৩০ বছরের সৌদি আরব

রবার্ট লেসির ইনসাইড দ্য কিংডম: কিংস, ক্লারিক্স, মডার্নিস্ট, টেররিস্ট অ্যান্ড দ্য স্ট্রাগল ফর সৌদি অ্যারাবিয়া বইটির এই আলোচনাটি দ্য ইকোনোমিস্ট-এর ১০ অক্টোবর ২০০৯ সংখ্যা থেকে অনূদিত হলো…

haj

দ্য কিংডম, সৌদি আরব নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম বই প্রকাশের ২৫ বছর পর রবার্ট লেসি বইটির দ্বিতীয় পর্ব লেখার জন্য আবার গিয়েছিলেন সেখানে। তিনি এবার তিন বছর সেখানে ছিলেন এবং কোনো ধরনের অতিরঞ্জন ছাড়াই বলা যায়, রাজপুরুষ থেকে অতিসাধারণ, ব্লগার থেকে ব্যবসায়ী—প্রায় সব শ্রেণীর সব ধরনের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। এবারের বইটি আগেরটি থেকে অনেক গোছানো, সমৃদ্ধ সুবিবেচনা প্রসূত ও জমজমাট।

বিগত ৩০ বছরের সৌদি আরব তাঁর এবারের বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য। অর্থাৎ গতবার যেখানে শেষ করেছিলেন এবার শুরু করেছেন ঠিক সেখান থেকেই। এই সময়ের মধ্যে সৌদি আরবকে বেশ কিছু সমস্যার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও এর ফলাফল মোকাবিলা করতে হয়েছে। যার প্রথমটি হলো ১৯৭৯-এর বিপর্যয়। প্রতিবেশী দেশ ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জুহায়মান নামক এক জঙ্গি নেতার নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র লোক মক্কার কাবা ঘর অবরুদ্ধ করে এবং মুসলিম ত্রাতার আগমন বার্তা ঘোষণা করে। সেইসঙ্গে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিপর্যয় সারা বিশ্বেই মুসলিম জঙ্গিবাদের অপ্রতিরোধ্য উত্থান ত্বরান্বিত করে।

Saudi-Arabia-Military

আশির দশক ছিল বিপর্যয়ের দশক। এরপর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নেয়। ১৯৯০ সালের গ্রীষ্মে ইরাকের কুয়েত আক্রমণের পর সৌদিরাজ ফাহাদ বাধ্য হন পাঁচ লাখ পরধর্মী সেনাকে (বেশির ভাগই মার্কিন) আরব ভূমিতে আমন্ত্রণ জানাতে। এটা শুধু ওসামা বিন লাদেনের ভেতরেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি বরং এই বিরূপতা সমগ্র পবিত্র আরব ভূমিতে পঙ্গপালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সৌদি ইসলামপন্থীরা এটাকে বিবেচনা করে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার অংশ হিসেবে। এই ঘটনা সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ও তীব্র জিগীষার সৃষ্টি করে। এরই ফলাফল লাদেন ও তাঁর বাহিনীর উত্থান যার ভয়ংকরতম পরিণতি হচ্ছে ৯/১১।
আর কোনো বইয়েই সৌদি আরবের সঙ্গে জঙ্গিবাদ ও আল-কায়েদার এই পারস্পরিক যোগসূত্রটুকু এত বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়নি। বস্তুত তিনি মনে করেন সৌদি যোগসাজশ ছাড়া ৯/১১-এর ঘটনা ঘটা একেবারেই অসম্ভব।

এসব বিষয় নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। অন্যদের সঙ্গে জনাব লেসির পার্থক্য হচ্ছে তিনি এখানে সৌদি আরবের মানুষের প্রত্যক্ষ জবান ব্যবহার করেছেন, তাদের অন্তর্মুখীনতা ও স্বভাবসুলভ গুটিয়ে থাকা মনোবৃত্তি সত্ত্বেও। ব্যবচ্ছেদ করেছেন তাদের স্বভাবের গভীরে প্রোথিত অসহিষ্ণুতাকে। তারা বর্ণনা করেছেন মহানবী টেলিভিশন (শয়তানের কারখানা), ফুটবল (খেলোয়াড়রা হাফপ্যান্ট পরলে সেটা অবৈধ) কিংবা ব্যাংক নোটের (যেহেতু সেখানে বাদশাহ এর ছবি আছে তাই পুত্তলিকতাদুষ্ট) অনুমোদন দিয়েছেন কিনা সে ব্যাপারে জুহায়মান ও তার অনুসারিরা (এক অর্থে যাদের আল-কায়েদার পূর্বসূরি বলা যায়) কীভাবে দীর্ঘ বাহাসে লিপ্ত হতো। মনসুর আল নোগাইদান, একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা, তাঁর জবানিতে জানা যায়, ছোটবেলায় কীভাবে তাঁকে একটি ভিডিওর দোকানে আগুন ধরিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছিল; কীভাবে তাঁর বন্ধুদের নাজেহাল হতে হয়েছিল সাবলীলভাবে কোরআন না পড়তে পারার কারণে।

জনাব লেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা ও কলামিস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন। রাষ্ট্রীয় গোপন পুলিশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সরঙ্গ সম্পৃক্ত থাকার অহেতুক সন্দেহে যাকে তিন মাস সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। একটি চাঞ্চল্যকর তথ্যও দিয়েছেন লেসি। দেশান্তরে নির্বাসিত সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ের (যাদের বিধর্মী এবং ইরানের চর হিসেবে অপদস্থ করা হয়) নিজ ভূমিতে ফেরার জন্য বাদশাহ ফাহাদের সঙ্গে দরকষাকষির দীর্ঘ ইতিহাস তিনি উন্মোচন করেছেন সাবলীলভাবে। নারী-পুরুষের অসাম্য ও পরস্পর বিরোধিতাকে তিনি সৌদি সমাজের মূল দ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করেছেন। সৌদি নারীদের অসহায়ত্ব ও একাকীত্বের ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন সৌদি পুরুষদের উদাসীনতা ও খামখেয়ালি মনোভাবের কারণে অনেক নারী সমলৈঙ্গিক সঙ্গপ্রিয়তা এমনকি সমকামে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

05.-Saudi-women-drive
ইনসাইড দ্য কিংডম বইটিতে লেখক বর্তমান শাসক বাদশাহ আব্দুল্লাহর ঘরোয়া ও সাধারণ জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁর মধ্যে আমরা বাগানবাড়িতে নাতিদের সঙ্গে সাঁতার কেটে কিংবা ঘোড়ার গায়ে হাত বুলিয়ে সময় কাটানো একজন সাধারণ আরবের প্রতিকৃতি দেখতে পাই। সেই সঙ্গে তাঁকে সংস্কারপন্থীও মনে হয়েছে, যিনি কিনা শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে সত্যিকারের পরিবর্তন চান; চান ওয়াহাবিবাদের অনমনীয় সুতোগুলোকে আরেকটু আলগা করে দিতে। বাদশাহ আব্দুল্লাহর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও তিনি জানিয়েছেন এসব কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করা একজন অশীতিপর ব্যক্তির জন্য মুশকিলই বটে। সেইসঙ্গে অবশ্য আমাদের এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, সত্যিকারের সদিচ্ছাই পারে যেকোনো ধরনের প্রতিকূলতা দূর করতে।

চিন্তাকর্ষক এ বইটিতে একটি বড় ধরনের অসম্পূর্ণতা রয়েছে। বুঝদার একজন লোক হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে তাঁকে অতটা পরিপক্ক কিংবা সুবিবেচক মনে হয়নি। তিনি শুধু চরমপন্থীদের সঙ্গে সৌদি রাজবংশের দ্বন্দ্বের একরৈখিক গ্রাফই আঁকতে পেরেছেন। শুধু আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের মোকাবিলাতেই নয়, নিজেদের তখ্ত নিরাপদ রাখার জন্যও সৌদি রাজবংশ ধর্মকে কতভাবে ব্যবহার করেছে সেই জটিল সমীকরণ তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
দিন এবং রাতকে কিভাবে বিভেদ করেছে।

soudi.jpg
alfaisaliah1

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

কোন মন্তব্য নেই

মন্তব্য বন্ধ আছে।