ঈশ্বর বিশ্বাস

********প্রাককথন*******

যে কোনো বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই আমাদের মধ্যে জন্ম দেয় ঐ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের! অর্থাৎ বিষয়টি সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞানের অভাব থাকলেই হয় আমরা সেটির সম্বন্ধে মনগড়া প্রচলিত ধারণাকে বিশ্বাস করি! অথবা সেই ধারণাটিকে অবিশ্বাস করি!
আর এইভাবেই সীমিত বুদ্ধিতে বিষয়টিকে বুঝে নেবার প্রয়াসে নিজেদের সান্ত্বনা জোগাই!

যতদিন প্রমাণ হয়নি পৃথিবী সূর্য্যের চারিধারে ঘুরছে ততদিন শুধুমাত্র সত্য জ্ঞানের অভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে আমরা বিশ্বাস করতাম সূর্য্যই পৃথিবীর চারধারে ঘুরছে! বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্বন্ধে এই হল শাশ্বত বাস্তব চিত্র! অর্থাৎ প্রকৃষ্ট জ্ঞানের ভিত্তিতে যখন কোনো সত্যকে জানি, অনুধাবন করতে পারি; তখন কিন্তু আর, কোনো বিশ্বাসের কিংবা অবিশ্বাসের ওপর আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় না! তাই ঈশ্বর আছেন কি নেই, থাকলে তিনি সাকার না নিরাকার এই বিষয়ে আমাদের ধারণাও সেই মনগড়া বিশ্বাস অবিশ্বাসের ওপরেই নির্ভরশীল! অর্থাৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও রূপ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা সেই বিশ্বাস অবিশ্বাসের গণ্ডীতেই অন্ধের মত ঘুরপাক খায়! কারণ বিজ্ঞান বা দর্শন আজও অভ্রান্ত ভাবে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেনি! যদিও বিশ্বের সব দর্শন চিন্তার আদি উৎসই হল বিশ্বসত্যের রহস্যকে কেন্দ্র করে! এবং বিজ্ঞানও সেই রহস্য উন্মোচনে সদা সক্রিয়!

*********(এক)*********

জীবজগতে স্বপ্রাণ বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যে একমাত্র মানব মনই বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা দিয়ে প্রশ্ন করতে জানে! অন্যান্য কোনো প্রাণীই প্রশ্ন করতে জানে না! তারা প্রাপ্ত জীবনকে বিনা প্রশ্নেই গ্রহণ করে! কারণ তাদের চেতনায় কোনো বিস্ময় বোধ নেই! কিন্তু মানুষ তাঁর চেতনা উন্মেষের ঊষা লগ্ন থেকেই জগতের দিকে চোখ মেলে ছোটো বড়ো বিভিন্ন বিষয়ে বিস্মিত হতে থাকল! যত তার বিস্ময় তত তার প্রশ্ন তত তার নতুন নতুন জিজ্ঞাস্য! কিন্তু যত প্রশ্ন ততই তো হাতের কাছে চট জলদি উত্তর নেই! এক একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে লেগে গেছে কত প্রজন্ম! কত অণ্বেষন! কত পরীক্ষা নিরীক্ষা! কত ভুলের পাহাড় পেড়িয়ে এক একটি উত্তর!জীবনযাপন ও জীবন রক্ষার প্রয়োজনে মানুষ দেখল এই বিশাল জগতে প্রবল প্রকৃতির অসীম শক্তির কাছে সে কত অসহায়! কতই দূর্বল তার সমস্ত প্রয়াস! প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামনে তার উপলব্ধি হল কোনো বিরাট শক্তি রয়েছে এর পেছনে! সেই অদৃশ্য অপ্রত্যক্ষ কিন্তু প্রবল শক্তির তুলনায় তার ক্ষুদ্রতা অসহায়তা তাকে বাধ্য করল উত্তরহীন এই প্রশ্নের কাছে বিনীত হতে! সেই অজানা শক্তির কাছে সে সমস্ত জাগতিক বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাবার প্রার্থনা নিয়ে উপস্থিত হলো! এই ভাবে প্রকৃতির বিশালতায় প্রবল শক্তির মহিমায় তার মধ্যে ধীরে ধীরে এই শক্তির প্রতি জেগে উঠল বিস্ময়! এবং শ্রদ্ধা! শুরু হল এই শক্তির পূজা! জন্ম হল ঈশ্বরের! মানুষের বিশ্বাসে!

**********(দুই)*********

সভ্যতার সেই আদি যুগে ঈশ্বর ভাবনা ছিল মূলত প্রাকৃতিক শক্তিকে সন্তুষ্ট রাখার একান্ত প্রয়াস যাতে প্রতিদিনের জীবনযাপন ও জীবন রক্ষা সহজ সাধ্য হয়! সাধারণ মানুষ চিরকালই শান্তিতে থাকতে পছন্দ করে! এবং অজানা আশঙ্কার ভয় তাকে সব সময়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়! কারণ তার অধিকাংশ প্রশ্নেরই উত্তর ছিল না হাতের কাছে! তাই বিভিন্ন সাম্ভব্য অসাম্ভব্য বিপদ আপদ থেকে উদ্ধারের আর্জি নিয়ে সে প্রাকৃতিক বিভিন্ন শক্তির কাছে উপস্থিত হলো! এই ভাবেই সৃষ্টি হতে থাকল এক এক প্রাকৃতিক দেবদেবীর! গড়ে উঠল পূজার নানাবিধ উপাচার! যা জাতি ধর্ম বিশেষে স্বভাবতই বিভিন্ন! কিন্তু উদ্দেশ্য ও মূল ভাবনায় সাযুয্য সম্পন্ন!চিন্তা ভাবনার ব্যাপ্তীর সাথে স্বভাবতই মানুষের মনে হতে থাকল এই সব প্রবল প্রাকৃতিক শক্তির অন্তরে নিশ্চয়ই কোনো অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাক্তিসত্ত্বা আছে! যার সচেতন ইচ্ছার সৃষ্টি এই জগত সংসার! এবং যার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল সমস্ত মানব জীবন! ফলত মানুষের মনে হতে থাকল এই ব্যাক্তিসত্ত্বাকে সন্তুষ্ট করতে পারলে বিভিন্ন ইচ্ছাপূরণ সম্ভব! শুরু হল ঈশ্বরবন্দনা ঈশ্বর পূজো! বিভিন্ন জনগোষ্ঠিতে বিভক্ত মানব সভ্যতায় এই ভাবে গড়ে উঠল ঈশ্বরতত্ব! চিন্তাশীল মানব তার বুদ্ধিবৃত্তিতে খুঁজতে থাকল এই জগত সৃষ্টির রহস্য! শুরু হল দর্শন চর্চা! এবং তার পর বিজ্ঞানের হাত ধরেও আজও চলেছে বিশ্বতত্ব রহস্য উন্মোচনের সাধনা!

*********(তিন)*********

একদিকে কাল্পনিক ঈশ্বরকে খুশী রেখে জাগতিক জীবনে সুখে থাকা আর অন্য দিকে বিশ্বরহস্য উদ্ধারে চিন্তা শক্তি নিয়োগ করা, এই দুই পথেই চলতে থাকল মানুষ! কিন্তু তবু মানব জীবনে প্রার্থিত সুখ শান্তি আসল না! সমাজ জীবন হতে থাকল কলুষিত! তখন, যারা এর কারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হলেন তারা অনুধাবন করলেন মানুষের স্বভাব প্রবৃত্তিতে এমন অনেক কু-প্রবৃত্তি আছে যেগুলি সংযমের শৃঙ্খলে না বাঁধলে সমাজ জীবন সুস্থ হতে পারে না! সেই প্রবৃত্তিগুলিকে শাসনে রেখে পারস্পরিক উন্নতির ও শান্তির জন্য তাঁরা চালু করলেন কিছু অনুশাসন! কালক্রমে এই সব অনুশাসনে জনগণকে শৃঙ্খলিত করার জন্য যোগ করা হলো ঈশ্বর ভাবনাসাধারণ মানুষকে বোঝানো হল অনুশাসনগুলি না মানলে ঈশ্বর রুষ্ট হবেন! মানলে তিনি হবেন সন্তুষ্ট! জীবনে যদি প্রার্থিত সুখ নাও আসে পরলোকে স্বর্গবাস সুনিশ্চিত! কিংবা পরজন্মে থাকা যাবে রাজার হালে! জীবন যাপনের জন্য সৃষ্টি হল বিভিন্ন নিয়ম নীতি! বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে এই বিষয়গুলি নিয়ে গড়ে উঠল নানা লোকাচার! অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত ধীশক্তি সম্পন্ন এক এক জন মানব বিশ্বসত্য সম্বন্ধে তাঁদের মতবাদ প্রচার করলেন! কেউ কেউ এগিয়ে এলেন সমাজ সংস্কারে! গড়ে উঠল তাঁদেরকে কেন্দ্র করে এক একটি শিষ্য সম্প্রদায়! কালক্রমে এই সব সম্রদায়ের বিস্তারে গড়ে উঠল এক একটি ধর্ম গোষ্ঠী! ঈশ্বর ভাবনা বদ্ধ হল গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত মতবাদে!

**********(চার)********

ফলে কালক্রমে আমাদের ঈশ্বর ভাবনা সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে গেল! শৃঙ্খলিত হল ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন ভাবনা– সাম্প্রদায়িক সমষ্টি বদ্ধতার বেড়াজালে! এবং সৃষ্টি হল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের ঈশ্বর ভাবনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব! এবং প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের ধ্যান থেকে দূরে সরে এসে, বিশ্বতত্বের রহস্য অনুসন্ধান ছেড়ে আমরা সাম্প্রদায়িক ধর্মের কূটকাচালিতে নিমগ্ন হলাম! ঈশ্বরের সম্বন্ধে আমাদের ব্যস্ততা পড়ে থাকল শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত সুখ কামনার চৌহদ্দিতেই! আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থখরচ করে পূজো দিই আর ঈশ্বরের কাছে প্রাথনা করি নিজের সুখ সাচ্ছন্দের!সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল প্রত্যেক সম্প্রদায়ের বিশ্বাসে তাদের ঈশ্বরই শ্রেষ্ঠ! এবং মহৎ! এবং অন্য সম্প্রদায়ের ঈশ্বরে বিশ্বাস প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কাছেই মহাপাপ! ভাবতে অবাক লাগে, কাল্পনিক এক ঈশ্বর নিয়ে এই মানব বিশ্বে মানুষের পরস্পরের মধ্যে কত হানাহানি রক্তপাত! কত রাজনীতি! কত সাম্রাজ্যর উত্থান পতন! কত প্রাণ বলি হল অকালে! অথচ আজও মানুষের কল্পিত ঈশ্বর মানুষের কাছেই রয়ে গেল অধরা! আজও প্রমানিত নয় তার অস্তিত্ব! আজও জানা গেল না তিনি সাকার না নিরাকার? এবং এই না জানার কারণেই বিভিন্ন কল্পিত মতবাদের খাঁচায় তাকে আবদ্ধ রাখতে হয়! পাছে তাকে নিয়ে কল্পনার ফানুসটি ফুটো হয়ে যায়! তাইতো কল্পিত বিশ্বাসেই তার অস্তিত্ব!

শ্রীশুভ্র।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৭-১০-২০১৭ | ২৩:১২ |

    'কালক্রমে আমাদের ঈশ্বর ভাবনা সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে গেল! শৃঙ্খলিত হল ব্যক্তি মানুষের স্বাধীন ভাবনা– সাম্প্রদায়িক সমষ্টি বদ্ধতার বেড়াজালে!
    সৃষ্টি হল বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের ঈশ্বর ভাবনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব!'

    ___ অতীব সত্য কথন। এমন ধরণের আলোচনা জ্ঞানের দৃষ্টি প্রসারিত করে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...