সাজেদুল ক’দিন আগে মায়ের সাথে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে অজানা অচেনা শহরে এসেছে। সিলেটের উঁচু ঢিপির উপর বাড়ি, গাছপালা, চা বাগান দেখে তার মন জুড়িয়ে গেছে। দিনের বেলায় বেশ ঘুরাঘুরি করতে শেষ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে কোথায় যাব; কোথায় থাকব ইত্যাদি চিন্তায় শহরের পথ চলছে। অচেনা শহরে কারো সাথে চেনা পরিচয় নাই নিজেকে বড় অসহায় মনে করছে। ভাবছে কেন বাড়ি থেকে মায়ের বোকা-ঝোকা খেয়ে চলে এলাম। তবুও তার অভিমানের কথা যেনো ফুরায় না। সারাদিন শহরের আকাঁবাকা পাহাড়ি পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। খাওয়া-দাওয়া নেই। পথের ধারে নির্জন চৌকিতে বসে ঘুমিয়ে পড়ল। কখন যেনো নির্ভয়ে রাত পোহাল জানে না সাজেদুল। সকালে সজাগ হয়ে ভাবছে এই নির্জন এলাকায় সারা রাত একা ছিলাম! পাড়ার শৈশবের স্মৃতিগুলো তার খুব মনে পড়ছে। পাড়ার বন্ধুরা না জানি কে কী করছে। স্বল্প সময় তার মনে হয়; কতদিন যেনো বন্ধুদের সাথে দেখা নাই।
পৃথিবীর সব সৃষ্টি প্রকৃতির নিয়মে বদলায়। জীবনে কত প্রাপ্তী অপ্রাপ্তী থেকে যায়। আর প্রাপ্ত বয়সে সৃষ্টিকুল ঝড়ে যায়। কী নির্জন আর ভয়ানক অন্ধকার; যেখানে কোন সঙ্গী নেই। চা বাগানের জঙ্গলের পাশে এই চৌকিতে একাই রাত কাটলাম। এখন বড্ড খিদে পেয়েছে; পকেটে মাত্র কুড়ি টাকা। এভাবে আর ক’দিন চলা যাবে। কোথাও একটা কাজ যোগাড় করতে হবে। কিন্তু এই অচেনা শহরে কে তাকে কাজ দেবে। এমন সময় একজন পথচারীকে কাছে পেয়ে সাজেদুল জিজ্ঞাস করল কাকা দোকান কত দূরে? সাজেদুলের কথা শুনে লোকটির প্রশ্ন তোমার কী দরকার? সে ভীতস্বরে বলল; শহরে নতুন এসেছি। এই এলাকা সম্পর্কে চেনা-জানা নাই। কাকা আমাকে খিদে লেগেছে তাই দোকান খুঁজছি। এখানে কোন দোকান নাই। শ্রমিকেরা এ চৌকিতে চা পাতা তোলে জড়ো করেন। আমার সাথে চল; তোমাকে দোকান দেখায়ে দিব। সাজেদুল তার সাথে পথ চলতে লাগল। লোকটি গল্পের ফাঁকে তাকে জিজ্ঞাসা করল; কেন তুমি অচেনা শহরে একা চলে এসেছ। এখানে কী তোমার কোন আত্মীয় আছে। কাকা না তো এখানে আমার কেউ নাই। তাহলে অজানা-অচেনা শহরে তুমি …?।
কাকা, আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। সেদিন ছিলো রোববার। বাড়িতে বাবা নাই। আমি ছোট বোন চম্পাসহ বাড়িতে ছিলাম। সকালে নাস্তা খেয়ে মা’কে বলিনি। বাড়ির অদূরে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের সংগে সাতগুটি খেলি। খেলা শেষে বাড়িতে গেলাম। বোন চম্পা বলল; ভাইয়া মা তোমাকে স্কুলে যাবার জন্য আশপাশে খুঁেজছে। একটু পরেই মা বাড়িতে এলো। আমাকে ঘরে ডেকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে জিজ্ঞাস করল কোথায় ছিলে ? কেন স্কুলে গেলে না। আমি ভয়ে থরথরে কাঁপছি। তখন মা’র ভীষণ রাগ দেখে চুপচাপ ছিলাম। মা’কে একবার বলেছি খেলার জন্য স্কুলে যেতে পারিনি। যে কারনে মা আমাকে সারাদিন ঘরে আটকে রাখে। যতক্ষণ না স্কুল ছুটি হয়; ততক্ষনে খেতেও দেননি। বিকেল সাড়ে চারটায় আমাকে ঘরের দরজা খুলে দিল। মা বলল তুমি আর কোন দিন স্কুল ফাঁকি দিবে?। তখনো মা’কে কোন উত্তর করিনি। মা যখন খাবার কথা বলে পাশের ঘরে গেলেন। আমি এই সুযোগে স্কুল ব্যাগে কাপড় গুছিয়ে অভিমান করে ট্রেনে চড়ে সিলেটে চলে এসেছি।
সাজেদুলের কথা শোনে লোকটি চলতি পথে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল। তার পিঠে হাত বুলিয়ে আক্ষেভ স্বরে বলল; ভুল করেছ! তুমি ভুল করেছো!। আবার পথ চলা শুরু করল। কাকা বাবু সাজেদুলকে বলল; আমি এগারো বছর আগে বাড়িতে বাবার সাথে রাগ করে ঘর ছেড়েছি। আমি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। এখনো বাড়িতে যায়নি। একটি কোম্পানীতে ছোট পদে চাকুরি নিয়েছি। মাসিক বেতন মাত্র নয়’শ টাকা। আমার আব্বা ছিলেন পড়া শোনার ব্যাপারে বেশ যতœশীল। বাড়ি থেকে আসার দীর্ঘদিন হলো ভাগ্যের কোন উন্নতি করতে পারেনি। শুধু অভিমান করে জীবনকে ধ্বংসের মুখে ধাপিত করেছি। আমার সেদিন থেকে লেখাপড়া কপাল থেকে উঠে গেছে। আজ বড্ড আপসোস করি। কিন্তু এখন আপসোস করে কোন লাভ নাই। জীবনে কিশোর বয়সে যা হারায়েছি; পৌঢ় বয়সে সেই ক্ষতি আর কখনো পুরণ হবে না। আমি আর বাড়িতে যায়নি।
সাজেদুল দেখছে কাকার চোখের পানি কপোলে গড়িয়ে পড়ছে। কাকা ভিজে গলায় বলল আজ বাবা-মা ও ছোট বোনেরা কে কোথায় আছে জানিনা! আমি সেই ভুলের মাশুল আদৌ পুরণ করতে পারিনি। আর কোন দিন পারবো না। কাকা এতক্ষণ তার শৈশব অভিমানের স্মৃতিচারণ করল। বলল সাজেদুল জান; মনে হয় দেশের বাড়ি গিয়ে মা-বাবার খোঁজ করি। কিন্তু আমাকে চিনতে পারবে কি ? যদি চিনে ফেলে তাহলে লজ্জায় কিভাবে মুখ দেখাব। আমার এতসব ভাবনা-চিন্তার কারণে আদৌ বাড়ি যাওয়া হয়নি। এতক্ষনে বাজারে একটি দোকান পেলাম। কাকা বাবু সাজেদুলকে কাগজের টুকরায় ঠিকানা লিখে দিল। আর বলল তুমি নাস্তা শেষে আশপাশ বেড়াও। সন্ধ্যায় এই ঠিকানায় চলে এসো। আমি কোম্পানীর কাজে গেলাম। (চলবে)
loading...
loading...
ধারাবাহিক গল্পের প্রথম অংশ পড়ে নিলাম। দেখা যাক সাজেদুল এর ‘অভিমানে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ’ সাজেদুলকে কতটা দূরে নিয়ে যায়। ধন্যবাদ বাসেত ভাই।
শুভ সকাল।
loading...
আপনাকে ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন এই কামনা।
loading...