অণুগল্প: ছায়ামিতি

ছায়ামিতি

চৈত্রমাস প্রায় শেষ। মাঝ রাত। ঝেপে বৃষ্টি এসেছে। বর্ষণের একটানা ঝিঝিম শব্দ। পায়ের কাছের জানলা খুলে দিতেই ঘরে ভিজে বাতাসের হুল্লোড়। পা ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি রেণু।

জম্পেশ ঘুম হবে। চোখ বন্ধ করে গুণগুণ করছি। হঠাত কনকনে গলা-
: ছাদে গিয়ে মন ভরে ভিজলেই পারো। রাতের বৃষ্টিতে আগে তো খুব ভিজতে!

বিষ্ময়ে চোখ খুলি- বুকের উপরে বসে আছে ছেলেবেলার জ্যামিতি বক্স। লালশাদা। তাতে সোনালী নকশা। বক্স হতে কম্পাস বেরিয়ে এলো-
: বিন্দু চেনো?
: হ্যা, চিনি।
: হি:হি:হি: মডেল বিন্দুর কথা বলছি না। জ্যামিতির বিন্দু চিনো!
: বেশ চিনি। যার অবস্থান আছে কিন্তু কোনো দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও বেধ বা উচ্চতা নেই তাকে বিন্দু বলে। বিন্দু হলো শুন্য মাত্রার সত্বা।

কম্পাস হেসে দিলো-
:আংশিক সঠিক। বিন্দু হলো শূন্য মাত্রার সত্তা। তবে শুন্য মাত্রার আপেক্ষিক সত্তা।
: শূন্য- সেও আপেক্ষিক! হবে হয়তো!
: অবশ্যই আপেক্ষিক। প্রতিটি মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার কেন্দ্রটাই হলো বিন্দু। ইচ্ছে হলে কেন্দ্রবিন্দুও বলতে পারো।
: তাই না কি? জানতাম না।
: ধরো, দাঁড়িয়ে আছো আপন বিন্দুতে অটল। সূর্যালোকে সকালে ছায়া হবে লম্বা। দুপুরে পায়ের কাছে গুটিসুটি, বিকেলে বিষন্ন বিস্তার…
: এ তো সবাই জানে!

কম্পাস হাই তুললো-
: হুমম। এসব সবাই জানে, কিন্তু ছায়ামিতি জানেনা।
: ছায়ামিতি! সে কেমন?
: মানুষ তার আপন বিন্দুকে কেন্দ্র করে বৃত্ত আঁকলে তার ছায়ার সমান দীর্ঘ হয়। আর সময়ের মাপ মতো মানুষের সীমানা ঠিক ততটুকু বিস্তৃত। একদিন মানুষ চিরদনের জন্য চলে যায়, সাথে নিয়ে যায় তার সকল ছায়া।এরপর হতে আর কোনো গুঁটিশুটি নেই, নেই বিষন্ন বিস্তার।

জ্ঞানবাক্য সহ্য হচ্ছেনা, রুঢ় হলাম-
: এসব শুনতে ভালো লাগছে না, অন্য কিছু বলো?
: এই এক সমস্যা। তোমার কখন কি শুনতে যে ভালো লাগে!

কম্পাস উদাস গলায় বলে চলে-
: প্রতিটি মানুষ তার এক জীবনে লক্ষ লক্ষ বৃত্ত আঁকে। প্রতিটি সম্পর্কের অসংখ্য স্বতন্ত্র বৃত্ত আছে।
: প্রতিটি সম্পর্ক কি বৃত্তে সীমাবদ্ধ?
: হ্যা। ইচ্ছে করলেই কেউ টুপ করে বৃত্তের বাইরে চলে যেতে পারেনা, পৃথক বৃত্তে হুট করে প্রবেশ করতেও পারেনা।
: মাঝরাতে এসব শোনাতে এসেছো?

কম্পাস হাওয়ায় বৃত্ত আঁকে, লম্বা শ্বাস নেয়-
: ইশকুলে তোমার গণিত ভালো লাগতো না। তেত্রিশ পেলেই খুশি। অথচ জ্যামিতিতে অসাধারণ ছিলে। ক্লাশ টেনের ফাইনাল পরীক্ষায় শুধু জ্যামিতির উত্তর দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলে- কবিতা লেখার জন্য।
: হুম। কাঠবলদ ছিলাম। বোকামী করেছি। কবিতা নয়, পরীক্ষার নাম্বার অমূল্য,- তখন বুঝিনি।
: অবশ্যই বোকামী। তবে কবিতা আর জ্যামিতির প্রতি তোমার ভালোবাসায় খাদ ছিলো না। বোকাদের ভালোবাসা এমন নিখাঁদই হয়।
: তাই বুঝি! এমন কথা কখনো শুনিনি।
: এবার তো শুনলে। তোমার বৃত্তে সঞ্চিত ভালোবাসার টানেই এসেছি।
: তুমি ভালোবাসার টানে এসেছো! প্রিয়তম মানুষরা কেউ আমার কাছে আসবে না!
: তা জানিনা। লক্ষ লক্ষ বৃত্তগ্রস্থ মানুষের যে অনেক অনেক হিসেব-নিকেশ, বৃত্তের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য বন্ধন আর সীমানা..
: তাতে কি! মানুষই তো বৃত্ত ভাঙে, ভাঙে না?

কম্পাসের হাসি আর থামেনা- : তা যা বলেছো!! বৃত্ত ভেঙে মানুষ বৃত্তের ভিতরেই ফিরে আসে।

বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। বক্স হতে চাঁদা চেঁচিয়ে উঠলো –
: ওরেএএ কম্পাস! কাজের কথাটা শেষ করো। বৃষ্টি বাড়ছে – সে খেয়াল আছে?

বর্ষণমুখর রাতে কম্পাস চাঁদা সবাই বলতে শুরু করেছে। মহীয়সী খনা বেঁচে থাকলে বচন দিতেন – “যদি বর্ষে চৈত্রের শেষ/জ্যামিতি বক্সের কথায় রাত্রি শেষ।” কম্পাস খুক খুক করে কেশে নিলো-
: এবার আসল কথাটা বলি- তুমি বৃত্ত মানোনা- সে তোমার ব্যপার। কিন্তু তুমি বৃত্তের রাজ্যে শোরগোল বাধাতে পারো না!
: আমি আবার কখন শোরগোল বাধালাম?
: তুমি অভ্রজোনাককে মুঠোয় পুরতে চাও মমতায়- বেশ কথা। অভ্রজোনাক মনের বৃত্ত ভেঙে মুঠোর বৃত্তে আসবে কি? একবারো ভেবেছো!
: নিজের বৃত্ত ভেঙেছি। আলোর লোভে অভ্রজোনাকের বৃত্ত তো আর ভাঙি নাই।
: কিন্তু ভাঙা বৃত্তের টুকরো-টাকরা নিয়ে অভ্রজোনাকের বৃত্তসীমানায় ঢুকে পরার আশায় জিরো ল্যান্ডে উদ্বাস্তুর মত বসে আছো। এতে অভ্রজোনাকের ভীষণ অস্বস্তি হয়- জানো!
: জানবো না কেন? বেশ জানি। অস্বস্তিকে পাত্তা না দিলেই হয়…

এবার কম্পাস একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে-
: জ্যামিতি বেশ ভালো বুঝতে। একটা বৃত্ত আর একটা বৃত্তের সীমানায় ঢুকে পরলে দুটো বিন্দুতে ছেদ করে- এফোঁড়ওফোঁড় করে যায়- মনে আছে?
: মনে থাকবেনা কেন! বেশ মনে আছে।
: তোমার বৃত্তের ঘায়ে অভ্রজোনাকের এফোঁড়ওফোঁড় হবার ভয়..
: কি যে বলো! অভ্রজোনাক অপন বৃত্তে বিভোর।

কম্পাস আড়মোড়া ভাঙে, হাই তোলে। গভীর মায়ায় তার কন্ঠ আর্দ্র-
: একদিন, ধরো কোনো একদিন, অভ্রজোনাক আপন বৃত্তের সীমানা প্রাচীর তুলে নিলো।
: তাতে আমার কি?
: তুমি তোমার সকল বৃত্ত নিয়ে ঢুকে পোরো। জেনো, অভ্রজোনাকের হাতের রেখায় মনসুখিয়ার জলছবি আছে, আর চোখে রাজ্যপাট।
: প্রিয় কম্পাস, তুমি কি জানো- কবে খুলবে অভ্রজোনাকের সীমানা প্রাচীর?

কম্পাসের আচানক কি ব্যাস্ততা-
: বাইরে বৃষ্টি। এখনই যেতে হবে। চাঁদা কেমন তারা দিচ্ছে- দেখছো না!
: প্রশ্নের উত্তরটা পেলাম না?
: হয়তো খুলবে একদিন। অথবা কোনদিনই খুলবেনা। তাতে কি! তুমি তো ওর বৃত্তের সীমানায় উদ্বাস্তু হয়ে দিনযাপন করছোই। তোমার আগে কে আর বলো বৃত্ত ভাঙার খবর পাবে!

ক্লাশ টেন, প্রিয় থার্ড বেঞ্চ, জ্যামিতিবক্স সব হাওয়ায় মিলেমিশে যায়। বাইরে শেষরাতের ঝিঝিম বৃষ্টি। বৃত্তের কেন্দ্রে পরে থাকি– একা। জানি মনসুখিয়া আমাকে ডাকেনা- তবু বৃষ্টির একটানা ঝিঝিম শব্দ ভেদ করে মনসুখিয়ার ডাক শুনতে পাই। বিভ্রমও এত প্রিয় হয়! এত মধুর!!

__________________________________
#ভিন্ন মাত্রার গদ্যগ্রন্থ: মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১০ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১০-০৫-২০১৯ | ১০:৫৪ |

    অসাধারণ কনসেপ্ট মি. আবু সাঈদ আহমেদ।

    GD Star Rating
    loading...
  2. সুমন আহমেদ : ১০-০৫-২০১৯ | ১২:১২ |

    চমৎকার প্রিয় হরবোলা আবু সাঈদ ভাই। 

    GD Star Rating
    loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১০-০৫-২০১৯ | ২২:৫৫ |

    অনন্য সাধারণ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. রিয়া রিয়া : ১০-০৫-২০১৯ | ২৩:২২ |

    ভীষণ সুন্দর আপনার লেখা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. শাকিলা তুবা : ১১-০৫-২০১৯ | ০:১০ |

    অসাধারণ সুন্দর গদ্য।

    GD Star Rating
    loading...