কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া?
১.
জোষ্ঠের কাঠফাটা রোদ। হাওয়া নেই। পুরোন শহর। চারদিকের ঘিঞ্জি পাড়া। মাঝে বিশাল বেঢপ মাঠ। বটের ছায়ায় গামছা পেতে শুয়ে আছেন বৃদ্ধ লেইসফিতাওলা। খেলনা একতারের বেহালায় সুর তুলছেন বেহালাওলা-
“মন ডোলে মেরা তন ডোলে,
মেরে দিল কা গায়া কারার রে;
কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া…!!”
প্রতিদিন এই মাঠ পেরিয়ে, বট পেরিয়ে ইশকুলে যায় একলা বালক। ঠিক একা নয়, সাথে থাকে ক্লাশ এইটের ছ’ পিরিয়ডের বইখাতায় পূর্ণ ব্যাগ।
২.
চারদিকে থৈ থৈ রোদ। শুধু বটতলায় ছায়ার সংসার। শান্ত নরম। বালকের স্যান্ডোগেঞ্জি ঘামে ভিজে জবজবে। ভাতের মাড় ও নীল দেয়া শাদা শার্ট শরীরে লেপ্টে আছে। বটের নেমে আসা ঝুড়ি ফিসফিসিয়ে বলে-
: বাবু, একটু দাঁড়াও, ছায়ায় জিরোও-
: আমার যে ইশকুল আছে, হেটে হেটে যেতে হবে আরও পনেরো মিনিট-
: পাঁচ মিনিট থাকো, তারপর পা চালিয়ে যেও, ঘণ্টা পরার আগেই পৌছে যাবে। দুটো কথা জিজ্ঞেস করি?
: বলো- কি কথা তোমার?
: এই যে বেহালাওয়ালা বাজাচ্ছে কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া?– তুমি কি জানো বাঁশীর সুর বাজায় কে?
: বাহ রে! আমি জানবো কেমন করে!
: তোমার ইতিহাস, বিজ্ঞান, পাটিগণিত কোনো বইয়ে লেখা নেই!–কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়ার উত্তর।
: হাহাহাহা বইয়ে এসব থাকে না কি! বইয়ে স্যার নিউটন আছেন, ঐকিক নিয়ম আছে, সম্রাট বাবর ও রবার্ট ক্লাইভ আছেন, রবীন্দ্রনাথ নজরুল বন্দে আলী মিঞা আছেন, এ প্লাস বি হোল স্কয়ার আছে- কিন্তু কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়ার উত্তর তো নেই!
: উত্তর নেই! থাকাটা খুব দরকার ছিলো। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বইয়ে লেখা আছে —- বাজায়ে বাঁশুরিয়া।”
: সে তো আমি জানিনা-
: জেনে আমায় জানিও, এখন ইশকুলে যাও-
বালক ইশকুলের পথে দ্রুত পা চালায়। গলার কাছে তখনও অক্ষত ছোপ ছোপ কিছু শাদা পাউডার- মায়ের স্নেহের টেরাকোটা। ঘামে ভিজেও না মুছে যাওয়া কারুকাজ।
৩.
চার তলার লম্বা করিডোর।শেষ মাথায় বিশাল ক্লাশরুম। থার্ড পিরিয়ড- ইংরেজী ব্যাকরণ ক্লাশ। রিয়াজউদ্দীন স্যার ভয়েস চেইঞ্জ- পড়াতে পড়াতে জানালা দিয়ে আকাশ দেখেন। খা খা নীলাকাশ, মেঘহীন। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, বিড়বিড় করেন- “জীবন একটা প্রেজেন্ট পারফেক্ট কন্টিনিউয়াস টেন্স। পারফেক্টনেসের জন্য সবাই দৌড়ায় আর দৌড়ায়। এদিকে ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষে ঘষে দিন ফুরিয়ে যায় রে আমার দিন ফুরিয়ে যায়…।” টিফিনের ঘণ্টা শোনার অপেক্ষায় ক্লাশ এইট বোঝেনা কিছু। শুধু বালকের মাথায় প্রশ্ন ঘোরে – কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া!!
৪.
টিফিন পিরিয়ড। দুই টাকায় কেনা যায় একটা ঢাউস বাটারবান কিংবা ক্রিমরোল। অথবা এক পিস স্লিম কেক। শাদা বা কমলা রংয়ের নারকোলি মালাই আইসক্রীম আর দপ্তরী চাচার ঝালমুড়ি পাওয়া যায় এক টাকায়। বরফ কুচি তারা, মাছ, ছাতার সাচায় চেপে তাতে বিভিন্ন রং আর চিনির সিরাপ ঢেলে বানানো আইসক্রীম দুটাকা। বালককে প্রলোভন ডাকে, টিফিন পিরিয়ডের অভ্যস্ত ক্ষিধে ডাকে। বালক নির্বিকার- টিফিনের বরাদ্ধ দুটাকা কিছুতেই খরচ করা যাবেনা। তিন দিন টিফিন না খেলেই পাঁচ টাকায় একতারের বেহালা কেনা যাবে। খা খা রোদে পথে পথে বেহালা বাজিয়ে খুঁজবে- কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া!
৫.
একতারের বেহালা পোষ মানে নি। বহুদিন বালক সুর তোলার কসরত করেছে। সুর ওঠেনি- বিভতস ক্রন্দন ছাড়া। ভেঙে যাবার আগে একতারের বেহালা মাঝরাতে হাই তোলে-
: মনা, তোমার জন্য ত্রিকোনমিতি, বেহালা নয়।
: ত্রিকোনমিতির সূত্র কি জানে বাঁশী বাজায় কে?
: না, ত্রিকোণমিতি এসব অর্থহীন প্রশ্নের উওর জানে না। সব কাজের জিনিস জানে।
: তুমি এমন করে বলছো কেনো?
: মনা, পড়ালেখায় মন দাও। বুড়ো বট সেই কবে থেকে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে- পাচ্ছে না। তুমিও পাবেনা- শুধু কষ্ট পাওয়াই সার।
বালকের হাত হতে বেহালা মাটিতে গড়ায়। চৌচির হবার আগে অস্ফুট স্বরে বলে- “তবে চললাম মনসুখিয়ায়, বিদায়।”
বিমূঢ় বালকের চোখে চিকচিক করে ওঠে অশ্রু- জানলা গলে ল্যাম্পপোস্টের বাতির ছিটকে আসা একটুকরো মিহিন আলো অশ্রুতে থমকে থাকে।
৬.
বালক এখন মাঝবয়সী। দিনমজুর। কলম পিষে কেরানীগিরির। এক একটা দুপুরে বুড়ো বট ডাকে, প্রশ্ন করে-
: জেনেছিলে কোন বইয়ে উত্তর আছে?
: বই-তে উত্তর নেই, অভ্রজোনাকের পাখায় আছে।
: অভ্রজোনাক কোথায়! ডাকো তাকে, দুটো কথা কই..
: অভ্রজোনাক আছে মনসুখিয়ায়। সে তো আসেনা। তার কাছেই যেতে হয়–
: তুমি গিয়েছিলে? জেনেছো উত্তর?
: না, যাইনি। সবগুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষায় আছি-
: কার অপেক্ষা? কিসের অপেক্ষা?
: অভ্রজোনাকের ডাকের অপেক্ষায় আছি। সে ডাক পাঠালেই ছুটে যাবো মনসুখিয়ায়…
: সে কি ডাকে না তোমায়?
: মনে পরলে ঠিক ঠিক ডাকবে- দেখে নিও। ততদিন অপেক্ষাযাপন-
বুড়ো বট রিয়াজউদ্দীন স্যারের মত দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বিড়বিড়িয়ে বলে- দিন ফুরিয়ে যায় রে আমার দিন ফুরিয়ে যায়! বটের দীর্ঘশ্বাস মাঝবয়সী বালকের মাথা ছুঁয়ে লিলুয়া বাতাসে ভেসে ভেসে মনসুখিয়ার দিকে ধায়, বিষ্মিত কৌতূহল নিয়ে- “অভ্রজোনাক, কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া? তুমি!”
_____________________
#মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।
loading...
loading...
অসাধারণ অণুগল্প হরবোলা ভাই।
loading...
ধন্যবাদ সুমন ভাই।
loading...
ভীষণ ভালো লাগার মতো একটি লিখা পড়লাম আবু সাঈদ আহমেদ ভাই।
loading...
ধন্যবাদ সৌমিত্র ভাই।
loading...
বটের দীর্ঘশ্বাস মাঝবয়সী বালকের মাথা ছুঁয়ে লিলুয়া বাতাসে ভেসে ভেসে মনসুখিয়ার দিকে ধায়, বিষ্মিত কৌতূহল নিয়ে- “অভ্রজোনাক, কৌন বাজায়ে বাঁশুরিয়া? তুমি!”
মনে গেঁথে রাখবার মতো একটি লিখা। গ্রেট।
loading...
ধন্যবাদ আজাদ ভাই।
loading...
মুগ্ধতা একরাশ।
ভাল থাকুন প্রিয়।
loading...
ধন্যবাদ শেখ বাবু ভাই।
loading...
অনেক অনেক লেখার ভীড়ে আপনার অণুগল্পই সেরা।
loading...
ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...
ভালো লিখা।
loading...
ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...