গল্পঃ নায়িকা সংবাদ

images

আমরা একে অপরকে যে ভালোবাসি একথা বলি নি কখনও আসলে তেমনভাবে বলার সুযোগ হয় নি আর কি। তবে আমি আর মিহির আমরা পরস্পর খুব ভালো বন্ধু ছিলাম এ ব্যপারে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।আমাদের সম্পর্কটা সেই ছোটবেলা থেকেই।

ওর সাথে, আমি আমার ছোট ছোট দুঃখ কষ্টগুলো খুব সহজে ভাগ করে নিতে পারতাম। গল্প করতে করতে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব কথা বলতে বলতে আমরা কপোতাক্ষকে সাক্ষী রেখে বহু দূর হেঁটে যেতাম। বহুদূর।

শেষ বিকেল গড়িয়ে যখন বকেরা ঝাঁক বেধে নীড়ে ফিরতো তখন আমরাও ফিরতি পথ ধরতাম। ও বরাবরই বেশ মনোযোগী শ্রোতা আর ভীষণ যত্নশীল ছিল আমার প্রতি। মিহিরের মা’ও ছিলেন খুব বেশি রকমের ভালো মনের মানুষ। আমার দুঃখ কষ্টগুলো তিনি খুব সহজে পড়তে পারতেন, আমাকে অনুভব করতেন অন্তর দিয়ে। তিনি আমাকে একনজর দেখে সবটা বুঝে নিতেন মুহুর্তেই, আমার হাসি আমার আনন্দ আমার কান্না। আমার অভুক্ত শুকনো মুখ দেখে কপট রাগ দেখিয়ে আমার উদর পুর্তির ব্যবস্থা করতেন। আমার কোন আপত্তি তখন ধোপে টিকতো না। তারপর কি জানি কি হলো খালাম্মা হঠাৎ করে অসুস্থ হলেন।

সামান্য উপসর্গ যে ক্যান্সারে রুপ নেবে তা কে ই বা জানতো? ক্যান্সার ধরা পড়ার অল্প কদিন পরে তেমন একটা চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই হুট করে তিনি চির বিদায় নিলেন। ঘটনা আকষ্মিকতায় মিহির কেমন যেন হকচকিয়ে গেল।এত চটপটে আর মেধাবী একটা ছেলের মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন দেখা দিলো। ওর এই অসহায়ত্ব ওকে আরও বেশি আমার কাছাকাছি নিয়ে এলো। দিন দিন আমার প্রতি ওর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকলো। আমিও ঋণ শোধ করার সুযোগ পেয়ে সাধ্য মত ওর পাশে থাকার চেষ্টা করলাম। এদিকে ওর বাবাও চাইতো আমি ওদের বাড়ি যাই। ওকে সংগ দেই স্বান্তনা দেই পাশে থাকি। এসব নিয়ে পাড়া প্রতিবেশি যখন আমার মাকে নানা রসালো কথা শোনাতে শুরু করলো তখন এক প্রকার বাধ্য হয়ে মা ওদের সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ করে দিতে বললো।

কিন্তু আমি তবুও লুকিয়ে চুরিয়ে মিহিরদের বাসায় যাই ওদের খোঁজ খবর নেই। টুকটাক রান্না বান্না করে দিয়ে আসি সময় সুযোগ মত।
একদিন মিহির কি কাজে যেন শহরের বাইরে গেল তখন ওর বাবার ব্যবহারে ভীষণ আহত হলাম আমি। মানুষ এত জানোয়ার হয় কি করে? এই ব্যপারটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি বাঁধা দিয়ে ছিলাম সর্বশক্তি দিয়ে কিন্তু অসুরের কাছে আমি পরাস্ত হলাম। আসলে আত্মরক্ষার কৌশল আমার জানা ছিল না। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আধাঘন্টা ধরে পাশবিক যন্ত্রণা সইলাম।

মানুষকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে কিছু মানুষ নোংরা সুখ পায়। আসলে এ ধরনের মানুষের মনুষ্যত্ববোধ বলে কিছু থাকে না।

আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়ে
যখন আমার বাবা মারা গেল খুব ছোট তখন। আমি অত কিছু না বুঝলেও ক’দিনের মধ্যে এটুকু বুঝলাম আমাদের অবস্থান টলে গেছে বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে। আমার নানুরা আমার মাকে আবার বিয়ে দিলো কয়েক মাসের মাথায়। পরিবারটি যৌথ পরিবার ছিল।

বছর পাঁচেক পরের কথা এক ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমি আমার কৌমার্য হারালাম আমারই সৎ বাবার ছোট ভায়ের কাছে। এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে এলেই সে সুযোগ নিতো, আমি ভয়ে লজ্জায় ঘৃণায় কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। তাছাড়া আমি তখন নিজের সম্মান দুটো ভাত আর সামাজিক নিরাপত্তার খাতিরে সব যন্ত্রণা সহ্য করতাম। অনেক পরে জানতে পারি….. থাক সে কথা আর না বলি। অবশেষে শয়তানটার রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর আমি ওর হাত থেকে বাঁচলাম।

মাকে একদিন বলতে শুনেছি হারামজাদা মরছে ভালো হইছে। কিন্তু আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল আমার জীবনে। অসহায় মেয়েদের কত কত বার যে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়। তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।

সেদিনের পর আমি আর মিহিরদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। নিজেকে কুৎসিত জীব মনে হতে লাগলো। মনে হলো নিজের রূপ নিজেই পুড়িয়ে ছারখার করে দেই কিন্তু মিহির কষ্ট পাবে এই কথা ভেবে আমি পিছিয়ে এলাম। মা মনে হয় কিছু আঁচ করেছিলো সে হঠাৎ গলায় ফাঁস দিলো। মা কি আমার জন্য গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছে কিন্তু পরে বুঝলাম ঘটনা অন্য ছিল। আমার বাবার মৃত সৎ ভাইয়ের মোবাইলে আমার নানারকম ভিডিও চিত্র তার মৃত্যুর কারণ। লোকে তখন আমায় বলতে লাগলো হারামজাদি তোর মরণ হয় না কেন? মরতে পারিস না। মৃত্যু না এলে আমি কি করে মরবো? আমি আত্মহত্যা করার মত মেয়ে নই। এদিকে আমার সৎ বাবা আমার মৃত মায়ের চল্লিশার আগেই নতুন একটি কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুললো।

(২)
তমালদা আমায় খুব ভালোবাসার কথা বলতো, সুযোগ পেলেই ঘ্যান ঘ্যান। আমি সংগত কারণেই তাকে পাত্তা দিতাম না। এদিকে মিহির বাড়ি না যাওয়াতে মিহির আমার খোঁজে বাড়ি আসতে লাগলো। আমি ওকে লোক মারফত নানা বাহানায় ফিরিয়ে দিতে লাগলাম কিন্তু কত দিন? আমি আসলে মিহিরকে এই পাপ মুখ দেখাতে চাইছিলাম না। তাছাড়া আমার মা ছাড়া আমি এ বাড়িতে অবাঞ্ছিত। আমি আর পারছিলাম না। “মেয়ে মানুষের রূপ তার, সব চেয়ে বড় শত্রু” মা বলতো।

আমি এক ঝড় জলের রাতে তমালদার সাথে পালিয়ে গেলাম। তমালদা আমাকে কিছু দিন বিয়ের নামে ভোগদখল করে বর্ডার পার করে দিলো। যখন আমার জ্ঞান হলো আমি বুঝলাম আমার আর এ জনমে মুক্তি নেই আটকে গেছি বিশাল ফাঁদে কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা ছিল বুঝি অন্য। এরপর….

(৩)
নতুন ছবির প্রচারে জেলা শহরে এসেছি ছবিটির নায়ক, পরিচালক আর আমি। ইদানীং আমার ভীষণ জনপ্রিয়তা। গত কয়েকবছর টপ নায়িকার ইঁদুর দৌড়ে আমিই সেরা। এ জীবনে যত অবহেলা পেয়েছি তা যেন সব পুষিয়ে নেবার সময় এখন। এত ভালোবাসা কোথায় ছিল মানুষের? আসল নাকি সত্যি সে বিবেচনায়, না আনি। নগদ গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের পরিচয়। মাঝে মাঝে ভাবি আর হাসি।
গাড়ি তে চড়ার মুহুর্তে ছোটখাটো ভীড় ঠেলে সানগ্লাস পরা এক মধ্যবয়সী যুবক এলো তার মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি নাকি আমার ভীষণ ভক্ত। অটোগ্রাফ নিতে চায়।
আমি মেয়েটিকে বললাম
– কি নাম তোমার?
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল
– অঞ্জলি। আগে অবশ্য অন্য নাম ছিল।কিন্তু বাবা বদলে দিয়ে তোমার নামে নাম রেখেছে। তুমি কিন্তু বাবার ফেভারিট।
– বাহ!

আমি বাড়িয়ে ধরা খাতাটিতে অটোগ্রাফ দিলাম। দ্রুত ভীড় বাড়ছে খাতা ফেরত দিতে গিয়ে মধ্যবয়সী যুবকটির হাতে হাত স্পর্শ হতে বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার শরীরে। এত চেনা স্পর্শ! আমি সানগ্লাস পরা যুবকটির চোখে চোখ রাখতেই অবাক হলাম আরে এতো. …..আমি মিহিরকে চিনতে পারলাম মুহুর্তেই। এ ক’বছরে অনেক বদলে গেছে সে মোটাসোটা থলথলে ভুড়িতে তাকে চিনতে যে কারও কষ্ট হবে। আচ্ছা মিহির কি আমাকে চিনে?
ভীড় বাড়ছে ক্রমশ। আমার সেক্রেটারী নিরাপত্তার স্বার্থে আমাকে ঠেলে গাড়িতে তুলে দিলো।

ভীড়ের চাপে মিহির দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। বুকে আমার অন্য রকম ব্যথা। আমি ডাকতে চাইলাম কিন্তু লোক সমাগমে বাড়তেই জনঅরণ্যে আমি আরেকবার মিহিরকে হারিয়ে ফেললাম। মিহিরকে বলা হলো না শুধু তার কাছাকাছি আসার জন্য আমার এই সংগ্রাম। শত কলঙ্ক মান অপমান সয়ে আমার এই ফিরে আসা। মিহির আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।

– ম্যাডাম। ইউনিভার্স মাল্টিমিডিয়া থেকে কল করেছে। আগামীকাল ওরা ছবির চুক্তিটা করে নিতে চায়। সামনের মাসের প্রথম দিকে মহরত।
– সুজানা তুমি ওদের বলে দাও আমি আপাতত আর কোন ছবি করতে চাই না।
– কেন ম্যাম! এই ছবিটা আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হবে আমি শিওর। বড় প্রডাকশন, গল্প ভালো,টানটান চিত্রনাট্য। ব্যানারটাও তো ভালো।
– আমি আসলে একটু একা থাকতে চাই। তুমি একটা ভালো দেখে রিসোর্টের খোঁজ নাও। যেখানে কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না এমন জায়গা। এত লোকের ভীড় আমার আর ভালো লাগছে না।

“কত যে কথা ছিল
কত যে ছিল গান
কত যে বেদনার না বলা অভিমান।
তোমায় ভেবে ভেবে আকাশ হলো সারা।…….”
লতা মঙ্গেশকরের এই গানটি সম্ভবত আমার কথা ভেবে লেখা। আজকাল আর কাঁদতে পারি না। কান্না সব শুকিয়ে গেছে কবে যেন। মাঝে মাঝে বিধাতাকে বলতে ইচ্ছে হয়। প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছে হয় –
– কি ক্ষতি হতো আমাকে একটা সুস্থ সুন্দর জীবন দিলে? আমি তো এজীবন চাই নি। আমি চেয়েছি মিহির হাতে হাত রেখে লক্ষ কোটি দিন কাটাতে। মিহির ভালোবাসায় হারাতে। আর কিছু নয় ব্যস এটুকুই। এই চাওয়া কি খুব বেশি ছিল?

© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. ফয়জুল মহী : ৩০-০৭-২০২২ | ৮:৩৭ |

    সুন্দর লিখেছেন। আন্তরিক শুভ কামনা রইল।

    GD Star Rating
    loading...
    • ইসিয়াক : ৩০-০৭-২০২২ | ৮:৪২ |

      ধন্যবাদ মহী ভাই। 

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ৩০-০৭-২০২২ | ১০:৩৫ |

    যে কোন পাঠকের জন্য গল্পটিকে হালকা স্বরে নেয়াটা ঠিক হবে না। এখানে আমাদের যাপিত সমাজের মধ্যবিত্ত নারীর অবহেলিত ঘটনা প্রবাহ অসাধারণ ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শেষের সাকসেস সেটাকে সারপ্রাইজ হিসেবেই নিলাম। শুভেচ্ছা। Smile

    GD Star Rating
    loading...