খবিশ যিশু

খবিশ যিশু

মেজাজ চরম খারাপ। টানা ১৫ ঘণ্টার কাজ সাইরা ফিরতাছি। যখন হাইওয়েতে নামলাম মোবাইলের ঘড়িতে রাইত ১২:৪০ বাইজা গেছে। আরও একঘণ্টার পথ যাইতে হইবো। হাইওয়ে টু জেলা শহরের লিংক রোডে একটাই বাস। হেল্পার চিল্লাইতাছে লাস টিপ… লাস টিপ… (লাস্ট ট্রিপ)। বাস আছে দেইখা মেজাজ কিছুটা ঠাণ্ডা হইলো। কিন্তু সিগারেটে দুইটা টান দিয়া বাসে উইঠা ড্রাইভারের চেহারা দেইখা মিজাজ আবার চরমতম খারাপ হয়া গেলো।

এই ষাটোর্ধ ড্রাইভারের চেহারা চিনি। যারা আমার মত নিয়মিত বেশী রাইতে ফিরেন তারা বাধ্য না হইলে তার বাসে উঠেন না। কারন ড্রাইভার সাহেব নির্লিপ্ত খবিশ প্রকৃতির। মাঝ রাইতেও সিট পূর্ণ হইবার পরে রড পূর্ণ হইবার অপেক্ষায় বইসা থাকেন। সিটের যাত্রীরা বাস না ছাড়ার কারনে গালাগালি করলে বা নাইমা গেলেও বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নাই। রড পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বাস ছাড়বেন না।

৫৬সিটের বাস অর্ধেকও পূর্ণ হয়নি, অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছি সিট পূর্ণ হওনের জন্য আরও বিশ মিনিট আর রড পূর্ণ হওনের জন্য আরও একঘণ্টা লাগবো। এক্কেবারে ‘সাগর যেদিকে চায় অভাগা শুকায়া যায়’ পরিস্থিতি।

মেজাজ খারাপ কমানির জন্য বিভিন্নজনের বিভিন্ন তরিকা আছে। আমার তরিকাটা একটু আজীব কিসিমের। যে কারনে মেজাজ বিগড়াইছে আমি তার মধ্যে মজা বা পজিটিভ কিছু খুঁইজা বাইর করি। যেমন পকেট মারিং হইছে, মেজাজ খারাপ না কইরা ভাবি অন্তত একজন পেশাগত দক্ষতা দিয়া কিছু টাকা অর্জন করছে। তো চরমতম খারাপ মেজাজরে ঠাণ্ডা করতে মাঝের সিট ছাইড়া বাসের সামনের বা সাইডের লম্বা সিটে বসলাম। যাতে খবিশ ড্রাইভার সাহেব আর তার কাজকাম পর্যবেক্ষণ করতে পারি।

ড্রাইভারের একটা চোখ ঘোলা। গলায় সস্তা মাফলার। মাথায় শাদা টুপি, কিছুটা নোংরা। গায়ে হাতকাটা খয়েরি সোয়েটার। শাদা শার্টের কলার আর ফুল হাতা বাইড়ায়া আছে। বাম হাতে সিকো ঘড়ি, ঘড়িরও বহুত বয়স হইছে বুঝা যায়। ডাইন হাতের দুই আঙ্গুলে দুই আংটি, একটা আকিক আর অন্যটা সম্ভবত মুন। যতদূর জানি জৌতীষ মেজাজ আর মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য মুন পাথর প্রেসক্রাইব করেন। মুন পাথরের দেখি বস্তুগুণ কড়া– এই লোকরে পুরা নির্লিপ্ত খবিশ বানায়া ফেলছে।

বাসের সিট পূর্ণ হইছে। এখন রড ধইরা দাড়ায়া যাওনের যাত্রীর অপেক্ষা। সিটের যাত্রীরা বাস ছাড়ার জন্য ড্রাইভাররে তাগাদাসূচক গালি দিয়া যাইতাছে। নিয়মিত যাত্রী গো গালির ঝাঁঝ আরও বেশী। আমিও চিল্লাইলাম তবে ভিন্ন সুরে ‘বুড়া ড্রাইভারও বাড়িতে যাইবো। হের ঘরেও বউ পোলাপান আছে। শখ কইরা কেউ এই বয়সে আধা রাইত পর্যন্ত গাড়ি চালায় না। যাগো তারা আছে তারা নাইমা গেলেই পারেন।’ এইবার কিছু গলা থাইমা গেলো, আর কিছু গলা ড্রাইভারের লগে আমারেও টার্গেট করলো। ড্রাইভার একবার আমার দিকে চাইতেই একটা অমায়িক হাসি দিলাম আর মনে মনে উচ্চারণ করলাম ‘খবিশ’।

যথারীতি রড পূর্ণ হওনের জন্য ড্রাইভার বইসা রইলেন। বাইরে হেল্পার চিল্লাইতাছে ‘লাস টিপ…. লাস টিপ….’ চলছে, ভিতরে বাস ছাড়ার তাগাদাসূচক গালি চলছে। খবিশ ড্রাইভারের কোনো ভাবান্তর নাই। শুধু দুই তিনবার আড়চোখে আমারে দেখলেন। তিনি রড আর দরজা’র স্পেসটা ভর্তি হওনের পরে বাস ছাড়লেন। বাসের ভিতরটা পুরা নীরবতায় বদলায়া গেলো যেনো জাতিসংঘের বিশ্বশান্তি অধিবেশন শুরু হইছে।

খালি রাস্তায় তুমুল গতিতে বাস ছুটছে। হেডফোনে একের পর এক দিল তামাম করা গজল বাজছে। আমার স্টপেজ আসার পরেও নামলাম না। আইজ লাস্ট স্টপেজ পর্যন্ত যামু। খবিশ ড্রাইভাররে জিগামু প্যাসেঞ্জারগো কষ্ট দিয়া কি আনন্দ পান! প্যাসেঞ্জাররা যে গালিগালাজ করে তা কি তার কান দিয়া ঢুকে না! আইজ তার কাছ থেকা কিছুটা নির্লিপ্ততার পাঠ নিমু।

লাস্ট স্টপেজ লঞ্চ ঘাটায় বাস থামলো। মাঝরাইতেও লঞ্চ ঘাটের আশপাশ জমজমাট, হোটেল আর টং দোকানগুলি খোলা। বাস থামতেই যাত্রীরা দ্রুত নাইমা গেলেন। হেল্পার একটা বিড়ি ধরাইলেন। আর জনাব খবিশ নামলেন সবার পরে আমার পিছে পিছে।

বাস থেকা নাইমা হ্যাণ্ডশেকের জন্য ড্রাইভারের হাতের দিকে হাত বাড়ায়া দিলাম-
: আসসালামু আলাইকুম, চাচা একটা কথা আছিলো।

অভ্যাসবশেই তিনি হাত বাড়ায়া দিছিলেন, কিন্তু সালামের জবাব দিলেন না, চেহারা পুরাই নির্লিপ্ত-
: কি কথা?
: এই যে সবসময় প্যাসেঞ্জার গো দেরী করান, সিটিং সার্ভিসরে রডিং সার্ভিস বানান, আপনের সমস্যাটা কি!
: সমস্যা আবার কি! আমারটা আমি করি, আপনের কি?
: আমার কিছুই না। শুধু জানবার ইচ্ছা করতাছে আপনারে যে প্যাসেঞ্জাররা গালিগালাজ করে তা খারাপ লাগে না?
: খারাপ লাগবো না ক্যান! লাগে। কিন্তু গালিগালাজের কাম করি বইলাই তো তারা গালিগালাজ করে।
: বাহ! গালিগালাজের কাম না করলেই পারেন?
: তাতে তো পেট চলবো না।
: মানে! গালিগালাজ খায়া পেট ভরান!!

তিনি নির্লিপ্ত হয়া কয়েক সেকেণ্ড তাকায়া রইলেন। তারপর নির্লিপ্তভাবে কইতে শুরু করলেন-
: সবাই গাইল পারে, জানতে তো চায় না কেউ। আপনের জাননডা খুব দরকার!
: হ, খুব দরকার।
: ছয় বচ্ছর আগে ডেরাইবারি ছাইড়া দিছিলাম। দুই বচ্ছর আগে রোড এক্সিডেন্টে পোলাডা মইরা গেছে
: তারপর?
: চাইর মাইয়ার বিয়া দিয়া দিছি আগেই। চাইর মাইয়ার পরে একটাই পোলা। দুইটা পোলাপাইন রাইখা মইরা গেলো। সংসার চলবো কেমনে! আবার গাড়ি ধরলাম। হাঁপানির লেগা বেশীক্ষণ চালাইতে পারিনা। গাড়ি মেশিং চলে, আমার বডি চলেনা, বয়স হইছে।
: হাঁপানি নিয়া গাড়ি চালান?
: হ। আগের মহাজন একটা ব্যবস্থা কইরা দিছে। তার লাইনের গাড়ি বন্ধ হয় রাইত দশটায়। আমারে জমা ছাড়া রাইতে গাড়ি চালাইতে দেয়।
: ভালোই তো–
: হ, ভালাই। তেলের খরচ আর হেল্পারের দেড়’শ টাকা বাদ দিয়া যা থাকে হেইডা আমার ইনকাম। হাঁপানির লেগা বেশীক্ষণ গাড়ি চালাইতে পারিনা আর তেলের খরচ বাঁচানোর লেগা পুরা বাসভর্তি প্যাসেঞ্জার লই। দুই ট্রিপ মারার তেলে প্রায় তিন ট্রিপের সমান টাকা আয়ে।
: কয়টা ট্রিপ মারতে পারেন?
: কোনো দিন দুইটা, কোনোদিন তিনটা। চাইরটাও হয়, তবে খুব কম।
: সংসার চলে?

তিনি নির্লিপ্ততার সাথে জবাব দিলেন-
: চলে। থামতে থামতে চলে। আমি মইরা গেলেও চলবো। তবে কেমনে চলবো জানিনা।

মানুষের সাথে মিশা যাওনের একটা সুদোষ আমার আছে। তারে জানাইলাম আমার স্টপেজ ছাইড়া প্রায় চাইর কিলোমিটার দূরের লাস্ট স্টপেজ পর্যন্ত আসছি শুধু তার লগে কথা কইতে। তিনি প্রতিক্রিয়াহীন। দুইজনে ফুটপাতের এক হোটেলের টুলে বইসা ডিমভাজা দিয়া গরম গরম পরোটা খাইতাছি। তুমুল আড্ডা চলতাছে। কি এক সাধারণ কথায় নির্লিপ্ততা ভেদ কইরা তার মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখলাম। আমার পুরা শরীর ঝাকি দিয়া কাঁইপা উঠলো, এই হাসি তো অবিকল লেফকোসিয়ার এথেনটিস গীর্জার দেয়ালে আঁকা যীশুর হাসি। জেলা শহরের লঞ্চঘাটের পাশে ফুটপাতের হোটেলের টুলে এই মাঝরাইতে খবিশের ছদ্দবেশে আমার লগে বইসা আছেন মহান যীশু! ওহ খোদা!!

___________
#সৌন্দর্যগ্রস্থ-১০

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১২ টি মন্তব্য (লেখকের ৬টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৫-০৪-২০১৯ | ১১:০২ |

    এক্কেবারে ‘সাগর যেদিকে চায় অভাগা শুকায়া যায়’ পরিস্থিতি। জীবন যেখানে যেমন।

    GD Star Rating
    loading...
  2. সুমন আহমেদ : ১৫-০৪-২০১৯ | ১২:২২ |

    অসাধারণ দক্ষতায় লিখাটি ফুটিয়ে তুলেছেন হরবোলা ভাই।

    GD Star Rating
    loading...
  3. দাউদুল ইসলাম : ১৫-০৪-২০১৯ | ১৮:২২ |

    এক নিঃশ্বাসে পড়ে নিলাম Smile লুফে নিলাম…
    শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় সাঈদ ভাইhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১৫-০৪-২০১৯ | ২১:২১ |

    আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প।

    GD Star Rating
    loading...
  5. শাকিলা তুবা : ১৫-০৪-২০১৯ | ২১:২৪ |

    ভালো অণুগল্প পড়লাম ভাই। 

    GD Star Rating
    loading...
  6. রিয়া রিয়া : ১৫-০৪-২০১৯ | ২৩:১২ |

    পড়লাম দাদা। আপনি জিনিয়াস। Smile

    GD Star Rating
    loading...