খগনের জলছাপ

খগনের জলছাপ

১.
খগনের চোখ আকাশের অসীম শূণ্যতায় স্থির। কার্তিক মাসের সকালে সে শুয়ে আছে মাঠে, সবুজ কচি ঘাসের বিছানায়। আধ মাইল দূরে ব্রহ্মপুত্র। বাতাসে ভেসে আসছে ঢেউয়ের ঘ্রাণ। খগেনের শীত শীত লাগছে।

২.
ভাদ্রমাসে বন্যা হয়েছিলো। বন্যার শুরুটা হয়েছে আষাঢ় মাসের শেষে। ব্রক্ষপুত্রে টানা তিন দিন পানি বেড়েছে, এরপর কমে গেছে। এরপর ভাদ্র মাসের মাঝামাঝিতে আবার পানি বাড়লো। বৃষ্টি বাদলা কিছু নেই, কিন্তু পানি বাড়লো হুহু করে। ওই পানিও দুইদিন থম ধরে থেকে নেমে গেলো। এর তিন চারদিন পরই আবার পানি বাড়তে আরম্ভ করলো।

খাউজরানি চরের জেলেরা গত ক’বছর ধরেই এমনটা দেখে আসছে। এবার শেষ দফা পানি বাড়তে শুরু করলো খুব ঢং করে। টানা দু’দিন খুব অল্প অল্প করে পানি বাড়লো। তৃতীয় দিন স্থির। তৃতীয় দিনের রাতে পানি বাড়তে শুরু করলো হুহু করে। সাথে অবিরাম বৃষ্টি। বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যাবেলায় তারা কুপি নিভিয়ে দেয়। তাতে রাত আরও গাঢ় হয়ে নেমে আসে, অন্ধকার বাড়ে, সবথেকে বড়কথা দুর্দিনে কেরোসিন বাঁচে, আলো জমা থাকে। সন্ধ্যা হতেই আকাশ কালো ছিলো, কালো আকাশে কখন যে এতো মেঘ জমেছে তা তাদের জানা হয়নি।

জেলের জীবন জলের জীবন, জলের সাথে তাদের নিবিড় সখ্যতা আর বৈরিতাও সে জলের সাথেই। তারা জলের চরিত্র বুঝে, নিশানা বুঝে, আবদার আহ্লাদ আর রাগও বুঝে। তাই তৃতীয় দিন বন্যার পানি জেলে পল্লীতে ঢুকে ভাসিয়ে দিতে শুরু করলো, তখন প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই করেনি। নদের সীমানায় নদের সাথে জোড়-জুয়ারি চলে, কিন্তু ওই নদের স্রােত তুমুল আক্রোশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পরলে ক্রোধ শান্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। স্রোতকে বাঁধা দেবার পরিবর্তে নিজেকে রক্ষা করাই প্রধান হয়ে ওঠে।

বানভাসির রাতে জেলে সর্দার কালামের নেতৃত্বে পরিবারের সদস্য, ঘরের কিছু হাড়িপাতিল, চালডাল, সস্তা কাপড় চোপড়, আর ক’টা জাল ও সম্বল ক’টা নগদ টাকা নিয়ে খগেনরা বাঁধের দিকে ছুটেছিলো। তাদের পেছনে পেছনে স্রোতের ধাওয়া। জেলে নৌকা, ঝুপড়ি ঘর- সব ভেসে গেছে স্রােতে, তলিয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্রের পেটে। স্রোতের দাপাদাপি দেখে কে বলবে এখানে একটা জেলে পল্লী ছিলো, ছিলো ভোরে জেগে ওঠা আর রাতে ঘুমিয়ে পড়া। দুপুরের উদাসীনতা, নিত্যদিনের অভাব ও ঝগড়া ফ্যাসাদ, মাঝরাতের আদর- সোহাগ। সবশেষে ফের নদীতে নাও ভাসানো, মাছ শিকার, দাদনের বিনিময়ে সস্তা দামে জীবন ও শ্রম বিক্রি।

৩.
জেলে বংশের ধারা খগনের রক্তে। পৃথিবীতে সকল ধারারই ব্যতিক্রম আছে, রক্তের ধারারও ব্যতিক্রম হয়। খগেন যতটা না জেলে, তার থেকে বেশী যাত্রাপালার অভিনেতা। খগেন মাছ ধরে, দলের সাথে উত্তাল স্রােতে ভাসতে ভাসতে চলে যায় মাঝ নদীতে। চারপাশে অথৈ পানি এবং মাথার ওপর আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না। জাল বাইতে বাইতেই খগেন গলা ছেড়ে গান গায়। যাত্রাপালার সংলাপ আওড়ায়। দলের সবাই যে তা উপভোগ করে এমন নয়। বুড়ো ময়েজুদ্দী কাকা খগেনকে বলেন, ‘পানির লগে পিরিতি না থাকলি মাছ ধরবি কিমুন কইরি, খগেন! তুই এমন কইরি ডায়লুগ কইস নে রে, জালে মন দে.. জালের লগে পিরিতি কর।’

খগেন শীতের মৌসুমে নাই হয়ে যায়। এক অপেরা পার্টির সাথে ঘুরে বেড়ায়। ওই দলে পেটেভাতে খাঁেট, যাত্রা প্রদশর্নীতে পার্ট করার সুযোগ পায়। বড় কোনো পার্ট নয়, বিবেকের পার্ট। কালো আলখেল্লা গায়ে চাপিয়ে মঞ্চে ঢুকে সে তার দেহের সমস্ত শক্তি ও হৃদয়ের সুর কণ্ঠে এনে গেয়ে ওঠে- ‘ ভোলা মওওওনননন, দিন থাকিতে চিনলি না আন্ধার…’। খগেনের গানের দরদভরা হাহাকারে ওর নিজের চোখই ভিজে ওঠে, ওই ভেজা চোখ সংক্রমিত হয় দর্শকদের মনে মনে। আন্ধার চিনে কি হবে, কেনো আন্ধার চেনা প্রয়োজন, দিন থাকতেই কেনো আন্ধার চিনতে হবে, আন্ধার না চিনলে কি এমন ক্ষতি- এসব জটিল প্রশ্ন তাদের সরল মনে জাগে না। তাদের মনের ভেতর শুধুই হাহাকার জাগে- দিন থাকতে আমি কি চিনছি আন্ধার!

৪.
শিক্ষিতজনের মনে এমন একটা ধারণা আছে যে জেলে মাত্রই হিন্দু। এ ধারণা পোষণের জন্য তাদের দায়ী করা অন্যায়। কারণ, পাঠ্যপুস্তকে, বড়বড় সাহিত্যিকদের সাহিত্যে এবং মিডিয়ায় এমন ধারণাই দেওয়া হয়েছে। জেলেদের হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেখাতে হিন্দু সাহিত্যিকদের সাথে মুসলমান সাহিত্যিকরা যেমন দ্বিধা করেননি, তেমন জেলের সাথে জেলে মিলে যে সমাজ গড়ে উঠেছে, সে সমাজ হিন্দু-মুসলমানের মিলেমিশে থাকায় কোনো দ্বিধা করেনা। এই একসাথে থাকার পশ্চাতে কোনো মহত আদর্শ নেই।

গরীবী, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই, মহাজনের চড়া সুদ ও দাদন এবং নদীর গভীর উদারতা তাদের মিলেমিশে বাঁচতে শিখিয়েছে। এরা অসাম্প্রদায়িক নয়, এরা এমন এক জাত, যে জাত স্থূল বা সূক্ষ্ম জাত- পাত, ধর্ম-অধর্ম, প্রগতিশীলতা ও রাজনীতি, শিক্ষার আলো দিক্ষার চেতনা, আদর্শের মূল্য বোঝার আগেই আপন সম্প্রদায়ের বৃত্তে ঘানি টানতে টানতে মরে যায়। মরে যাওয়ার আগে সংসার পাতে, সন্তানের জন্ম দেয় এবং বড় করে তোলে, তাতে বিনাশের মুখে নুন দিয়ে বেঁচে থাকে উত্তরসূরী।

খগেনদের সরদার কালাম। কালামের বয়স বেশী নয়, তবে তার বুদ্ধির ওপর আস্থা আছে সবার। কালাম আর্থিকভাবেও কিছুটা স্বচ্ছল। স্বচ্ছল মানে একটা জেলে নৌকার সিকি আনা মালিকানা তার, বাকীটা মহাজনের। এছাড়া কালাম একটা সময় নজু ডাকাতের সাথে নদীতে ঘুরে ডাকাতি করতো। তার সাহসের কমতি নেই। সবমিলিয়ে সরদারি করার জন্য কালামের মত যোগ্য লোক খাউজরানির জেলে সমাজে ছিলো না। রাতে যখন পানি বাড়তে শুরু করলো, সাথে বিরামহীন বৃষ্টি- তখন কালামের ডাকেই সবার ঘুম ভেঙে ছিলো। কালামকে অনুসরণ করেই তারা দৌড়ে পৌছেছিলো বাঁধের উঁচু সড়কে।

বাঁধের উঁচু সড়কে বহু লোক এসে আশ্রয় নিয়েছে। বানের তোড় জেলে আর চাষাকে এক করে দিয়েছে, জামে মসজিদের অবিবাহিত মোয়াজ্জিন এবং দুই যুবতী বউসহ নজু ডাকাতকে পাশাপাশি ঝুপড়িতে এনে তুলেছে। কালামের নেতৃত্বে জেলেরা ক’ঘণ্টার মধ্যেই কয়েকটা ঝুপড়ি বানিয়ে ফেললো- তাতে বউ, মেয়ে আর বাচ্চাদের রেখে নিজেরা বাইরে বসে রইলো। বৃষ্টি ঝরছে, ভ্রুক্ষেপহীন ও অভিযোগহীনভাবেই ভিজছে তারা।

ঝুপড়ির ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস আসছে, আসছে আসলামের পোয়াতি বউয়ের গোঙানি। কে যেনো নিজের জীবনের প্রতি অভিসম্পাত দিচ্ছে। বলাইয়ের কিশোরি মেয়েটি সৃষ্টি কর্তার বিচারের প্রতি প্রশ্ন তুলে সৃষ্টি কর্তার কাছেই উত্তর জানতে চাইছে। খিদে বা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় কোনো কোনো শিশু কাদছে, মাঝে মাঝে এই জীবনমরণ পরিস্থিতিকে তুচ্ছ করেও হেসে উঠছে কোনো শিশু। শিশুরা সবকিছু তুচ্ছ করার ব্যকরণ জানে, বড়রা জানে চিন্তার জটাজালকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলতে।

ঝুপড়ির বাইরে কালামকে ঘিরে বসে আছে প্রায় পয়তাল্লিশজন জেলে। তাদের বয়স সতের বছর থেকে ষাটের ওপর পর্যন্ত। ঝুপড়ির ভিতর থেকে আসা কোনো শব্দই তাদের স্পর্শ করছে না, একমাত্র আসলাম ছাড়া। ভেতর থেকে আসা গোঙানির শব্দে বলাই মাঝে মাঝেই চোখ তুলে তাকাচ্ছে। অন্যরা ভাবছে অনাগাত দিনের কথা। ঘর তলিয়ে গেছে, নৌকা ভেসে গেছে। যে নদী তাদের খাদ্য যোগায় সে নদীই সব খেয়ে নিয়েছে। নদীও যেনো সুদ কারবারি মহাজন, চক্রবৃদ্ধি সুদ আদায়ে নেমেছে বন্যার লাঠি হাতে, সব হিসেব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিয়ে তবে তার শান্তি, তবে তার স্বস্তি।

কালাম বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, তাকে ঘিরে বসে থাকা জেলেরাও উঠে দাঁড়ায়। কালাম সবাইকে বসার জন্য হাতের ইশারা দেয়, এরপর কয়েকবার কেশে গলা পরিস্কার করে বলে-

– সব ভাইস্যা গেছে। আফসোস কইরা লাভ নাই।

দলের কেউ কোনো জবাব দেয়না। কালাম সবার চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার বক্তব্যের সত্যতা যাচায়ের চেষ্টা করে, কারো চোখে কোনো দ্বিমত নেই। রাতের অন্ধকারেও কালাম দেখতে পায় সবার চোখেই জমাটবাঁধা অনিশ্চয়তা, হতাশা। সে বলতে শুরু করে-

– যা হওনের হয়া গেছে। আফসোস কইরা লাভ নাই। এই বান্দেও (বাঁধে) বেশীদিন থাকন যাইবো না। কাইল থেকা এই বান্দেও পিপড়ার মতন মানুষ বাড়তে থাকবো। পানি যেমুন কইরা বাড়তাছে, পরশু এই বাঁধও পানিতে তলায়া যাইবো।

কালামের কথায় সায় দিয়ে কেশে ওঠেন দলের সবথেকে বৃদ্ধ তোরাব আলী আর হরিলাল। সে একটু বিরতি নিয়ে জানায়-

– পানি আরও বাড়নের আগেই এই রাস্তা ছাড়তে হইবো। উত্তরে ময়দাঘাট উঁচা জমিন। ওইখান থেকে দেড় মাইল দূরে পিরুলি গ্রাম। ওই্ গ্রামের গৃহস্থরা বড়লোক না হইলেও মানুষ ভালা। থাকনের জায়গা পাওয়া যাইবো।

পানিতে ডুবতে ডুবতে যখন আয়ুর প্রতি আস্থা রাখা যায়না, ওই সময় মানুষ খড়কুটোর ওপরও আস্থা রাখে। চরম বিপদের দিনে বিপদমুক্তির আশায় উদভ্রান্ত মানুষ নতুন বিপদের ওপরও আস্থা রাখতে পিছপা হয়না। পিরুলি গ্রামের কথা শুনেও কেউ আপত্তি তোলে না। কালাম এবার আদেশ দেয়-

– কাইল বিয়ানেই (সকালে) পিরুলিতে যামু। নৌকা ঠিক করো। যার যার কাছে টাকা আছে, বাইর করো। কোনো মতলব করলে এই দলে জায়গা হইবো না।

কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনা। এর অর্থ এই নয় যে, তারা সর্দারকে শর্ত ও প্রশ্নহীনভাবে মানে। খুব ছোটো ছোটো বিষয় নিয়েও তারা সর্দারের সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে। সর্দারকে শাসায়। আবার, ওই সর্দারের নেতৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে জান বাজিও রাখে। তারা সর্দারকে মানে, নিজেদের আপন আপন স্বার্থে, নিজেদের কোনো স্বার্থ বিসর্জন না দিয়েই।

সকালে জেলেদের পিরুলি গ্রামে যাওয়ার খবর রাতেই রটে যায় উঁচু সড়কে আশ্রয় নেওয়া অনেকের কাছে। গোছগাছ করার কোনো কিছু না থাকার পরও জেলে পরিবারগুলো গোছগাছ শুরু করে। গোছগাছ করাই মেয়েদের স্বভাব, অথৈ শূন্যতাকেও তারা গোছগাছ করতে পারে।

৫.
পিরুলি গ্রামে পৌছানোর পর কালাম বুঝতে পারে তাদের সাথে মোয়াজ্জিন আর দুই বউসহ নজু ডাকাতও এসেছে। মোয়াজ্জিন সাথে আসাতে কারো কোনো আপত্তি নেই। এমন একজন মানুষ সাথে থাকলে দোয়া পাওয়া যায়, দোয়া করানোও যায়। অপরদিকে নজু ডাকাতের বিষয়ে সবার মনেই একটা কিন্তু আছে। তবে এখন বিবাদ করার সময় নয়, বিবাদে কারো আগ্রহও নেই। কালামও বিষয়টিকে বড় করে তুলেনা। দুই এক’জন নজু ডাকাতের বিষয়ে কথা তুলতে চাইলে সরদার হিসেবে সে তা এড়িয়ে গেছে।

পিরুলি গ্রামের মানুষ ধনী নয়, প্রয়োজনের তুলনায় স্বচ্ছল। একটু বেশী স্বচ্ছল বলেই তারা খাওয়া এবং পরার বাইরের জগৎ নিয়ে ভাবার অবসর পায়। ইয়েমেনি শিশু আর রোহিঙ্গা নারীদের দুর্দশায় প্রবলভাবে ব্যথিত হয়। এদের জন্য কিছু করতে না পারার আক্ষেপও থাকে তাদের মনে মনে। প্রতি জুম্মাবারে পিরুলি জামে মসজিদের ইমাম সাহেব যখন ইয়েমেনি শিশুদের ও রোহিঙ্গাদের রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানান তখন উপস্থিত মুসল্লীরা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই আমিন আমিন বলে ফরিয়াদ মঞ্জুরের আকুল আবেদনে সরিক হন। আশ্রয়ের জন্য এমন একটি গ্রাম বেছে নিয়ে কালাম ভুল করেনি।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল মিয়া বাইকের পেছনে বসে পিরুলি গ্রামে যাচ্ছেন। বাইক চালাচ্ছে তার চ্যালা দিলু। একদল জেলে পিরুলি গ্রামে এসেছে- এ সংবাদ পেয়েই চেয়ারম্যানের পিরুলি গ্রামে যাওয়া। অবশ্য পিরুলি গ্রামের কেউ তাকে খবর দেয়নি। একমাত্র পিরুলিগ্রামেই তাকে সেধে সেধে চেয়ারম্যানি করতে হয়, কেউ তাকে কোনো ব্যাপারেই পোছে না। অথচ ইউনিয়নের অন্য গ্রামগুলোতে সুন্নতে খাৎনা হতে বিয়ের অনুষ্ঠান, ক’লখানি থেকে চেহলামের ফাউ খাওয়রার আয়োজনেও তার দাওয়াত থাকে, তাকে সম্মান করে দাওয়াত করে।

তোফাজ্জল যখন পিরুলি গ্রামে পৌছেছেন তখন মোল্লা বাড়িতে ভাত, আলুর ভর্তা আর খেসারির ডাল দিয়ে জেলেদের খাওয়ানো চলছে। আশপাশের বাড়ি থেকে বাসন. কোসন এসেছে। মোল্লা বাড়ির কর্তা চেয়ারম্যান তোফাজ্জলকে দেখে এগিয়ে এসে হাত মেলালেন। আশপাশের বাড়ির যে ক’জন মুরুব্বী বসে ছিলেন তাদের একজন প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দিলেন চেয়ারম্যানের দিকে। চেয়ারম্যান চেয়ারে বসে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন-

– এদের জন্য তো একটা কিছু করা উচিত, কি বলেন মুরুব্বী সকল!

মুরুব্বীদের কেউ কোনো জবাব দিলো না। যেনো তারা কথাটা শুনতেই পায়নি। এটা যে নির্ঘাত অপমান তা তোফাজ্জল বোঝে। তোফাজ্জল এটাও বোঝে যে এসব অপমান গায়ে মাখলে চেয়ারম্যানি করা যায় না। তাই সে গলা খাকারি দিয়ে কালামদের দলের দিকে তাকিয়ে বলে-

– পিরুলির মানুষ আশপাশের দশটা গেরামের মানুষের থেকা হাজারগুণ ভালা। এই গেরাম থেকা কেউ কোনোদিন খালি হাতে ফিরা যায়নি। বিপদে পইরা মানুষ এই পিরুলিতেই আসে। আপনেরাও এইখান থেকা ফিরত যাইবেন না, এই গেরামের মানুষ আপনাগো ফেরত যাইতে দিবো না।

প্রশংসা শুনে স্বয়ং দেবতাও তুষ্ঠ হন, পিরুলির সাধারণ মানুষও হাত তালি দেয়। তোফাজ্জল মনে মনে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দিয়ে ভাবে- কেমন কইরা সাপ মারলাম, লাঠিও ভাঙলাম, তা যদি এরা জানতো! চেয়ারম্যানের জন্য চা আসে, সাথে নোনতা বিস্কুট। চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন, ‘বানে ভাসা এসব লোকদের আগামী দুই দিনের খাবার খরচ সে নিজে বহন করবে।’ সবাই হাত তালি দেয়, শুধু মনসুর মোল্লা হাসতে হাসতে বলেন, ‘কি গো চিয়ারম্যান, তুমি দুই দিন খাওয়াইয়া কয় দিনের টাকা এমপি সাবের কাছ থিকা হাপিশ কইরবা!’ মনসুর মোল্লার এ কথাতে হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়। চেয়ারম্যানও হাসেন, মন খুলেই হাসেন, তিনি জানেন এসব গায়ে মাখলে চেয়ারম্যানি করা যায়না।

পিরুলি গ্রামে দুইদিনে ভেতর প্রায় তিরিশটি জেলে পরিবারের থাকার জায়গা হয়ে যায়। বিরাণ জায়গা, গৃহস্থ বাড়ির পিছনে বাতিল হওয়া টিনের ঝুপড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায় পরিবারগুলোর। মাথাগোঁজার ঠাই পেয়েই তাদের গ্রাস করে পেটে প্রতিদিনকার খিদার আগুন নেভানোর চিন্তা।

কালাম জানে পিরুলির মানুষ খুব বেশী হলে এক সপ্তাহ তাদের খাবারের ব্যবস্থা করবে। দিনে দিনে তাদের আগ্রহ কমে যাবে। দয়ামায়াও কমবে। তখন তারা চিন্তা করবে কিভাবে এদের তাড়ানো যায়। মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে আসে একথা সত্য, কিন্তু নিত্যদিন যখন মানুষ একই বিপদ দেখে তখন তাকে আর বিপদ মনে করেনা। পৃথিবী সর্বংসহা, সবকিছু সয়, পৃথিবীর থেকেও সর্বংসহা মানুষ। মানুষ সব কিছু সয়, আবার মানুষেরই সবকিছু সয়।

৬.
পিরুলি গ্রামের মনসুর মোল্লার ছেলে হারুন মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বন্যায় সর্বস্ব হারিয়ে একদল জেলে তাদের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে- এ সংবাদ শুনে সে রোমাঞ্চ অনুভব করে। তার ভেতরের শিক্ষিত মনন শহুরে মানবিকতায় দুলে ওঠে, সে মানবতার ডাকে সাড়া দিতে বন্ধুদের প্রতি আহ্বান জানায়। মানবতার ডাকে সাড়া দিতে আকুল আবেদন জানিয়ে ফেসবুকে ইভেন্ট খোলে।

বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই মানবিক। এদেশের দরিদ্রজনও ভিক্ষুককে দান করেন। পেশাগত প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্বেও মানবিক প্রয়োজনে এক ভিক্ষুকও আরেক ভিক্ষুকের পাশে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মানুষ শুধু এটুকু নিশ্চিত হতে চায় যে, দানের টাকাটা যেনো সঠিক জায়গায় ব্যয় হয়, ফ’র্তিতে নষ্ট না হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের প্রতি এখনও মানুষ আস্থা রাখে, তাদের বিশ্বাস করে। হারুন মোল্লার ডাকে সাড়া দিলেন অনেকেই।

হারুন মোল্লা ও তার বন্ধুরা আস্থা এবং বিশ্বাসের ষোলো আনা মূল্য দিয়েই ত্রাণ পৌছে দিলেন পিরুলি গ্রামে আশ্রিতদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার আলো পেয়েই সে আবিষ্কার করলো এ জেলে পরিবারগুলোর মধ্যে অসাম্প্রদায়িক বন্ধন, ঐক্যের আদর্শ, প্রতিক’লতার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার চেতনা। অসাম্প্রদায়িকতা, আর্দশ ও চেতনা- এই তিনটি শব্দ গত একদশকে খুবই আবেগ তাড়িত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই- এই শব্দ সমষ্টিকে বাম রাজনীতিকরা রীতিমত পবিত্র বাণীতে রূপান্তরিত করেছেন। হারুন মোল্লার আবেগের সাথে অনেকের আবেগ মিলেই জেলে পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার ক্ষেত্র তৈরী হোলো।

পিরুলি গ্রামে আশ্রিত অসাম্প্রদায়িকতা, আদর্শ ও ঐক্যের চেতনায় বলিয়ান এক জেলে সমাজের ছবি, ভিডিও ভেসে বেড়াতে লাগলো ফেসবুকে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়াকেও আকর্ষণ করলো এইসব বিবরণ, ছবি আর ভিডিও। সবার আগে একটি টিভি চ্যানেলের স্থানীয় প্রতিনিধি ছুটলেন পিরুলিতে। প্রায় প্রতিটি হিন্দি ছবিতেই যেমন আইটেম সং থাকে, আজকাল প্রতিটি সংবাদকেই আইটেম নিউজ করে তুলতে হয়। এতে লাভ দুটো- সংবাদ শুধু সংবাদ থাকেনা, বিনোদনও হয়ে ওঠে, আবার সংবাদ ভাইরাল হলে ওই সাংবাদিকও সেলেব্রেটি হয়ে যান। ফলে, সংবাদকে আইটেম করে তুলতে যা যা দরকার তার কোনোটাতেই ছাড় দেওয়ার বোকামি করা হয় না।

জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলের স্থানীয় সাংবাদিক যখন জেলে সর্দার কালামের বক্তব্য ভিডিও করছিলেন, তার পেছনেই ছলো ছলো চোখে দাঁড়িয়েছিলো খগেন। শুধু সে নয়, জেলে পাড়ার সকলেই দাঁড়িয়ে আছে সাংবাদিকের ক্যামেরার মুখোমুখি। খগেনের ছলোছলো চোখের কারণ বলাইয়ের পনেরো বছর বয়সী মেয়ে কমলা। চটে ঘেরা গোছল খানায় বলাইয়ের মেয়ে গোছল করছিলো। চটের এক ফোকর দিয়ে খগেন তা দেখছিলো। কমলার অনাবৃত বুকের দিকে এতোটা মগ্ন হয়ে তাকিয়েছিলো যে, চোখে কমলার গুতো খাওয়ার আগে ঘোর ভাঙেনি। কমলা গোছলখানা থেকে বেরিয়ে চেঁচামেচি শুরু করার আগেই সে এসে দাঁড়িয়েছে কালামের পেছনে। এ ঘটনা সাংবাদিক জানেন না, তার জানারও কথা নয়। খগেনের ছলোছলো চোখ তাকে আকৃষ্ট করলো।

খগেনকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে সাংবাদিক দুটো প্রশ্ন করলেন। খগেন কোনো উত্তর দিতে পারলো না। তার মাথার ভেতর কমলার বুক, গুতো এবং পরবর্তী বদনাম, বিচার ও সাস্তি একসাথে জট পাকাচ্ছিলো। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। সাংবাদিক এবার নিজেই উদ্যোগি হয়ে খগেনকে প্রশ্নের উত্তর শিখিয়ে দিলেন, তিন চারবার মহড়াও দিলেন। যাত্রা পালায় বিবেকের পার্ট করা খগেন এবার বাজিমাৎ করে দিলো। নিজেদের দুদর্শার কথা বলতে গিয়ে সে হুহু করে কেঁদে দিলো। শেষ প্রশ্নের উত্তরের শেষ না করেই সে কান্নায় ভেঙে পরলো। সাংবাদিক মনে মনে হেসে উঠলেন, এই তো চেয়েছিলেন তিনি, এমন একটা ক্লিপ মানেই সুপারহিট, বাম্পার হিট।

টেলিভিশন চ্যানেলটি কালামের পরিবর্তে খগেনের কান্নাজড়িত ভিডিওটি প্রচার করলো। এই ভিডিও করতে কতটা কষ্ট সয়েছেন এবং করেছেন তা জানান দিলেন সাংবাদিক। ওই ক্লিপ প্রচার হতেই খগনের কান্না সংক্রমিত করলো মানুষকে। আরও কিছু টিভি চ্যানেল ছুটে গেলো পিরুলিতে, তাদের উদ্দেশ্য বন্যাক্রান্ত জেলে পরিবারগুলো নয়, তাদের উদ্দেশ্য খগেনকে দিয়ে আরও আবেগ তাড়িত ভিডিও নির্মাণ। মনে মনে ক্রোধ পুষে রাখলেও কালাম জানে খগেনের কান্নাই এখন এই জেলে পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করতে পারে। তাই টেলিভিশন চ্যানেল বা পত্রিকা এলে কালাম নিজেই খগেনকে এগিয়ে দেয়।

খগেন নিজেও বুঝতে পারে সে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এখন দলের সবাই তাকে সমিহ করে। পিরুলি গ্রামের মানুষও তাকে বেশ দাম দেয়। তার থেকে বড় কথা কমলা এখন আর চোখ গুতো দেয়না, চোখে চোখে ইশারা দেয়। চটঘেরা গোছলখানায় ঢোকার আগে খগেনের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, গুণগুণ করে গানও গায়। এসব যে বলাইয়ের চোখে পড়েনা, তেমন নয়। বলাইও কেমন প্রশ্রয় দেয়, খগেনকে ডেকে পিরুলি বাজারে দুবার রং চা আর মিঠা বিস্কুটও খাইয়েছে।

৭.
আশ্বিন মাসের মাঝামাঝিতে পানি শুকায়। পিরুলি ছেড়ে চর খাউজরানিতে ফিরে আসে জেলে পরিবারগুলো। খগেনের কান্না শুধু ত্রাণই যোগায়নি, এমপি ও ডিসি সাহেবের উদ্যোগে জেলেদের জন্য নতুন ঘর তোলার ব্যবস্থা হয়েছে। হারুন মোল্লাসহ আরও দুজন এক্টিভিস্টের প্রচারণায় অর্জিত অর্থের সাথে এসপি সাহেবের দান মিলে জেলেদের জন্য পাঁচটি নতুন নৌকা বানানো গেছে। ত্রাণের সময় যে খাবার এসেছে তা দিয়ে আরও দু’মাস আরমেই চলবে, যে কাপড় আছে তাতে একবছর নতুন কাপড় না হলেও সমস্যা নেই।

এমপি, ডিসি, এসপি আর শহুরে তরুণদের পদচারণায় মুখর খাউজরানিতে বকেয়া সুদ ও দাদনের মহাজনরে নীরব রয়েছেন। পরিস্থিতি ঠা-া হয়ে এলেই তারা বেরিয়ে আসবেন, সুদে আসলে সব বকেয় কানায় কানায় আদায় করে ছাড়বেন। তখন খগেনের কান্না কোনো কাজেই আসবে না। তারা সরকারি ব্যাংকের মত বেওকুফ নন, তারা জানেন ও মানেন সুদ শাস্ত্রে মওকুফ বলে কোনো শব্দ নেই।

কালামের মনেও শান্তি নেই। কারণ, কালামকে সরদার মানতে অস্বীকার করছেনা কেউ, তবে খগেনকেও সরদার মানছে অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে কখনও পড়েনি কালাম। এছাড়া, সুদের মহাজনরা চড়াও হলে সব কালামকেই সামলাতে হবে। মহাজনরা কালামের জিম্মাতেই সবাইকে সুদে টাকা দিয়েছিলেন, খগেনের জিম্মাতে নয়। এছাড়া নজু ডাকাতের উদ্দেশ্যও খুব ভালো নয়। খগেনের মত সেও কমলার চারপাশে ছোক ছোক করে। কমলার বয়স কম, ও জানেনা আগুন নিয়ে খেলা কাকে বলে, আগুন নেভানোর ব্যাকরণ না জেনেই ও দুজনকেই ইশারা দেয়। কিছু একটা ঘটে গেলে তার দায়দায়িত্ব সবাই তখন কালামকেই দিবে, কালামকেই নিতে হবে। এদিকে হারুন মোল্লাও জেলেদের নেতা হবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, সে জানেনা দূর থেকে জেলেদের দেখা আর জেলেদের নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।

খাউজরানির জেলে পাড়ায় আনন্দের হিল্লোলের ভেতর খগেন কমলাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। এবার শীতে সে আর যাত্রাপালায় যাবেনা, কমলাকে রাতভর গান শোনাবে। হারুন মোল্লা মনে মনে ভাবে তার জন্যই জেলে পাড়ায় এমন আনন্দের হুল্লোর, সে এই জেলেদের সুদিন এনে দিবে- সে হবে জেলেদের নেতা। এই আনন্দের হুল্লোড়ে নজু ডাকাতের দুই বউ দিয়ে আর পোষে না, তার মনে আশা একদিন যদি কমলাকে মওকা মত সে পায়। বলাই দিনক্ষণ দেখে কমলাকে খগেনের গলায় বেঁধে দিতে চায়, বলাই জানে খগেনই হবে সর্দার। আর কমলা, সে খগেন আর নজু ডাকাতকে প্রশ্রয় দেয় ঠিকই, হারুন মোল্লার দিকেও তার তীক্ষ্ম কৌতূহল! ওই ছেলে শিক্ষিত বলেই কি এতো দেমাগ! অবিবাহিত মোয়াজ্জিন খাউজরানির চেয়ারম্যানের কাছে আবদার করেছে একটা মসজিদঘর করে দিতে, আল্লাহ যখন মুখ তুলে চেয়েছেন তখন তার কাছে পানা চাওয়া ও আখেরাতের পুঞ্জি ভরতে নামাজ আদায় ও দোয়া খায়েরের জন্য মসজিদের কোনো বিকল্প নেই।

একমাত্র কালামের মনেই ভয়ের স্রােত বয়ে যায়। সে জানে কোনো কিছুই ঠিকমত চলছে না, সংঘাত অনিবার্য।

৮.
খগনের চোখ আকাশের অসীম শূণ্যতায় স্থির। কার্তিক মাসের সকালে সে শুয়ে আছে মাঠে, সবুজ কচি ঘাসের বিছানায়। আধ মাইল দূরে ব্রহ্মপুত্র। বাতাসে ভেসে আসছে ঢেউয়ের ঘ্রাণ। খগেনের শীত শীত করছে। দুই মাস আগেও এখানে থৈ থৈ পানি ছিলো, খগেন সাঁতরে পার হয়েছিলো এ জায়গাটুকু। খুব ছেলেবেলায়, যখন বাবা বেঁচে ছিলেন তখন একবার কোনো এক মেলায় খগেন গিয়েছিলো এ পথ ধরে। তার মাথায় সরষা তেল দিয়ে মা চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন, কপালে গোল করে কাজলের টিপ দিয়েছিলেন যেনো কারো নজর না লাগে। বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এখানে বসে পড়েছিলো সে, বাবা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। বাবার মাথায় সস্তা নারকেল তেল আর মাছের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হওয়া গন্ধটা বহুদিন পর অনুভব করে সে।

এখান থেকে দেড় ঘণ্টা হেটে গেলে খাউজরানি, খগেনের গ্রাম। ওখানে নতুন টিনের ঘরে রোদ চনমনায়। এক একটা রাতে কমলা এসে টুপ করে ঢুকে পরে ঘরে। তারপর দুজন ফিসফিসিয়ে কথা বলে, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে নীরব বসে থাকে। এর বেশী কিছু করার সাহস কমলারও নেই, খগেনেরও নেই। গতকাল রাতের কথা ভাবতে ভাবতেই খগেন বাম হাতে মাটি আকরে ধরে। এ মাটি কেমন কোমল, যেনো খোসা ছাড়ানো কমলা বুক। ঘাসের ওপর খুব আলতো করে বাম হাত বোলায় খগেন। খগেনের ডান হাত পরে আছে কিছুটা দূরে। পায়ের রগ কাটার পরও ও পা নাড়তে পারছে। কিছুক্ষণ আগেও খুব ব্যাথা ছিলো, এখন ব্যাথা নেই।

খগেনের কেমন ঘোর ঘোর লাগছে। খুব তেষ্টা পাচ্ছে, কিন্তু পানি খেতে ইচ্ছে করছে না। গোঙানিও আসছে না। বুক ভেঙে কান্না আসছে, পানি চোখ গড়িয়ে গাল ছুঁয়েছে- এ অশ্রু যাত্রাপালার বিবেকের নয়, খগেনের। যে খগেন কালামের মত নেতা বা নজুর প্রেমিকার ভিলেন হতে চায়নি, যে খগেন হারুন মোল্লার প্রতিদ্বন্দ্বি হতে চায়নি, যে খগেন শুধুই খগেন, যার শরীরে মাছের ঘ্রান আর স্রোতের জলছাপ এ অশ্রু ওই খগেনের।

যারা বড় লেখার জন্য তাগাদা দিতেন, তাদের জন্য বড় লেখার এই অপচেষ্টা।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৪ টি মন্তব্য (লেখকের ৭টি) | ৭ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৬-০৩-২০১৯ | ৯:৫৭ |

    আমিও মনে মনে তাগাদা দিতাম বড় কোন লিখা প্রাপ্তির আশায়। আজ পূরণ হয়েছে মনে হচ্ছে। অসাধারণ একটি বড় লিখা উপহারের জন্য ধন্যবাদ মি. আবু সাঈদ আহমেদ। 

    GD Star Rating
    loading...
  2. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০৬-০৩-২০১৯ | ২০:০৮ |

    আসলেই তাই। সম্ভবত এই প্রথম আপনার লেখা বড় কোন গল্প পড়লাম। তবে আপনার অণুগল্পও আমার কাছে অসাধারণ লাগে। অভিনন্দন জানালাম ভাই।

    GD Star Rating
    loading...
  3. রিয়া রিয়া : ০৬-০৩-২০১৯ | ২১:০৭ |

    আপনি জিনিয়াস রাইটার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. শাকিলা তুবা : ০৬-০৩-২০১৯ | ২২:৩০ |

    খুবই ভালো। 

    GD Star Rating
    loading...
  5. সুমন আহমেদ : ৩০-০৪-২০১৯ | ৯:৩২ |

    মন্তব্য বন্ধ থাকার পরও পড়েছিলাম হরবোলা ভাই। ভালো করেছেন লিখাটি রিপিট করে। 

    GD Star Rating
    loading...
  6. ইলহাম : ৩০-০৪-২০১৯ | ১২:২০ |

    অসাধারণ লিখেছেন প্রিয় সাঈদ ভাইয়া।

    GD Star Rating
    loading...
  7. নূর ইমাম শেখ বাবু : ৩০-০৪-২০১৯ | ১৯:৩৮ |

    শুভকামনা প্রিয়জনhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gif

    GD Star Rating
    loading...