কাঞ্জুইসা মারুফ

কৃপণ লোকদের ঢাকার লোকাল ভাষায় বলে কঞ্জুস অথবা কিরপিন। মারুফ ভাই একজন মাশহুর কঞ্জুস। আমাদের গ্রুপে এমন একটা কথা প্রচলিত আছে- যে লোক পিঁপড়ার পেট চিপে চিনি বের করে সেও কিছুটা দয়ালু, মারুফ ভাই তো চিনি বের করে প্রোটিন হিসেবে পিঁপড়াকে ভুনা করে খাবেন।

আজ সকালবেলাতেই মারুফ ভাইয়ের সাথে ফার্মেসীতে দেখা। প্রচণ্ড জ্বর, তাই দোকানীকে বলে ওষুধ নিতে এসেছেন। এমন মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করা যায়না, তাই হাসতে হাসতে বললাম-

: মারুফ ভাই, এবার কাঞ্জুসি কিছু ছাড়েন। ডাক্তার দেখান।
জ্বর কাতর চেহারায় মলিন হেসে তিন উত্তর দিলেন-
: ছোটো ভাই, ফার্মেসী ওয়ালারাই ভালো দেখে। ডাক্তারের কাছে গেলে এই টেস্ট ঐ টেস্ট। খরচান্ত ব্যাপার।

মনে আছে গত বছর যখন পায়ে ব্যাথা পেলাম- মারুফ ভাই ডাক্তারকে দেখানো ছাড়া কোনো ওষুধ খেতে নিষেধ করেছিলেন। আজ উনাকে সেইসব উপদেশবাণীর কিছুটা ফেরত দেয়াই যায়। অবশ্য তার আগেই তিনি বললেন-
: চা খাইবা সাঈদ, তোমার তো আবার চায়ের নেশা।
: তার আগে কন আপনি খাওয়াইবেন?
: হ, আমিই খাওয়ামু। চলো, একটু চা খাই।

নবাব সিরাজদৌল্লাহর মর্মান্তিক পরাজয়ের পরে এটাই বাংলার ইতিহাসে সর্বাধিক মর্মান্তিক পরাজয়ের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। আর পরাজয়টা আমার। অর্থাৎ মারুফ ভাই আমারে চা খাইয়ে তার ‘কঞ্জুস’ উপাধি বিসর্জনের পথে এগিয়ে যেতে চাইছেন! কি জানি কি হলো, উনাকে জোড় করে বাড়িতে নিয়ে গেলাম। ঐতিহাসিক ঘটনাটা ঘটতে ঘটতে ঘটলো না। আমার ঘরে বসতেই মারুফ ভাই একটা অমায়িক হাসি দিলেন, আমি বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম-
: হাসেন কেনো!
: তোমার ঘরে এখনো এমন ছড়ানো ছিটানো এতো বই! ম্যাগাজিন আর পেপার!!

আমি উত্তর না দিয়ে ‘হ্যা’ বাচক হাসি দিলাম। আর সাথে সাথে মনে পড়লো কিশোরবেলায় মারুফ ভায়ের ঘরে তো প্রচুর বই দেখেছি। ‘লেবু মামার সপ্তকাণ্ড’, ‘রাণী খালের সাঁকো’, ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ বইগুলো তো প্রথমে উনার কাছ থেকে এনেই পড়েছিলাম। উনি প্রচুর বই কিনতেন, উনার হবি ছিলো বিভিন্ন কালারের পিপং বল, স্ট্যাম্প আর স্টিকার কালেকশনের। কৌতূহল কাটাতে জিজ্ঞেস করি-
: এখন কি আর বই পড়েন না? আপনার স্ট্যাম্পগুলো কোথায়!

দীর্ঘনিশ্বাস গোপনের ব্যর্থ চেষ্টা করে উত্তর দিলেন-
: আর বই পড়া! স্ট্যাম্প দামিগুলো বিক্রি করে ফেলেছি, বাকীগুলো কোথায় আছে জানিনা।

মারুফ ভাইয়ের স্ট্যাম্পবুকটার প্রতি আমার গভীর লোভ ছিলো। কত সুন্দর সুন্দর সব স্ট্যাম্প, বিভিন্ন দেশের। ইতোমধ্যে চা চলে এসেছে, চায়ে চুমুক দিতে দিতে মারুফ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম-
: ভাই একটা কথা সরাসরি বলি- এমন কাঞ্জুস হইলেন কেমনে! আড়ালে অনেকে অনেক কিছু কয়, ভালো লাগেনা, জবাবও দিতে পারি না।

তিনি মলিন হেসে বললেন-
: তোমার জবাব দিবার দরকার নাই। কঞ্জুসরে তো কঞ্জুসই কইবো, হাজী মোহম্মদ মহসীন কইবো না কি!

আমি নাছোড়বান্দা। আজ যখন একটা মওকা পেয়েছি তখন উনার কাঞ্জুসীর বিরুদ্ধে একটা লেকচার দিবোই। আর কাঞ্জুসপনাও কিছুটা হারাম করে ছাড়বো। তাই বললাম-
: বাদ দিলে তো বাদই দিতাম। আপনার কাঞ্জুসী করার কোনো কারণ খুঁইজা পাইনা! ভালো চাকরী করেন। জয়েন ফ্যামিলি। দুইটা মাত্র বাচ্চা। তারপরেও এমন কাঞ্জুসী কিভাবে করেন কন তো! কাউরে পাঁচটাকার ঝালমুড়ি খাওয়াইতে গেলেও পঁচিশবার চিন্তা করেন। তারপর বলেন ‘সাথে টাকা নাই।’ এইটা কিছু হইলো।

মারুফ ভাই মনে হয় একটু অবাক হয়েছেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর খুব ধীরে বলতে শুরু করলেন-

: সাঈদ, তুমি আমার ইনকামের জায়গাটা দেখছো। কিন্তু খরচের ব্যাপারটা জানো না।

: ধুত্তরি! বাড়ি ভাড়া লাগেনা। তারপরে আবার জয়েন্ট ফ্যামিলি। আরও দুই ভাই কামায়। তারপরে আপনার এত খরচ যে পাঁচটাকা নিজের জন্যই ব্যয় করতে পারেন না। টাকা বাঁচাতে দুই দিন পর পর ফার্মেসীর হারুনের কাছ থেকে জ্বরের ওষুধ নেন, ডাক্তার দেখাইতে পারেন না!

মারুফ ভাই কি যেন ভাবছেন। কিছুটা সময় নীরবতা। চা-বিস্কুট খাওয়া শেষে উনি আবার মুখ খুললেন-
: শোনো সাঈদ, আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি এটাতো জানোই। আমার ছোটো ভাইটা দুই মাস কাজ করলে তিন মাস বইসা থাকে। যেখানেই চাকরী করতে যায় সেখানেই না কি ওরে বাড়তি খাটায়। তাছাড়া তারা অফিস ম্যানেজমেন্ট বুঝেই না।

: বলেন কি! মান্নানের এই অবস্থা!

: হ্যা। ওতো তোমাদের সাথেই আড্ডা দেয়। ওরে কখনও ব্যস্ত দেখছো! নিয়মিত অফিসে যাইতে দেখছো? : এটা তো এভাবে খেয়াল করি নাই, ভাই..
: যে দুই মাস কাজ করে সে দুইমাসের বেতন নিজেই খরচ করে। তার বউ আর এক বাচ্চার খরচ আমারেই চালাইতে হয়।

: আপনে একা চালাইবেন কেন? মেজোজন মানে মোস্তাক ভাই কি করেন!
: মোস্তাক গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল আর ওয়াসার বিল দেয়। ওর পক্ষে না কি এর বেশী দেয়া সম্ভব না। ওর দুই বাচ্চার ভবিষ্যত আছে না!
: বাহ! আপনার বাচ্চারা কি ভবিষ্যত ছাড়া!

: তেমনই ধরতে পারো। ফ্যামিলির বড় ছেলে। আগে দায়িত্ব নিছি- এখন দায়িত্ব থেকে আর মুক্তি পাইতেছি না।

: আপনাদের আত্নীয়স্বজনদের ডাকেন। প্রয়োজনে আলাদা হয়ে যান।
: ডাকি নাই মনে করছো! একবার আলাদা হইছিলামও। কিন্তু যেইকার সেই।
: মানে!

: মানে হইলো, ছোটো ভাইরে দেখতে হয়। ওর খরচ পুরাটাই চালাইতে হয়। চাকরী পাইলে শোধ কইরা দিবে বইলা লোন নেয়। মেজোজনেরও একই অবস্থা- এই মাসে বাচ্চাদের বেতন আটকায়া থাকে তো, পরের মাসে ইউটিলিটির বিল আটকায়া থাকে। রমজান আর ঈদে কেনাকাটা আটকায়া থাকে। তারপরের মাসে আবার কি জানি কোন ব্যাংক লোনের কিস্তি আটকায়া থাকে। আর বাচ্চাগুলা তো কোনো অপরাধ করে নাই। ওদের খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট সহ্য হয়না। তাই আবার একসাথে হইতে বাধ্য হইলাম।

: আপনেরে দিয়া কিছু হইবো না। চা খাইবেন আরেক কাপ!

: খাইতে পারি।

কি জানি কি মনে করে উনার কপালে হাত দিলাম- বেশ জ্বর। উনাকে বললাম-

: মারুফ ভাই, একটু শুয়া থাকেন। ভালো লাগবে। একটা নাপা দেই, খায়া জ্বর চাপা দেন।

উনি শুলেন না। নাপা খেয়ে বসেই রইলেন। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন-
: একটা ফ্যামিলির প্রায় পুরা খরচটাই আমারে চালাইতে হয়। পনেরোজন মানুষ। তারপরে আবার দাওয়াত তো লাইগাই থাকে। বাচ্চাদের পড়ার খরচ। তোমার ভাবী মানুষটা দেবীর মত, সবই বুঝতে পারে কিন্তু মুখ ফুইটা বলেনা কিছু। পুরাই মায়ের স্বভাব।

: হ, বুঝলাম।

: কি বুঝলা?

: যেমন ছাগল, তেমনি ছাগী।

: হাহাহাহা… এখন তুমিই কও, আমার ইনকাম কি অনেক!

: যে কাহিনী শুনাইলেন, তাতে অনেক ইনকাম কই কেমনে!!

: ইনকাম আসলে অনেকই। পনেরোজন মানুষের ফ্যামিলি চালাইতে গিয়া চোখে আন্ধার দেখি। যদি শুধু আমার ফ্যামিলিটা হইতো তবে চাইরজনের বেশ আরাম কইরা চইলা যাইতো। আমারে কাঞ্জুসী করতে হইতো না।

: সর্যি ভাই, আপনেরে আর কাঞ্জুস কমু না।

: সরি কওনের কোনো কারন নাই। স্বভাবে পুরাই কাঞ্জুস হয়া গেছি। নিজেই নিজেরা চিনতে পারিনা। কত বছর ধইরা ভাবতাছি একবার দুই বাচ্চা আর তোমার ভাবীরে নিয়া রাঙামাটি যামু। কিন্তু খরচ কুলাইতে পারতাছিনা।

: বুঝতে পারতাছি..

: ঘরের ভিতরে মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়া আসে। মনে হয় পালাই। দুই একদিনের জন্য ঢাকার আশেপাশে কোথাও যাইতে ইচ্ছা করে- কিন্তু হিসাব কইরা আর যাওয়া হয়না। এক দুই হাজার টাকাও অনেক টাকা। খরচ বাঁচাইতে গিয়া অফিসের পিকনিকে পর্যন্ত যাই না।

আমি অপার উৎসাহ নিয়া আবেদন করলাম-
: ভাই, আপনি যদি কন তবে মান্নানরে একটা ঘাড়ানি দেওনের ব্যবস্থা করি!

: মাইরা কি আর কাজ করানো যায়! বাদ দাও…

: মাঝে মাঝে তোমাগো মতন দামি শার্ট আর জুতা পরণের ইচ্ছা জাগে। কিন্তু এখন আর দাম দেখিনা, কমদামে টেকসই জুতা কিনি। জ্বরের জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত, কিন্তু মাসের প্রথমে সংসারের বাজার, দোকানের বাকীর বিল, বাচ্চাদের ইশকুলের বেতন পরিশোধ কইরা হাত খালি হয়া যায়। তারপরে মাসের শেষে তো ভয়াবহ অবস্থা। ডাক্তারের কাছে যাওয়া এখন বিলাসিতা মনে হয়।

: আপনার গুণধর দুই ভাই কিছু বলেনা!

: বলেনা মানে! আমার কি কি করা উচিত সবকিছুই কয়, তবে টাকা-পয়সা খরচ আর হিসাবের ব্যাপার উঠলেই তাগো মুখ শুকায়া কালা আমসত্ব হয়া যায়।

দ্বিতীয় দফায় চা এসেছে। দুইজনে চা খাচ্ছি। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বিব্রত হবার হাত থেকে বাঁচার জন্য কার্টুন চ্যানেল ছেড়ে দিয়েছি। কথাগুলো বলতে পেরে মারুফ ভাই মনে হয় অনেকটা নির্ভার হয়েছেন। ইলেকট্রিসিটি চলে যেতেই বুঝতে পারলাম বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। চৈত্রের বৃষ্টি। কনকনে হাওয়া। মারুফ ভাইকে জোড় করে ছাদে তুলে নিয়ে এসেছি, বৃষ্টিতে ভিজবো। মারুফ ভাই অবশ্য ভিজতে শুরু করে দিয়েছেন। কেনো যেনো মনে হচ্ছে মারুফ ভাই কান্না করছেন। আমার প্ল্যানটা অন্যরকম- ডাক্তারকে যখন ফি দিবোই তখন ভালো করে শরীর খারাপ করায়া ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। অন্য একটা সমস্যাও আছে– এখন যদি ভাইকে বলি চলেন ডাক্তারের কাছে নিয়া যাই, উনি বিব্রত হয়ে না করবেন। তারপর ভাববেন উনারে দয়া দেখাইতাছি। যত্তসব ফালতু সেন্টিমেন্ট। এইসব অসাধারণ মানুষগুলি কেনো যে এমন হয়! আমার খুব কাঞ্জুস হতে ইচ্ছে করছে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৫ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. রিয়া রিয়া : ১৮-০৭-২০১৮ | ১৯:১৩ |

    এতোটাই সহজ করে লেখা যে, যে কোন পাঠক কয়েক শ্বাসে পড়ে নিয়ে তার যেটা নেয়ার সেটার স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। শুভেচ্ছা জানবেন দাদা। 

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ১৮-০৭-২০১৮ | ২২:০৬ |

    * রচনার সরলতায় অনুগল্প বেশ সুখপাঠ্য হয়ে ওঠেছে।

    শুভরাত্রি।

    GD Star Rating
    loading...
  3. মুরুব্বী : ১৯-০৭-২০১৮ | ১০:৩৪ |

    এমন অসাধারণ অণুগল্পই তো আবু সাঈদ এর অণুগল্প সিরিজে মানায়। ভালো লিখন। গ্রেট। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. চারু মান্নান : ১৯-০৭-২০১৮ | ১২:২৫ |

    সত্যই আমার্ও,,,,,,,,,,খুব কাঞ্জুস হতে ইচ্ছে করছে।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. যাযাবর জীবন : ১৯-০৭-২০১৮ | ১৬:৪১ |

    জয়েন্ট ফ্যামিলির বড় ছেলেগুলো সাধারণত একটু কঞ্জুষই হয় 

    বাধ্য হয়ে Frown 

     

     

    GD Star Rating
    loading...