বাবার কাছে বড় বায়না- মেলায় যাব টাকা দাও। আবিদ সাহেব কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, কিসের মেলা?
– কেন? জানো না, বইমেলা?
– জানি। কিন্তু তোমার আবার কিসের বইমেলা।
– বইমেলায় কি আমার তোমার বলে কিছু আছে নাকি!
– আছে। বইমেলা চক্ষু ওয়ালা মানুষের, অন্ধদের না।
শান্ত চোখ দুটো বড় করে বাবার চোখের সামনে মেলে ধরে। এই দেখ চোখ। চোখ। আমি তোমাকে খুব দেখতে পাচ্ছি বাবা।
আবিদ সাহেব পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে শান্তর মুখের উপর ছুড়ে মেরে বলেন, মানুষ হও।
টাকা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, আপাতত মানুষ না হলেও চলবে। শান্তর ক্ষুদ্র জীবনে সম্ভবত এই মানুষ হও শব্দটা সবচেয়ে বেশি শুনেছে। মানুষ কী!
কিশোর স্যার বই লিখেছেন। আসুন মানুষ হই। স্যারের নাম কিশোর হলেও তিনি মোটেও কিশোর নন। তেলতেলে বিরাট টাক মাথার ষাটোর্ধ্ব মানুষ। খোঁচাখোঁচা সাদা গোঁফ, দাড়ি জানান দেয়, তিনি বেশ কয়েক যুগ পেরিয়ে আসা সময়ের সাক্ষী। মানুষ নিয়ে স্যারের কৌতূহল আর গবেষণার শেষ নেই। একবার শান্তর ওপর রেগে গিয়ে বলেন, তুই কবে মানুষ হবি?
– মানুষ হব না স্যার।
অদ্ভুত জবাব শুনে স্যার চিন্তিত মুখে বলেন, কেন মানুষ হবি না রে?
– মানুষ বড় নির্মম প্রাণী স্যার।
– যারা নির্মম তারা মানুষ না।
শান্ চোখ বড় করে বলে, স্যার তাহলে তো আপনিও মানুষ না। স্যার মানুষটা সহ্য করতে পারেন না। বেত দিয়ে চটাচট কটা ঘা কষে দেন। ‘বেয়াদব।’
শান্ত পিঠ ডলতে ডলতে বলে, ‘বাস্তবেই দেখালেন স্যার!’ কিশোর স্যার শান্তকে আর দু’ঘা দিতে এসে কী মনে করে হেসে ওঠেন। বলেন, মানুষ হ। এতদিন সবক দিয়ে ক্লান্ত, ক্ষ্যন্ত বয়োবৃদ্ধ স্যার এবার বই আকারে মানুষ হওয়ার কলাকৌশল বিলি করবেন।
রাতে আফরোজকে নক করে, বইমেলায় যাবে?
– হ্যাঁ, আমি প্রতিবছর যাই।
– গুড। তাহলে এবার চলো, একসঙ্গে যাই।
– কী খাওয়াবে?
– মানে!
– মানে আবার কী? বললাম না, প্রতিবছর যাই, প্রতিবছর খাই।
– এটা তো ফুড আইটেমের কোনো মেলা নয়।
আফরোজ খিলখিল করে হেসে ওঠে। ‘খাওয়ালে আছি না হলে নাই। বাই।’
পরদিন বিকেল হতেই বইমেলায় হাজির হয় শান্ত। ঝাঁকবেঁধে দলে দলে হেঁটে চলা মানুষের ভীড়। ঘুরতে ঘুরতে দেখে মেলা প্রাঙ্গণের একপাশে ঘুপমেরে বসে বাদাম খাচ্ছে আফরোজ। মন-মেজাজ খুব একটা ভালো বলে মনে হয় না।
– কী অবস্থা?
– চলছে।
– কী চলছে! আফরোজের মেজাজ খারাপ হয়। কী আবার বাস। বাস চলছে।
হে হে করে গালভরা হাসি নিয়ে শান্ত বলে ওঠে, জীবনে এই প্রথম কোনো বাস গাড়ির সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হলো। আফরোজ বাদামগুলো শান্তর মুখের ওপর ছুড়ে মেরে হনহন করে হেঁটে যায়। ওর অবশ্য ঝনঝন করে হেঁটে যাওয়া উচিত। বাস মানুষ। হাসান চিৎকার করে, এই যে বাস আস্তে চলো। কারও ঘাড়ের ওপর উঠে যেও না। মেলায় যে ভিড়। আফরোজ চলে যাওয়ার অল্পক্ষণ পরেই দেখা হয় একঝাঁক বন্ধুর সঙ্গে। একই কলেজের, একই ক্লাসের জুলয়াস, বিপ্লব, নাঈম, হাসান …। শান্তকে দেখেই বেদম খুশি সবাই। একজন হাত, একজন মাথা, একজন জামা, একজন প্যান্ট ধরে টানাটানি। এক কথায় কচলাকচলি। এ বলে দোস্ত, ও বলে ফ্রেন্ড আরেকজন ডিয়ার, পেয়ার … গিয়ার পর্যন্ত যাওয়ার আগেই শান্ত চিৎকার করে, ছাড়। এটা কী বিগ ফাইটের স্টেজ নাকি। সর।
আড্ডা চলে। রাতের খাওয়াটা এখানেই হোক। বিপ্লবের প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হয়। একসঙ্গে তো আর এমন সুন্দর পরিবেশে খাওয়া দাওয়ার সুযোগ মেলেনা! মেলায় বসেই চূড়ান্ত হয় খাওয়ার মেনু। নামকরা রেস্টুরেন্টের বিরানি, কোমল পানীয়, কফি …। বিপল্গব গান ধরে, মেলায় খাইরে। গাইতে গাইতে খাবার আনতে বেরিয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক পর ভোজন পর্ব শুরু হয়। খেতে খেতে জুলয়াস বলে, বনে গিয়ে যে ভোজন তাকে বলে বনভোজন। শহরে ভোজনের কী কোনো নাম আছে। নাঈম জবাব দেয়, শহর ভোজন। এই যে আমরা শহর ভোজন করছি। হাসান বলে হয়নি, মেলায় বসে যে ভোজন তাকে মেলা ভোজন বলাই উত্তম। ওদের পাশকাটিয়ে যারা যায় তারা চোখ বড় করে তাকায়। যেন বেশ বড় অপরাধ করছে। তাদের হতেও বইয়ের বদলে চিপস, বিস্কিট বা অন্য কোনো খাবার! কেউ জুটিবেঁধে গল্পে গল্পে সময় কাটাচ্ছে।
আবিদ সাহেব অফিস শেষে মেলায় আসেন। স্টলে স্টলে নতুন বই। প্রাঙ্গণজুড়েই নতুন বইয়ের ঘ্রাণ। যত মানুষ, যত কথা, যত বই- পড়ার প্রতি উঠতি প্রজন্মের আগ্রহ তার চেয়ে কিছুটা কম। মেলা ঘুরে বাড়ি এসে ছেলের জন্য অপেক্ষা। রাত ১০টার দিকে শান্ত আসে।
– মেলায় গিয়েছিলে?
– হু।
– বই কিনেছ।
– না।
মুহূর্তে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন আবিদ সাহেব, আমার টাকা ফেরত দে।
তুমি থেকে তুই। শান্ত জানে সদুত্তর না দিতে পারলে দু’চারটা চড় থেকে নিস্তার নেই। ভদ্র ছেলের মতো জবাব দেয়, খেয়ে ফেলেছি।
– বই খেতে পারলে না?
– বই কি খাওয়া যায়! খাওয়া গেলে খেতাম।
– যায়। বইয়ের স্বাদ যারা বোঝে তারা বই খায়। তাদের জন্যই বইমেলা।
– তাহলে কিছু টাকা দাও। কাল মেলায় গিয়ে বই খাব। কষ্ট হলেও দু’একটা বই খেয়ে আসব।
১১.০২.২০১৯ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত
loading...
loading...
এক্সিলেন্ট মি. অয়েজুল হক।
loading...
শুভকামনা , ভালোবাসা প্রিয় মুরুব্বী।
loading...
বইমেলা আর খাইমেলা কই পার্থক্য !! নাই। একই তো লাগে।
loading...
হা হা । এজন্যই মেলায় খাইরে লেখা ☺
loading...
মানুষ হ আর বইমেলার পর্যালোচনায় মুগ্ধ হলাম। অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
loading...
কমেন্টেও মুগ্ধ হলাম । ☺
loading...
রম্য গল্পটি পড়ে ভালো লাগলো।
loading...
ধন্যবাদ আপু।
loading...
বেশ চমৎকার একটি লিখা।
loading...
ধন্যবাদ
loading...