ে দুই একটা পিপড়ার এলোমেলো ছোটাছোটি, তারপর দলে মিশে যাওয়া– পুরো ব্যাপারটাই সুন্দর।
: তাই? আর কি সুন্দর শুনি–
: আবার আকাশের অনেক উঁচুতে চিলের গোল হয়ে উড়া সুন্দর। কাশবনে জোতস্না, নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে গলে যাওয়া চাঁদ, তুমুল বৃষ্টিতে নীরব পথ ধরে হাটা, জোনাকীর আলো, বৃষ্টি ধোয়া সবুজ পাতায় শুঁয়াপোকার অলস চলন, গাছের ডালে ফড়িংয়ের ধ্যান, প্রজাপতির চঞ্চল নাচানাচি, মেঘের চলন, বিকালের মায়াময় ছায়া– সব সুন্দর।
: আর কিছু নেই?
: আছে, এমন কি তোমার কপালে নেমে আসা কয়েকটা অবাধ্য চুল– অবর্ণনীয় সুন্দর।
: এখানেই শেষ?
: চারদিকে সুন্দরের এত ছড়াছড়ি, ক’টার কথা আর বলবো!
: বাহ! বাহ! তোমার কাছে পিপড়া সুন্দর, চিল সুন্দর, কিলবিলে শুঁয়োপোকাও সুন্দর। আর আমি বিশ্রী?
নটরডেমের স্বরে মায়া ঝরে —
: ভিকারুননিসা, তুমি সুন্দর নও। বিশ্রীও নও।
: তবে আমি কি! আজ সত্যটা বলতেই হবে। না বললে ঠিক ঠিক মরে যাবো, হু।
: তুমি সকালের রোদ নও, রোদের উষ্ণতা। শুধু অনুভব করা যায়, ভালোলাগাটা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।
: ইশশ! আর?
: তুমি বৃষ্টি বা নীরব পথ নও, তুমি বৃষ্টিতে নীরব পথে ভেজার অপার আনন্দ।
: আর কি কি — সব বলো..
: তুমি দলছুট পিপড়ার চঞ্চল ছোটাছুটির মত সুন্দর নও– তার আপন দলে মিশে যাবার আকুল পিছুটানের গভীরতা। তুমি অরণ্যের নির্জনতা, বেলী ফুলের ঘ্রাণের তীব্রতা, ভোরের শিউলি আভার মাদকতা।
: নটর ডেম, এভাবে আমাকে ভাবো! আমাকে খুব ভালোবাসো, তাই না!
: আমরা কেউই কাউকে ভালোবাসি না।
: আমি তোমাকে ভালোবাসি.. বাসি..বাসি।
: না, তুমিও আমাকে ভালোবাসো না।
: তবে?
: আমরা আসলে যুদ্ধ করছি, দুজন দুজনকে জয় করার। আপন করে পাবার। এ এক অন্যরকম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয় নেই, হয় ড্র না হয় পরাজয়।
: নটর ডেম, আমি এই যুদ্ধে আমি হারবো না, তুমিও হেরোনা প্লিজ। তুমি হারলে আমি ঠিকঠিক মরে যাবো।
: তুমি থেমে যেওনা। যুদ্ধ শেষ হবার আগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে নিজেকে গুটিয়ে নিওনা। মনে রেখো– সব যুদ্ধ থেমে যাওয়া মানে শান্তি নয়। কিছু কিছু যুদ্ধ থেমে যাওয়া মানে অসহ্য যন্ত্রণা আর অশান্তি।
: আমি যুদ্ধে হারবো না। জানি তুমি আমাকে হারতে দিবে না।
: কেউ হারতে চাইলে কি আর তাকে আটকে রাখা যায়!
: ধ্যাত! বাজে কথা বলোনা। ঐ গানটা একবার গুনগুন করে গাও না প্লিজ-
নটর ডেম গুনগুন করে গাইতে শুরু করে–
You fill up my senses like a night in the forest,
like the mountains in springtime, like a walk in the rain,
like a storm in the desert, like a sleepy blue ocean.
You fill up my senses, come fill me again.
Come let me love you, let me give my life to you,
let me drown in your laughter, let me die in your arms…
৩.
হঠাত সেদিন–
ফেসবুক ইনবক্স।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, কেমন আছো? ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট না করলেও, প্লিজ ব্লক কোরো না।
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, কথা বলো প্লিজ। তুমি এখনো রেগে আছো?
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটর ডেম, প্রতিটা ম্যাসেজ সিন হচ্ছে। মানে তুমি পড়ছো। ঠিক করেছো উত্তর দিবেনা!!
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
শোনো নটর ডেম, এ মাসের লাস্ট উইকে দেশে ফিরছি। অক্টোবরের চার তারিখে বিকাল চারটা থেকে সাতটা পর্যন্ত বেইলি রোডের সুইসে অপেক্ষা করবো। জানি তুমি আসবেনা, তবুও অপেক্ষা করবো। যদি হঠাত তোমার ইচ্ছা হয়, যদি আসো।
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, তোমার কন্টাক্ট নাম্বারটা দিবে! আমার সেল নাম্বার ০১৭৫*******। ৪তারিখের কথা ভুলে যেওনা প্লিজ।
০৩ অক্টোবর, ২০১৬
কাল বিকেল চারটায় সুইসে থাকবো। আমার কন্টাক্ট নাম্বার আবার দিলাম ০১৭৫*******।
প্লিজ, এসো, ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।
৪.
৪অক্টোবর, মধ্যরাত, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার।
: নটর ডেম, শেষ পর্যন্ত এলেই না। অথচ একদিন এক পলক দেখার জন্য কত ছটফটানি ছিলো।
: কে বললো আসিনি!
: এসেছিলে?? সত্যি!
: হুম। জামদানি শাড়িতে তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছিলো। তোমার বয়স ততটা বাড়েনি।
: ক’টা পর্যন্ত ছিলে?
: তুমি আমার সামনে দিয়েই সাড়ে সাতটায় মুখ কালো করে চলে গেলে। আমি আরো আধঘণ্টা ছিলাম।
: দেখা করলে না কেনো?
: তুমি দেখা করার কথা বলোনি, শুধু আসতে বলেছিলে।
: ধ্যাত! এটা কি আলাদা করে বলতে হবে?
: অবশ্য বললেও দেখা করতাম না।
: কেনো? জানতে পারি?
: না, পারো না।
: ও। আচ্ছা। এতোটা কাছে– তবু দেখা না করে থাকতে পারলে?
: হাহাহাহাহা
: কান্না পাচ্ছে। তুমি হাসছো কেনো– এটা জানতে চাইতে পারি?
: হ্যা পারো-
: বলো।
: মাত্র তিন বছর না যেতেই তুমি খুঁজে পেলে রাজপুত্র। হঠাত করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলে। কোনো কিছু জানাওনি। একবার দেখা করে বললে আমি তোমাকে আটকাতাম না। তীব্র কষ্ট পেতাম, সে কষ্ট আড়াল করে হাসিমুখে মেনে নিতাম।
: সর্যি, এক্সট্রিমলি সর্যি..
: ফোনেও কোনো কথা বলোনি, আমার স্বর শুনলেই লাইন কেটে দিয়েছো। এক একটা দীর্ঘ দিন আর দীর্ঘতম রাত কেটে গেছে শুধু এটুকু আশা করে যে তুমি একবার ফোন দিবে, একবার অন্তত বলবে তুমি আর আমার নও। একবার শুধু তোমার গলার স্বর শুনবার ছছটফটানি। সেই তুমি দুই যুগ পরে জিজ্ঞেস করছো ‘দেখা না করে থাকতে পারলাম!!’ হাহাহাহা, কোয়াইট ফানি!
: সর্যি, নটরডেম। এভাবে বলো না।
আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।
: ‘সর্যি’ হবার মত কিছু আর আজ অবশিষ্ট নেই। তুমিময় একটা ডাইরি ছিলো, সেটা তো দু’বছর আগেই ফিরিয়ে দিয়েছি।
: তুমি এখনো রাগ পুষে আছো?
: নাহ! মনসুখিয়ার যাত্রীকে রাগ পুষে রাখতে নেই। রাগ পুষে রাখলে অভ্রজোনাক পথ ভুলিয়ে দেয়, দূরে সরে সরে যায়।
মনসুখিয়ায় অভ্রজোনাকের কাছে পৌছতেই হবে– এ আমার একার যুদ্ধ।
: মনসুখিয়া কোথায়– জানতে চাইতে পারি?
: হ্যা পারো।
: মনসুখিয়া কোথায়?
: বলতে ইচ্ছে করছেনা।
: ওহ! অভ্রজোনাক কে?
: বলবো না।
: অভ্রজোনাক কি আমি?
: নো, নেভার। তুমি এখন যে কোনো একটা নাম– এর বেশী কিছু নও।
: তবু একবার, শুধু একবার তোমার সাথে দেখা করতে চাই। উত্তর দাও প্লিজ..
: আমি আর কোনো উত্তর দিবোনা। গুড বাই। ভালো থেকো। আর সাবধান– ডানহাতের বুড়ো আঙুলে ব্যাথা পাওয়া কাজের কথা নয়।
: এই ব্যান্ডেজও খেয়াল করেছো?
নটরডেম আর কোনো উত্তর দেয়না। রাত গভীর হয়, হাভানা সিগারের গাঢ় ধোয়া পাক খেয়ে খেয়ে হাওয়ায় মিলায়।
৫.
মনসুখিয়ায় যাবার পথ নটর ডেমের চেনা নেই, অভ্রজোনাকের মনের ঠিকানাও অজানা। দিনের শেষে রাত আসে, ফের দিন। একদিন রাতশেষে দিন আর আসবেনা— ইশ! তার আগেই যদি যাওয়া যেত মনসুখিয়ায়–হীরকফুলের আলোয় আলোয়, অভ্রজোনাকের কাছে অভ্রজোনাকের পাশে।
মনসুখিয়ায় যাবার আগেই যদি ফুরোয় দিন; ওগো রাতের হাওয়া, নটরডেমের হয়ে অভ্রজোনাকের কানেকানে বলে দিও–
Hell is living without your love
Ain’t nothing without your
Touch me
Heaven would be like hell
Is living without you…
.
__________
#মনসুখিয়া/২৬
loading...
loading...
নটরডেম ভিকারুননিসা এবং মনসুখিয়া। এক একটি ভালোলাগা নাম।
loading...
আপনি সত্যিকারার্থের বিশ্লেষক মুরুব্বী আজাদ ভাই।
loading...
ভীষণ সুন্দর একটি অণুগল্প আপনার। শুভেচ্ছা হরবোলা আবু সাঈদ ভাই।
loading...
শুভেচ্ছা কবি সুমন ভাই।
loading...
অভাবনীয় সুন্দর একটি লেখা।
loading...
আপ্লুত হলাম কবি রিয়া।
loading...
অভ্রজোনাক কি আমি?
: নো, নেভার। তুমি এখন যে কোনো একটা নাম– এর বেশী কিছু নও।
===================জলময়ূর ভালোবাসাটুকুই যে দেবার আছে




loading...
loading...
উফ অদ্ভুত সুন্দর
ভালো লাগায় মন ভরে গেলো
loading...
loading...
মনসুখিয়ায় যাবার আগেই যদি ফুরোয় দিন; ওগো রাতের হাওয়া, নটরডেমের হয়ে অভ্রজোনাকের কানেকানে বলে দিও …. অদ্ভুত ফিনিশিং লাইন।
loading...
অনেক খুশি হলাম সাজিয়া আফরিন।
loading...
শিরোধার্য কবি আবু সাঈদ আহমেদ ভাই।
loading...
আনন্দিত হলাম কবি সৌমিত্র ভাই।
loading...
তবু আমি কিছুই করতে পারিনা-কিছুই না।
আমি নির্বাক চেয়ে থাকি , যেন চেয়ে থাকাটাই এখন অনেক বড় একটা কাজের মধ্যে পড়ে।
loading...
খাঁটি কথা ভাইজান।
loading...
চমৎকার।
loading...
ধন্যবাদ কবি শাকিলা তুবা।
loading...
আপাতত পোস্টটি অর্ধেক পড়ে রাখলাম,বাকীটা রাতে পড়ে পুরো মন্তব্য দিবো ভাই।
loading...
আচ্ছা ঠিক আছে।
loading...
ভালোলগলো ….
loading...
ধন্যবাদ।
loading...
নটরডেম খোঁজে নি অভ্রজোনাক
যেতে চায় নি মনসুখিয়ায়
প্রেম কখনও বোঝেই নি ভিকারুননিসা
আসলে ভিকারুননিসারা প্রেম বোঝে না
তবুও গোলাপের মাঝে থেকেও বেলির ঘ্রাণ নিতে চায় এখনো একবার………
চমৎকার
ইশশ
একবার যদি নটরডেম জীবনে ফিরে যাওয়া যেত!!
loading...
ধন্যবাদ ভাইজান। আমরা কেউই আর নটরডেম জীবনে ফিরতে পারবো না।
loading...
চমৎকার হয়েছে সাঈদ ভাই। সত্যিই আমিও যেন ছিলাম সেখানে উপস্থিত।
loading...
তাই তো আপনার মতো কাউকে যেন দেখলাম আসিফ আহমেদ ভাই।
loading...
গল্পটা শেষ না হলে ও পারতো নেশা লাগা গল্প পড়তেই ইচ্ছে করে। শুভ সকাল প্রিয় আবু সাঈদ আহমেদ ভাই।
loading...
শুভসকাল কবি পারভেজ ভাইজান।
loading...