“আমাগো ঘরে চান্দ আহে না রে মা। জোছনা এইখানে লজ্জা পায়। চাঁদের রূপ ধইরা দুঃখ আহে শুধু। দুঃখের নাম আমরা চান সুরুজ রাখি। ”
মায়ের এসব তত্ত্ব কথা চৌদ্দ বছরের জলপরীর মাথায় ঢুকে না। সে ভাঙা চৌকির এককোণে তেলচিটচিটে কাঁথা গায়ে দিয়ে জড়োসড়ো শুয়ে জোছনার আনাগোনা দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে।
আসলেই তেরো চৌদ্দ বছর বয়সটা দারুণ আবেগে ভরা থাকে। তাই বুঝি জলপরীর চোখে মায়ের আঁকা এসব দুঃখকেও চাঁদ মনে হচ্ছে, জোছনা মনে হচ্ছে। ছাপড়া ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের উকিঝুকি, জোছনার লুটোনো শরীর জলপরীর চোখ, মন সব ধাঁধিয়ে দিচ্ছে যেন।
চিলতে মাটির বারান্দায় মা বেলাবানু উনুনে ভাতের হাড়ি চড়িয়ে আধভেজা পাতা ঠেলে ঠেলে আগুন দিচ্ছে । ভেজা পাতার ধোঁয়ায় চারপাশ ধোঁয়াটে হয়ে যায়। উনুন মানে ক’খানা ভাঙা ইটের ত্রিভুজ অবস্থান। তাতেই তাদের একবেলার রান্না বেশ ভালোমতোই চলে যায়।
এ বস্তিতে এখনো শীত তেমনটা ঝাঁকিয়ে বসেনি। তবে শহরের দালানকোঠায় শীত না ঢুকলেও বস্তির ছাপড়া ঘরে দুঃখের আরেকটা অঙ্গ হয়ে চাঁদ জোছনার মতো শীতেরা ও হুড়মুড়িয়ে ঢুকে।
মা একা একা বকবক করে চলেন। পাতাপোড়া ধোঁয়ায় চোখ দিয়ে পানি ঝরে। আগুন নিভু নিভু হয়ে আসে। বেলাবানু মাথা নুইয়ে জোরে জোরে আগুন ফুঁকে আর মেয়েকে কথা শোনায়।
ঃ কামাই খাইতে গেলে মাইয়াগো ইসকুলে দেওন নাই। দুই কেলাশ পাশ দিতে না দিতে আমার মাইয়া এখন লাটসাহেবের বেটি বইনা গেছেন।
জলপরী এসব শোনে না। সে ছয় ক্লাসে পড়া কৈশোর ডিঙানো প্রায় তরুনী । গায়ে গতরেও বেশ বাড়ন্ত। কাকবন্ধ্যা বেলাবানুর একমাত্র সম্বল। দ্বিতীয় স্বামী সানু মিয়ার ঘরে এসেছে আজ এতগুলো বছর। কোন সন্তানাদি নাই।
বেলাবানু তো বন্ধ্যা না। আসলে সানু মিয়ারই যত সমস্যা।
“পুরুষ মানুষকে কি আর বন্ধ্যা বলা যায় ? আরো কিছু নেতিবাচক শব্দের মতো এই শব্দটা ও কেবল মেয়েদের জন্য বরাদ্দ করেছে আমাদের সমাজ। ” বেলাবানু যে বাসায় কাজ করে ওই বাসার মেমসাহেব এসব কথা বলেছিলেন। ওসবের খুব একটা তার মাথায় না ঢুকলেও সানু মিয়ার সন্তান দেয়ার যে ক্ষমতা নেই তা বেলা ভালো করেই জানে। সন্তান চায় না বেলা। সানু মানুষ হিসেবে খুব খাঁটি। তার প্রবল ভালবাসায়,বেলার সব কষ্ট কর্পূরের মতো উড়ে যায়।
ঠেলাগাড়িটা শক্ত দড়ি দিয়ে বারান্দার খুঁটির সাথে বাঁধতে বাঁধতে সানু মিয়া বলে
ঃ মাইয়াডার সাথে তোর খুটখুটানি শুরু হইয়া গেলো বউ ?
ঃ কি করবো ? সারাদিন বাসায় কাজ করি। পাতাগুলানেরে রোদে শুকাইতে দিলেও তো পারে।
ঃ বইলা গেলেই তো পারতি।
ঃ বইলা বইলা কতকাল কাম শিখামু। গরীবের ঘরে জন্মাইছে। কাজ কাম না জানলে খাইবো কেমনে?
ঃ আমার মাইয়ারে বড় বড় পাশ দেয়ামু দেহিস। তোর মতো কামের বেডি হইবো না।
উনুনের পাশে বসে দুই হাত উল্টে পাল্টে ঘসে ঘসে আগুনের তাপে দিতে দিতে সানুমিয়ার চোখ চকচক করে ওঠে। এই মেয়েকে নিয়ে তার স্বপ্নের শেষ নেই। মেয়েটার বাবা নেই, সেই তো জলপরীর বাবা। তার আদুরে বউ বেলার নাড়িছেঁড়া ধন। জলপরীকে ভালবাসতে শিখেছে সানু মিয়া বেলার ভালবাসা দেখে দেখে।
ধোঁয়ার তান্ডবে আর উনুন ফুঁকিয়ে নাকের জল চোখের জলে বেলাবানুর ফর্সা মুখ লাল টকটকে হয়ে যায়। সানু নিজের গামছা দিয়ে বেলার মুখটা মুছে দিয়ে নিজেই আগুন ফুঁকতে থাকে। বেলা ভাবে চাঁদ জোছনারা ভাঙা বেড়ার ফাঁক গলিয়ে কেবল দুঃখ হয়ে ঢুকে না, রাশি রাশি সুখ হয়ে ও ঝরে।
আজ ভরা পূর্ণিমার রাত।
সারাদিন দু’জনই এত খাটাখাটুনি করে যে রাতের খাবার খেয়েই ওরা ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। গরীবরা তাই হয়তো পূর্ণিমা বুঝে না, ‘ঝলসানো রুটি’ ভেবে পূর্ণিমা গিলে খায়। কিন্তু না, আজ সানু মিয়া বউকে নিয়ে ঝলসানো রুটির বদলে স্নিগ্ধ পূর্ণিমা খাবে। ঘরে সোমত্ত মেয়ে, তাই বাইরে চিলতে বারান্দায় উনুনের পাশেই দু’জন হারিয়ে যায় সুখের স্বর্গরাজ্যে।
জলপরী পিতামাতার সুখের শব্দে বিমোহিত হয়।
পরদিন ঘুম ভাঙে অনেক বেলায়। বস্তির কলতলায় এই ভোরেই মেয়েপুরুষের লম্বা লাইন লেগে যায়। লম্বা লাইন ধরে নাইতে গেলে বেশ দেরি হয়ে যাবে ভেবে বেলাবানু দ্রুত বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। জলপরী ঘুমেই থাকে।
বাসায় ঢুকতেই মেমসাহেব রাগত স্বরে জানালেন
এভাবে কাজে দেরি করে আসলে তিনি অন্য বুয়া দেখবেন। বেলা কোন কথা না বলেই কিচেনে ঢুকে। সে জানে এখানে কথা বলা অনর্থক।
দ্রুত হাতে কিচেনের কাজ সারে, টেবিলে নাস্তা লাগায়। এদিক ওদিক ছুটাছুটিতে ক্লান্ত হয়ে হাঁপায়। মেমসাহেবের নজর এড়ায় না।
একা এক হাতে এত কাজ না করে মেয়েকে সাথে আনলেই পারো বুয়া।
ঃ মেয়ে তো ইসকুলে যায় মেমসাহেব। আজ ইসকুল খোলা।
ঃ স্কুলে পড়ে কি হবে? সেই তো বুয়াগিরী। তোমাদের এসব আদিখ্যেতা দেখলে গা পুড়ে যায়। ঘোড়ারোগ আর কাকে বলে !
মেমসাহেব আপন মনেই গজগজ করতে থাকেন। বেলা নিরুত্তর। একমনে নিজের কাজ করে। সে নিজেও জানে তার পেয়ে “ইসকুলের শেষ কেলাশ” ও পাশ দিতে পারবে না। এখনি বস্তির মাস্তান ছেলেগুলোর ছোকছোক চোখ দেখতে পায়, তার মেয়ের শরীর জুড়ে ছেলে বুড়ো সবগুলো পিশাচের লালসা খেলা করে। মেয়ের নিরাপত্তা সে দেবে কেমন করে। ভোর হলেই বাসায় ছুটে যাওয়া, রাত করে ঘরে ফেরা। সারাদিন মেয়েটার জন্য মন আঁকুপাকু করে। সেদিন খুব মনমরা হয়ে সানুমিয়াকে ছেলে দেখতে বলে বেলা। সানু মিয়া তো রীতিমত ক্ষেপে যায়। বেলা নীরবে চোখ মুছে। সানু তার ময়লা গামছা দিয়ে বেলার চোখ মুছে দিতে দিতে বলে
ঃ দেহিস বউ আমগো মাইয়া অনেক বড় মানুষ হইবো।
বেলা এসব কল্পিত সুখে গা ভাসায় না। সে জানে মেয়েমানুষ হয়ে জন্মানোর কষ্ট কতখানি। বাসা বাড়ির কাজের বুয়া হয়ে খুব নির্বিঘ্নে জীবন পার করেনি সে। তার শরীরে কত অলিখিত কথা গোপন আছে একমাত্র সে নিজে জানে। এখনো এই চল্লিশ বছর বয়সে ও কি সে নিরাপদ ! মনে মনে হাসে বেলা। মেমসাহেবরা কত নজরদারীতে রাখেন নিজেদের পুরুষগুলোকে, অথচ ভাবতেও পারেন না পুরুষ নামক এসব ক্ষুধার্ত নরপিশাচরা কোন নজরদারীতেই বন্দি থাকে না। রূপসী বেলাবানুর অভিজ্ঞতার ঝুলি একেবারেই ছোট নয়।
এ বাসার মেমসাহেব যতবারই জলপরীকে এখানে আনতে বলেছেন, বেলা ততবারই পড়াশুনার অজুহাত দেখিয়ে মেয়েকে দূরে রেখেছে।
তবুও কি শেষ রক্ষা হয় !
আজ কেনো জানি বেলার কোন কাজে মন বসছে না। বার বার উল্টাপাল্টা করছে দেখে মেমসাহেব বিরক্ত হচ্ছেন।
আচমকাই বড় পাইরেক্সের ডিসটা হাত থেকে পড়ে চুন চুন হয়ে ভেঙে গেলো। মেমসাহেব তো রীতিমত হায় হায় করে উঠলেন। চিৎকার চেঁচামেচিতে ওঘর থেকে সাহেব ও দৌড়ে আসলেন।
ঃ থাক না। ভঙুর জিনিস, পড়ে ভেঙে গেছে। এত চিৎকার করছো কেনো?
সাহেবের কথা শুনে মেমসাহেবের মেজাজ সপ্তমে উঠলো। মেম সাহেবের তীক্ষ্ণনজরে যেনো বেলার শরীর ভস্ম হয়ে যাচ্ছিল।
সাহেবের দুর্বলতা কোথায় তা তো বেলা জানে। তবুও পাশে এসে দাঁড়ানোতে মন অনেকটা ভালো হলো।
জলপরী স্কুল থেকে ফিরলো কিনা কে জানে। সানুমিয়াকে ফোন দিলো বেলা। কিন্তু সে তো ঠেলায় সবজি নিয়ে ফেরি করতে অনেক দূর চলে গেছে।
সন্ধ্যে নামার আগেই মেমসাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ির দিকে দ্রুত পা চালালো বেলা। ঘর অন্ধকার। ধক করে উঠলো মায়ের মন। পলিথিন মোড়া চাটাইয়ের দুয়ারখানা টেনে ভীত পায়ে ঘরে ঢুকলো সে।
ঃ জলপরী, ও জলপরী
জলরঙে আঁকা জলছবিটার কোন সাড়াশব্দ নেই।
ঘরে পা দিতেই পায়ের নিচটা চটচট করে ওঠে। বেলা টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে জলছবিটায় হাত রাখে। মুহূর্তেই সারাঘরে নেমে আসে এক ভয়ানক শীতল অন্ধকার। সে বিভৎস অন্ধকারে একটু একটু করে যেন বেলা তলিয়ে যেতে থাকে। সানুমিয়ার চকচকে স্বপ্নগুলো ও সেইসাথে এক সমুদ্র নোনাজলের স্রোতের তোড়ে কোথায় যেনো নিমেষেই হারিয়ে যায়।
loading...
loading...
লিখাটি পড়ে মন থেকে দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো। এমন সব ভাগ্য বিড়ম্বনা আর নিম্নবিত্তের নির্মমতা … এমনকি আমাদের আশেপাশের জীবনের সব গল্প গুলোন আঁধারেই মিশে যায়। গল্প হয়েই থাকে। পড়ি ঠিকই দেখি ঠিকই করার কিছু থাকে না।
সার্থক অণুগল্প আপা।
loading...
গল্পগুলো তো জীবন থেকেই উঠে আসে । তারপর ও জীবনের সবকথা কি আর গল্পে ঠাঁই পায় । আমাদের আশেপাশে কত নির্মমতা , কত অবিচার ! কেই বা তার হিসেব রাখে ?
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...
আপনাকেও ধন্যবাদ। শুভ সকাল।
loading...
গল্পটি পড়ে মুগ্ধ তো বটেই মনটাও কেমন জানি করে উঠলো দিদি ভাই।
loading...
ঠিকমত ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি কি না দ্বিধায় ছিলাম ভাই। অনেক ভালবাসা।
loading...
আপনার উপস্থাপনা আমাকে একটি ঘোরের মধ্যে বেঁধে ফেলেছিলো বোন।
loading...
গল্পে সুন্দর অনুভূতি রাখার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
loading...
অসাধারণ সুন্দর লেখনীতে মুগ্ধতা রেখে যাই।
ভালো থাকুন শ্রদ্ধেয়।
loading...
আমার পোস্টে আমার প্রথম মন্তব্যকে স্বাগত জানাই। অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
loading...
রুকশানা হক ,
শিল্পী জীবন আঁকে জলরঙে। কবি আঁকে সবুজে, আকাশের নীলে, জলের কলকন্ঠে,পাখির কূজনে। আপনি জীবন এঁকেছেন বাস্তবের তুলিতে। আর তাই সেটা অনবদ্য জীবনঘনিষ্ঠ হয়েই ফুঁটে উঠেছে। বিউটিফুল !
loading...
আপনার চমৎকার মন্তব্যে উৎসাহ পেলাম । জীবনের সব ছবি জলরঙে আঁকা হয় না, আর হয়না বলেই স্বপ্নেরা জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ায়। ভালো থাকুন প্রিয় কবি।
loading...
মন ছুঁয়ে গেল গল্পটি।
loading...
পাশে আছেন বলেই গল্পরা মন ছুঁতে পারে — ভালবাসা সুপ্রিয়।
loading...