শোয়া
ব্রক্ষ্মপুত্র এক রহস্যময় নদ। কখন যে কি তার খেয়াল! এই শান্ত তো এই উন্মাদ। থম ধরে আছে তো পরক্ষণেই স্রোতের মাতামাতি। আজ ব্রক্ষ্মপুত্র বেশ রেগে আছে, বড় ঢেউ কেটে কেটে ট্রলার চলেছে তিস্তার দিকে।
ট্রলারের ফটফটফটফট শব্দে কথা বলা দায়। মোর্শেদ তাই চুপ করে দুই ধারে নদীভাঙা চর দেখছে, শরৎ দুপুরের মেঘ দেখছে, আড় চোখে ট্রলারে বসে থাকা গৌরীজানকেও দেখছে। বয়স ২৫বছরের বেশী নয়। বেদেনীদের দেহের গঠনে এক ধরণের ধারালো সৌন্দর্য্য আছে, গৌরীজান এর ব্যতিক্রম নয়। দেহসৌষ্ঠবের সাথে যোগ হয়েছে অপরূপ মুখশ্রী। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বেদেনীদের গায়ের রং কালো বা শ্যামলা হলেও গৌরীজানের গায়ের রং ভীষণ ফর্সা।
মোর্শেদের মনে হচ্ছে কোনো শহুরে মডেলকে গৌরীজানের ভূমিকায় অভিনয় করতে ট্রলারে তুলে দেয়া হয়েছে।
ট্রলার এসে ভীড়ে কামারজানি বাজারে। মোর্শেদের পেছনে পেছনে নামে গৌরীজান, সাবেক এক ইউপি মেম্বার আর স্থানীয় পত্রিকার দুজন সাংবাদিক। তারাই মোর্শেদের সাথে কথা বলার জন্য গৌরীজানকে নিয়ে এসেছে। বাজারের চায়ের দোকানেই মোর্শেদ কথা শুরু করে-
: গৌরীজান, কেমন আছো?
: বাপু, বহুত ভালা আছি।
: তুমি কি করো এখন?
: ব্যওবসা করি।
: বাহ! বেশ ভালো। তা তোমার ব্যাগে কি?
: বাপু, বেরা আর পেনটি।
: বুঝলাম না, বুঝায়া বলো-
: বাপু, আমি বাসায় বাসায় মাইয়া গো কাছে বেরা আর পেনটি ফেরি করি-
: যা ইনকাম করো তা দিয়ে কি তোমার চলে?
গৌরীজান কোনো উত্তর না দিয়ে চা খেতে থাকে। আজ থেকে দুই বছর আগে ফজলু তাকে ভালোবেসেছিলো। পাগলের মত ভালোবাসা যাকে বলে। তাকে বাধ্য করেছিলো বেদে সমাজ ছেড়ে আসতে। ছয় মাসের সুখের সংসার, কানায় কানায় সুখ। বেদে সমাজ ত্যাজ্য করলেও এক ভোরবেলা গোপনে বাবা এসে তার হাতে বিশ হাজার টাকা আর দুটো সোনার চুড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন। সাত মাসের মাথায় ফজলু জমানো সব টাকা, গহনা নিয়ে পালালে গৌরীজান বুঝতে পারে সে প্রতারিত। বেদে সমাজে ফেরার পথ তার বন্ধ, তাই বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে বেঁচে থাকতে, পেটে আসা বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে।
মোর্শেদ কিছু সোশ্যাল ওয়ার্ক করে, গৌরীজান সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো মেয়েটিকে অন্তত একটি দোকান করে দিবে- মফস্বল শহরে চাহিদা উপযোগী লেডিস আন্ডার গার্মেন্টসের সাথে প্রসাধন সামগ্রীর দোকান। এজন্যই আলাপচারিতা, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মোর্শেদ আবার জিজ্ঞেস করে-
: এই ইনকাম দিয়ে কি তোমার আর বাচ্চার চলে?
: না, বাপু।
: তবে তোমারে একটা ছোটো দোকান করে দেই- চালাতে পারবে?
: না।
: চালাতে পারবেনা?
গৌরীজানের স্বরে দৃঢ়তা-
: বাপু, দোকান চালাইতে পারুম, কিন্তুক তোর কাছ থিকা দোকান নিমু না।
মোর্শেদ বিস্মিত, কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে-
: কেনো?
গৌরীজান খিলখিল করে হেসে ওঠে, হাসির দমকে তার কাধ থেকে শাড়ি সরে যায়, বা সে-ই কৌশলে সরিয়ে দেয়-
: বাপু, তুই কি আর এমনি এমনি দোকান কইরা দিবি আমারে, সপ্তায় কয়দিন শুইতে হইবো তোর লগে!
এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হবে মোর্শেদ ভাবেনি, নিজেকে সামলে নিয়ে বলে-
: তোমার কারো সাথে শুতে হবেনা, আমার সাথেও না।
: বাপু, সবাই এমন কয়, কিন্তু একলা পাইলেই ঝাপায়া পড়ে। তোর মেম্বররে জিগা কাইল আমারে কি করছে! বাপু রে, ফেরি কইরা যেদিন ভাত জুটেনা সেদিন শুই। দোকান নিয়া রোজ রোজ শুইতে পারুম না বাপু, মাফ কইরা দে।
মোর্শেদ নীরব। মেম্বার কখন উঠে চলে গেছে খেয়াল করেনি। দুজন সাংবাদিক বসে আছে চুপচাপ। গৌরীজানের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখে মোর্শেদের হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করে কবে গৌরীজানের ভাত জুটবেনা, সেদিন সে গৌরীজানের সাথে শুয়ে বুঝিয়ে দিবে শোয়ার ইচ্ছে তার নেই, বিন্দুমাত্র নেই।
#গল্পগ্রন্থ: লেজ। #লেখক: আবু সাঈদ আহমেদ।
loading...
loading...
অসম্ভব ভালো লাগলো লেখক বন্ধু, তাই পাঁচ তারকাই দিয়ে দিলাম।
loading...
অসাধারণ প্রিয় আবু সাঈদ।
loading...
অসাধারণ লেখা।
loading...