আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

তেইশ
“হৌত লেখা কপালে আর মৌত লেখা পা’য়
যার যেখানে মৃত্যু আছে, পায়ে হেঁটে যায়

ধরো, এখুনি আমার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মিত্তু হল। আমি তো নিজিই পায়ে হেঁটে এয়েছিলাম তোমার বাড়ি। আসিনিকো?
এবার ধরো, প’ড়ে যেতে দেখে তুমি ছুট্টে এসে আমার মাথাটা কোলে তুলে নিলে। হাঁ করলাম, এট্টু জল দিলে গেলাস থেকেন। জলঢোঁক খেয়েই আমি চোখ মুদিছি। শেষ বেলায় এই কাজ কে করে, ছেলে তো? তাহলে তুমি আমার সন্তান হলে কি না!”

কারও কারও সঙ্গে আচমকা পরিচয় হয়, তারপর মাথা খুঁড়লেও জনমভ’র আর খোঁজ নেই। সেই গোবিন্দভক্ত ভিখারিবুড়িও তাকে কথাক’টা বলে অন্তর্ধান হয়ে গেছে।

একটু আগে ঘরের দেয়ালে নিজের ফুল-ফ্রেম ছায়া দেখে চমকে উঠেছিল নির্মল। যেন অতিকায় যম কাঁধে চেপে ব’সে এইসব বিনাশবার্তা লিখিয়ে নিচ্ছেন! মনে হয়েছিল, চাঁদের সর্বোচ্চ আয়ু উনত্রিশ, আর বাবা বাণীনাথের তৈরি তার নিজের জন্মপত্র বলছে, ‘নবতি বর্ষানী জীবতি’। সন্তানশোকে পুড়ে আঙরা হতে না চাইলে এখনই পালানো উচিত জীবনের দরজায় তালা ঝুলিয়ে।

তারপর ভিখারিমাসির কথা মনে প’ড়ে ভূমিকম্পের পর নিজেকে নিজের ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে বার করছিল সে। ক’বছর আগে হলেও নিরক্ষর জনতার এমন হাবিজাবি বিশ্বাসের ধারই ধারত না, হয়রান হয়ে যেত উপনিষদের পাতা ছানতে ছানতে। এই নাও বৃহদারণ্যক আর ছান্দোগ্য থেকে মায়াবাদের তারাকুচি — সুষুপ্তির অবস্থাই আত্মার স্বরূপ, ব্রহ্মাবস্থা। আত্মা যখন স্বধর্ম পায়, তখন জগৎ বর্তমান থাকে না। তাই আত্মা বা ব্রহ্মের কাছে মহাবিশ্বের কোনও অস্তিত্ব নেই। নাও কঠোপনিষদের শ্লোক : পুত্র ইত্যাদি প্রিয় মানুষও অনিত্য, অসার; না কোনও কিছু থেকে ব্রহ্ম উৎপন্ন হয়, না ব্রহ্ম থেকে তৈরি হয় কোনও বস্তু… নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ। এই মিথ্যে বিশ্বপ্রপঞ্চ মায়াশক্তির খেলা মাত্র।

কিন্তু কলোনিতে নীড়বাঁধা নির্মল, যার মনের একপিঠ থমথমে ভিটে হারানোর কষ্টে, আর একপিঠ কালকীখাবো-র তরাসে অস্থির, এক সময় আবিষ্কার করল, দর্শনের স্বতঃপ্রমাণ মীমাংসাগুলোয় তার সন্দেহ জাগছে। শংকরের ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যের ২।৩।১৬ নম্বর শ্লোকটা ধরা যাক : এক জন্মের কর্মের ফল যখন সেই জন্মে সম্পূর্ণ ভোগ করা যায় না, তখন পুনর্জন্মে ওই একই আত্মা উপস্থিত থাকবে।

কর্মফল আছে এবং কর্মীকে ফল ভোগ করতেই হয় — এমন বিশ্বাস এই শ্লোকের পূর্বগামী; শঙ্করাচার্যের মতে ব্যাপারটা নীতি আর যুক্তিসম্মতও। হয়ত তিনি কোনও অত্যাচারী রাজাকে ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে জীবন কাটাতে দেখে ভেবেছেন ব্যাটা এ-জন্মে পার পেয়ে গেলি, কিন্তু এক মাঘে শীত যায় না; পরের বার ভগবান ঠিক মজা বুঝিয়ে ছাড়বে। এভাবে কর্মবাদের মোমবাতির মাথায় জ্ব’লে উঠেছে জন্মান্তরবাদের আলেয়া।

কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, জীবন নীতিবুদ্ধি মেনে চলবে, আবার চলবেও না। বাস্তবতার এলাকা আসলে ক্ষমতাঘেঁষা, সুবিধেনির্ভর। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রের মতো কাজ আর কাজের ফলের মধ্যে কান টানলে মাথা আসার মতো কোনও শারীরিক আত্মীয়তা নেই। তাই দার্শনিক চারপাশের বাস্তবকে তার পছন্দসই ধারণার সঙ্গে মেলাতে চাইলে রূপকথারই জন্ম হবে শুধু।

চব্বিশ
হারিকেনের আলো কেরোসিন ফুরিয়ে দপদপ করছে, সেটি নিভিয়ে রাত দুটোর গ্রামীন অন্ধকারে পদ্মাসনে শিরদাঁড়া সোজা ক’রে বসে থাকল নির্মল। ঘর জুড়ে চাঁদ-সঞ্জু-বাসুর নিদ্রিত আ-নাভি নিঃশ্বাসের ঝড় বইছে। নির্মলের ঘুম এখনও কোন দূর কাওরাপাড়া দিয়ে আসছে-যাচ্ছে কে জানে!

বিছানায় ব’সে সে ভাবছিল বরুণের কথা। বনমালীপুর প্রিয়নাথ ইনস্টিটিউশানের ইতিহাস টিচার, গোটা বারাসাতে টুকাইদা-ডাকে বিখ্যাত বরুণ মিত্র ছিল সিপিআই পার্টির সদস্য। তারপর দলে রাশিয়া-লাইন আর চায়না-লাইনের ঝামেলা বাড়তে বাড়তে গত বছর জুলাইয়ে ডাঙ্গে-বিরোধী চিনপন্থী নেতারা তেনালি কনভেনশান ডেকে দেয়। মাস তিনেক হল, কলকাতার ত্যাগরাজ হলে মিটিং ক’রে নতুন দলের নাম ঘোষণা হয়েছে — কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সসিস্ট)। আর সঙ্গে সঙ্গে সিপিআইএম নেতাকর্মীদের একধারসে ধরছে-পাকড়াচ্ছে পুলিশ। এখন সেভেনের ক্লাসটিচারের পিরিয়ডটা বেশির ভাগ দিন অন্য কেউ নেয়, মাঝেমাঝে টুকাই কলোনিমোড়ের বাড়ি থেকেও বেপাত্তা, কিন্তু যেদিন স্কুলে এসেছে, টিচার্স রুম জমিয়ে রেখে দেবে। গতকাল যেমন তার সঙ্গে ভারতীয় ধর্মনীতি নিয়ে তর্ক বাধাল। নির্মলের সংশয় বরুণের অনেক সমালোচনাকেই ধ্বনিভোটে জিতিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পণ্ডিতমশাই হিসেবে হিন্দুধর্ম তারই দুর্গ, যাকে বাঁচানোর দায়িত্বও তার। নিজের কালাপাহাড়ি ভাবনাগুলো সে ভুলেও লোকনজরে আনে না।

বরুণ বলছিল, ধর্মের হিসেবে যা স্বর্গলোক,
সেটা ধরাছোঁয়ার জিনিস নয়। কিন্তু গরীব মানুষ জেগে উঠলে এই ধরাতলেই স্বর্গ বানিয়ে নেবে। নচিকেতার কথা আছে না, দিব্যলোকে কোনও ভয় নেই, যম নেই, জরাও না; খিদে-তেষ্টা পার ক’রে শুধু শোকাতীত আনন্দের অনুভব? তাহলে দেবপুরী একটা উন্নত মর্ত্যই তো; সব পেটে ভাতের ব্যবস্থা, সবার জন্যে শিক্ষা আর চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারলে দেখবে স্বর্গ আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে।

স্কুলবাড়ির মাথায় দুধ-মরিচ রঙ শঙখচিলের ডানাবিস্তার দেখছিল নির্মল : শস্যমিব মর্ত্যঃ পচ্যতে শস্যমিবাজায়তে পুনঃ। মরঃ শব্দটা থেকেই মর্ত্য এসেছে। এই দীনদুনিয়ায় পা রাখলে শস্যের মতো পচে মরতে হবে, পরক্ষণে জন্মাতেও হবে, আবার মরো… জীবনমৃত্যুর এই ক্রমচক্কর দুঃখময় এবং কোনও মানুষই দুঃখিত হতে চায় না। তাই উপনিষদের উপদেশ : পুনর্জন্ম এড়াতে নরলোকে কামনাবাসনা চেপেচুপে ব্রহ্মের সাধনা ক’রে যাও, আর জন্ম নিতে হবে না — গ্যারান্টি; তোমার জীবাত্মা মিশে যাবে পরমাত্মা মানে পরব্রহ্মে; স্বর্গে গিয়ে ভোগ করবে কাম্য যা কিছু, অমরতা, পার্মানেন্ট পুলক।

বাচ্চাদের আমরা খানিকটা এরকম কথাই বলি না? এখন বেশি খেলো না, সিনেমা দেখো না, পড়াশুনো ক’রে চাকরি পাও, তারপর নিজের উপার্জনে যতখুশি আনন্দ ক’রো, কেউ মানা করবে না। চাকরি পাওয়া একটা ছোট স্বর্গ। আবার যে রিটায়ার করেছে, তার কাছে ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানো আর মেয়ের বিয়ে হল অমরাবতীর দুই সিঁড়ি। পৃথিবীতেই আমাদের টুকরো টুকরো ব্যক্তিগত স্বর্গবাস চলতে থাকে। নিজ-মালিকানার দিব্যলোকটাকে সামাজিক স্বর্গের চেহারা দিতে চাইছে বরুণদের মার্ক্সবাদ।

— কিন্তু ঈশ্বরের স্বর্গে তো বুড়ো বয়েস, যমের দক্ষিণ দুয়োর এসব কিচ্ছু নেই; শর্ত পুরোবে কী ক’রে?

— সাইন্টিস্টরা চেষ্টা করছেন। পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর চিকিৎসাবিজ্ঞান কীভাবে এগিয়ে গেছে দেখেছ? বুকে পেসমেকার বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিডনি খারাপ হলেও ডায়ালিসিস নিয়ে বেঁচে থাকছে রোগি।
— বিজ্ঞান মানুষকে অমরত্ব দেবে? অ্যালকেমি সত্যি হবে বলতে চাও!

এবার নির্মলের অনাস্থায় ভেজাল নেই।
— তোমার জ্যোতিষবিদ্যে যদি ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে, অ্যালকেমিও সবাইকে এলিক্সার অফ লাইফ রেঁধে খাওয়াবে একদিন।

.
(আরও আছে)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩০-০৩-২০২৩ | ১০:২৩ |

    বরাবরই এই ধারাবাহিকের প্রতিটি পর্বের মতো মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম প্রিয় কবি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...