নাসিমের ছোট খালা মাজেদা বেগম মাজা ব্যথায় মুষড়ে পড়েছেন। ডাক্তার দেখিয়ে, পাল্টিয়ে যা তাই। দিন-রাত মিলে এক পোয়া ওষুধ। ওজন দিলে দুই তিন কেজি পয়সা এক মাসে ওষুধের পেছনে খরচ। সবকিছুর পর ব্যথা যাওয়া দূরে থাক, দিন দিন সিরিয়াস হচ্ছে। ভাগ্নে নাসিম ঘটনা শুনেই বলে, সিরিয়াল দেন। মাজেদা বেগম কাতর কণ্ঠে বলেন, ব্যথা সিরিয়াস। কোথায় সিরিয়াল দেব?
-ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বড় বড় রুই কাতলা কোয়ালিটির ডাক্তার দেখাতে হলে সেখানে যাওয়ার বিকল্প নেই। পরামর্শ মতো দিন কয়েক পর সিরিয়াস ব্যথা নিয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সিরিয়াল দিন। লম্বা লাইন। ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। সিরিয়াল আস্তে আস্তে পেছনের দিকে যায়। অসুস্থ মাজেদা বেগম ভাগ্নে নাসিমকে বলেন, কিরে ডাক্তার কি পেছনে!
-না, সামনে।
-তা আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পেছনের দিকে যাচ্ছি কেন?
নাসিম ফেসবুক সিরিয়ালে। লম্বা সিরিয়ালের চ্যাটিং। চ্যাটিংয়ের সময় কী হচ্ছে, কে আছে না আছে, সে এখন কোথায়! ইহ জগৎ, পরজগৎ- সবকিছু মাথা থেকে হারিয়ে যায়। বেরিয়ে যায়। সিরিয়াল ব্রেক করে খালার কথার জবাব দেয়, বড় সিরিয়াল, অনেক মানুষ।
-সেজন্য কি সামনে না গিয়ে আস্তে আস্তে পেছনে যাব!
-সময় লাগবে। দেখেন না পৃথিবী পর্যন্ত ঘোরে। সব সময় কী এক জায়গায় থাকে।
সঙ্গে সঙ্গে নীলুর ফোন। খালার সামনে আপাতত রিসিভ করা যাবে না। কেটে দেয়। আবার ফোন। আবার…. খালা মাজেদা বেগম ক্লান্ত সুরে বলেন, কে ফোন দেয়?
নাসিম মিনমিন করে বলে, বাথরুমে সিরিয়াল দেওয়া ছিল। আমার ডাক পড়েছে। খালা জাস্ট মিনিট, আমি আসছি।
বাথরুমে সিরিয়াল, সেখান থেকে ফোন! সিরিয়াস ব্যাপার। মাজেদা বেগম বুঝে উঠতে পারেন না।
মোবাইল টিপতে টিপতে নাসিম সামনে এগিয়ে যায়। আবার নীলুর ফোন। রিসিভ করে বলে, হ্যাঁ, বলো। নীলুর ঝাঁজালো কণ্ঠ, কী আর বলব। আমি কত নম্বর সিরিয়াল? আমার আগে পরে কতজন আছে?
-মানে!
-আমি বাথরুমের লোক! বাথরুমে সিরিয়াল দেওয়া ছিল? সাফ বলে দিচ্ছি জীবনে আর কোনোদিন আমার সঙ্গে কথা বলবে না।
নাসিম চমকে ওঠে। সিরিয়ালে গণ্ডগোল বেধে গেছে। নীলু ফোন কেটেই ক্ষান্ত হয় না, বন্ধ করে দেয়। খালার কাছে আসতেই দেখে সিরিয়ালের অবস্থা সিরিয়াস। সামনের দিকে মারপিট শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে মারপিট ছুটে আসছে পেছনের দিকে। মাজেদা বেগম চোখ ছানাবড়া করে দাঁড়িয়ে আছেন।
-ও খালা চলো। দৌড় দিতে হবে। সিরিয়ালে আগুন লেগেছে।
-কী বলিস! সিরিয়ালেও আগুন লাগে!
-খালা বেঁচে থাকলে অনেক কথা বলা যাবে, আগে পালাই।
মাজা ব্যথা নিয়ে মাজেদা বেগম পড়িমরি করে ছোটেন। সামনে নাসিম। কোনোরকম হাসপাতালের গণ্ডিটা পেরিয়ে নাসিমকে বলেন, আর পারছি না। আমি মরে গেলাম।
-এই তো। চলে এসেছি। গাড়িতে উঠে পড়লেই হয়। রাস্তায় অটোরিকশা, রিকশা সিরিয়ালি দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে চালক। হাঁক ছাড়ে নাসিম, এই যাবেন?
-যাব বলেই তো দাঁড়িয়ে আছি।
-চলুন।
-কিসে যাবেন?
নাসিমের মন ভালো না। মন ভালো না থাকলে ভালো কথাও ভালো লাগে না। এ বেচারা বলছে ফালতু কথা। অটোরিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কিসে যাবেন!
-তোমার এইটা কি বাস, ট্রেন, প্লেন, রকেট, হেলিকপ্টার? রূপ বদলায়?
-মানে!
-ওই যে বললে, কিসে যাবেন। বিমানে যাব। চলো। তোমার এই ভড়ভড়ি মার্কা গাড়ি নিয়ে আধা কিলোমিটার যাওয়ার পর সাঁই করে ফ্লাই করবে। সব মানুষ অবাক হবে। চলো।
চালক আবার সে একই কথা বলে, কিসে যাবেন?
নাসিমের মেজাজ পুরোপুরিই গরম হয়ে যায়, এই ব্যাটা আমি কী তোর সঙ্গে ফাজলামি করছি? চালায় অটোরিকশা, বলে কিসে যাবেন, কিসে যাবেন। ইস, ভাবসাবে মনে হয় যেন বিমানের পাইলট।
চালকের উত্তেজিত হওয়ার কথা। বেচারা উল্টো ফিক করে হেসে দেয়। ভুল বোঝেন ক্যান স্যার। আমি তো বলছি আপনি গ্যাসে যাবেন, না তেলে যাবেন, মিটারে যাবেন না ভাড়ায় যাবেন, সাধারণ যাবেন না রিজার্ভ যাবেন। দ্রুত যাবেন, না আস্তে যাবেন। দেখেশুনে যাবেন, না ঝাকি খেয়ে খেয়ে যাবেন…..
-এই ব্যাটা থাম। তোর লম্বা ফর্দ শোনার সময় নেই। খালাকে নিয়ে সামনে পা বাড়ায়। পেছন থেকে চালক চিৎকার দেয়, যাবেন না স্যার।
-তোর যাওয়ার নিকুচি করি। আরও লম্বা সিরিয়াল বানিয়ে ক্যানভাসারদের মতো লেকচার দে। মাজেদা বেগম অসহায়ের মতো বলেন, সবখানে কী সিরিয়াল শুরু হলো রে নাসিম! কিছুটা পথ হেঁটে তারপর রিকশা ঠিক করে খালাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে একটা বোঝা নামায়। মাথার ভেতর নীলু ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকের ভেতর অশান্তি। নীলু, চিন্তা, অশান্তি। এসব নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। সকালে শীত দুপুরে গরম। সকালের পোশাক দুপুরে যন্ত্রণার বস্তু হয়ে উঠছে। একটা দশতলা বিল্ডিং দেখে থমকে দাঁড়ায়। নয়তলায় মাসুম ভাই থাকেন। মাসুম ভাই বয়সে অনেক বড় হলেও বন্ধুর মতো আচরণ করেন। মাসুম ভাইয়ের বাসায় গিয়ে প্রথমেই মোবাইলটা বের করে। নীলু ব্লক করেছে। সিরিয়ালি ম্যাসেজগুলোর দিকে চোখ বুলায় নাসিম। তোমার কী মনে পড়ে প্রথম দিনের কথা।
কীভাবে ভুলি।
আচ্ছা, তুমি আমাকে কত ভালোবাসো?
বড় সিরিয়াল, অনেক মানুষ।
মানে! তুমি কী আরও কারও সঙ্গে…..? উত্তর দাও। অন্য কার সঙ্গে চ্যাট করছ?
সময় লাগবে। দেখেন না পৃথিবী পর্যন্ত ঘোরে। সব সময় কি এক জায়গায় থাকে।
-দেখেন না মানে! তারপর ম্যাসেঞ্জারে কল। রিসিভ কল! খালার সঙ্গে মোবাইল টিপতে টিপতে যে কথা হয়েছে ভুল করে সে কথাগুলোই লেখা হয়ে গেছে। কল কাটতে গিয়ে কখন যে একটা রিসিভ হয়েছে সেটাও অজান্তেই। নীলুকে কীভাবে বোঝাবে এসব। মাসুম ভাই হাত ধরে বলেন, যখনি আসিস মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকিস। নাসিম বোকার মতো মাসুম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। শামীমা ভাবি যেমন টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছেন, ঠিক তেমন। মাসুম ভাইয়ের আড়াই বছরের সন্তান, ন্যাংটো অবস্থায় পাশের রুম থেকে দৌড়ে আসে। দেড় হাত মতো পা ফাঁক করে রিমোট হাতে নিয়ে কিছুটা বীরের মতো টিভিটা অফ করে দেয়। কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা না বুঝে, মুহূর্তেই। চটাস করে আছড়ে পড়ে পেছনে বসে থাকা মা নামক ভদ্র মহিলার পাঁচ আঙুলের বিরাট থাপ্পড়। ছোট শিশুটা হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে সামনে পড়ে। ভদ্র মহিলার সেদিকে লক্ষ্য নেই। হাত থেকে ছিটকে পড়া রিমোটটি হাতে নিয়ে গদগদ করতে করতে বলেন- ইসসস্ ! মায়ের মমত্ব সিরিয়ালটার কতখানি বাদ পড়ে গেল রে…।
নাসিম বিড়বিড় করে বলে, সিরিয়াল সিরিয়াস।
৪ ফেব্রুয়ারী- ২০১৯, দৈনিক সমকালে প্রকাশিত।
loading...
loading...
আপনার লিখা গুলোর একদম একদম শুরু'র পাঠকদের একজন আমি।
বরাবরই যা ভালো লাগতো এখনও সেটা সেটা লাগে, তা হচ্ছে আপনার লিখার শব্দ শৈলীতে অসাধারণ পরিমিতি বোধ। চমৎকার আপনার ভাবনা সমগ্র।
অভিনন্দন প্রিয় গল্পকার মি. অয়েজুল হক।
loading...
গল্পটির উপস্থাপনা চমৎকার হয়েছে অয়েজুল ভাই।
loading...
শুভেচ্ছা জানবেন গল্পকার দা। ধন্যবাদ।
loading...