প্রিয়বরেষু।
তোমার পছন্দ আছে, স্বীকার করলাম আরেকবার। তবে অবাক হতে হয়, একদম আধুনিক কালের মেয়ে হয়ে রবীন্দ্রনাথ তোমায় পেলো কিভাবে। তাও আবার একটা দুটো উপন্যাস নয় একেবারে তাঁর সারাজীবনের গদ্য ঘটনার সৃষ্টি ধরেই টান দিয়েছো। ভদ্রলোক বেঁচে থাকলে নিশ্চয় অক্কা পেতেন। যদ্দুর জানি স্যাটেলাইটের যুগে ওসব নাকি আর চলেনা। ঘরেবাইরে সব কিছুতেই হাল্কা এবং সস্তা সস্তা ভাব। গভীরে মানুষের যত ভয়। যদি দৈনন্দিন সস্তা ভেবে যা-কিছু নিই পাছে ভারী হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ আমার পছন্দের, তবে প্রিয় নন। তাঁর লেখা তাঁর হাতের লেখার মতোই বড্ডো জটিল। কি জানো…
রাজানুগ্রহ বা জনানুগ্রহ ছাড়া কবি বা শিল্পীরা সাধারণত সমাজে অচল; অনুগ্রহ কথাটা এই জন্য বলছি যে কবির কাব্য বা শিল্পীর কলাসামগ্রী মানুষের ‘কাজে’ লাগেনা-কাজের বাহিরে ‘কাজ’ ভোলাবার মন্ত্র’ কবিরা শোনায় বলে কেজো-লোকের দল কবি ও শিল্পীকে সমাজে অচল করতে চান। তাই একদিন কবির দুর্নাম হলো- তার দুর্গতি হলো ‘কবির দলে’। চিত্রকর জাত খোয়াল-পটুয়া মালকে বলা হলো ‘চিত্রকর’, পোটো নটরাজকে পূজা করে, কিন্তু তার পূজারী নটকে বাস করতে দিলাম গাঁয়ের বাইরে, ‘নট-নটী’ শব্দ পর্যন্ত সমাজে মান হারালো। কেজো লোকের বা বুদ্ধিমানের সমাজে কবি হলেন অবাঞ্ছনীয়- কবির কথা উপহাসের বিষয় হলো- যা কিছু অবাস্তব, যা কিছু অবান্তর তার স্রষ্ঠা হলেন কবিরা, সুতরাং তাঁদের কাব্য ‘কাব্যি’ বলে হলো অগ্রাহ্য, তাঁদের বাণী ‘দুর্বোধ্য’ বলে হলো অপাঙ্ক্তেয়।
অবশ্যি রবীন্দ্রনাথ কবি বলে- তাঁর কাব্যও একদিন লোকের কাছে ‘কাব্যি’ বলে অনাদৃত হয়েছিল এবং তাঁর বাণী ‘দুর্বোধ্য’ বলে অশ্রুত হয়েছিল! কিন্ত অবজ্ঞার দ্বারা সত্য মিথ্যা হয় না এবং প্রশ্রয়ের পাতিত্ব দিয়ে মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের বাণীর মধ্যে চিরন্তন সত্য নিহিত আছে বলেই লোকে তা গ্রহন করে; আজ যা ’দুর্বোধ্য’, তা একদিন হয় সহজবোধ্য।
যাইহোক, তবু কোন কালেই আমার বেলায় রবীন্দ্রনাথ বাবু সদয় হতে পারেননি। তাঁর লেখার একলাইন পড়ে ভেবে নিতে হয়েছে আসলে উনি কি বলে বোঝাতে চাইছেন। মাথা কাজ না করলে বই উল্টে অন্য কোথায়। আজ বহুদিন পর অমন একটা ঢাউস বই কোলের পরে রেখে খুঁজে দেখছি, আদৌ কোনটা মন দিয়ে পড়েছি কিনা। ধন্যবাদ ম্যাডাম, সুন্দর একটা সুযোগ করে দেয়ার জন্য। তবে কেন জানি মনে হচেছ, আরো আগে হলে ভালো হতো নাকি। রাবিন্দ্রীক ষ্টাইলটা মননে মগজে আস্ত বেঁধে নিতে পারতাম।
মনে পড়ে, আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিড়ি-ছাঁদে গায়ে গন্ধে মফস্বলের অতি সরল সাদা আধামেধাবী আবাসিক ছাত্র। অধ্যায়ন সুবাদে গুটিকয়েক ক্লাস ছাড়া বাকী সময় ছিল অখন্ড অবসর। কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে নিরবে নির্বিঘ্নে ভর করলো রবীন্দ্র। রবী সংগীত, রবী সংস্কৃতি, রবী ভাবনা সবকিছুই আপাদমস্তকে যেন লেপ্টালেপ্টি। ভাবে-স্বভাবে রবী, লেখার মাধ্যমও বাদ গেলনা। এলুম, খেলুম, যাইতাম, আসিতাম।
সুদুর বিলেতে আইন শিখতে যাওয়া পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে উর্বর পশ্চিমবঙ্গীয় প্রিন্স শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরোমাত্রায় তখন আমার ভেতর। লেখা ঝোঁকার ওপর বেশ প্রভাব তখন ঘনঘন দ্যাখা যেতে লাগলো। অপরিচিতাকে চিনে নেবার যেন ব্যাকুল প্রত্যাশা। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। যৌবন। বয়সটাই বুঝি তখন ছিল অমন। ফলে কি হলো আজ নাইবা বললাম। ব্ল্যাকআউট। এরপর ঘটনা গুলোন টিভিতে নিত্যদিন বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক শুরু হবার আগে পূর্বের ঘটনার ‘রিক্যাপ’ যেমন দেখানো হয় তেমনটা। খুব দ্রুত। গার্লস কলেজের সদর দরজা, পার্ক কিংবা সংসদ ভবনের এলোমেলো চত্বর, নাটক পাড়ায় নৈমিত্বিক যাতায়াত, আবৃত্তিকারদের মত অনুশীলন করে কন্ঠ পালিশ করা। তারপরও যখন কেউ কথা দিলনা, সহসা হয়ে উঠলাম বিপ্লবী ছাত্রনেতা। কলেজ সংসদের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক।
বাম ঘেঁষা পাতি নেতা। নিরীহ কর্মী সংগ্রহ থেকে রাজপথের মিলিত তপ্ত শ্লোগান। এখানে সেখানে গনসংগীতের কোরাস। গাছের ডালে বসে যেন, নিজের করাতে নিজের ডালই কাটা। অতিধীরে, তবু ধীরে পরিচছন্ন বাস্তবতা। রবীন্দ্র উধাও। রবীন্দ্র বিদায়। রবীন্দ্র গুডবাই।
সেই একদা চেনা রবীঠাকুর আজ আবার জুড়ে বসেছে আমার চারিপাশ। এলো আবার তোমার হাত হয়ে।
তবু আজ তোমারি স্বরে বলি-
“একি রহস্য, একি আনন্দরাশি ! জেনেছি তাহারে, পাই নি তবুও পেয়ে।
তবু সে সহজে প্রাণে উঠে নিঃশ্বাসি, তবু সে সরল যেন রে সরল হাসি
পুরানো সে যেন এই ধরণীর চেয়ে।”
মহাভারতে একটা চরিত্র আছে, ধৃতরাষ্ট্র। আর তার স্ত্রী গান্ধারী। ধৃতরাষ্ট্র ছিল অন্ধ। সেজন্য তার স্ত্রীও অন্ধ সেজে থাকত চোখে রুমাল বেঁধে। কারণ, প্রেমিক স্বামী যা দেখেনা, আমিও তা দেখব না, এই ছিল গান্ধারীর প্রতিজ্ঞা।
তুমি কি তাই !!!
loading...
loading...
কোন মন্তব্য নেই