বেইজিং গিয়ে বলা বাহুল্য চীনের প্রাচীরে গিয়েছি। সিঁড়ি বেয়ে উঠেছি ওপরে, দিগন্তে তাকিয়ে দেখেছি মাইলের পর মাইল বিখ্যাত সেই গ্রেট ওয়াল; মানুষের তৈরি পৃথিবীর একমাত্র স্থাপত্য যা নাকি মহাশূন্য থেকে দেখা যায়। পাহাড়ের গায়ে রেখার মতো মিলিয়ে যাওয়া দেয়ালটি দেখে ভাবছিলাম হাজার মানুষের, শত বছরের এই শ্রমের পেছনে মূল ভাবনা হচ্ছে নিরাপত্তা, সিকিউরিটি। সম্রাট তাঁর রাজ্যকে শত্রু থেকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছেন।
আজকের রাষ্ট্রপ্রধানেরা নিজেদের নিরাপদ করতে অস্ত্রভান্ডারে অস্ত্র মজুদ করেন, পরমাণু বোমা বানান। আর সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপদ রাখতে ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ায়, বাড়ি বানায়, জমি কেনে। একটা নিরাপদ ঘেরের মধ্যে নিজেদের সুস্থির মতো বসাতে প্রাণাতিপাত করে মানুষ। এই সেন্স অব সিকিউরিটি প্রায় প্রবৃত্তির মতো তাড়িত করে মানুষকে।
কিন্তু সবাইকে নয়। জগতে এমন মানুষও আছেন, যাঁরা তাঁদের চারপাশে নিরাপত্তার ওই প্রাচীর বানানোর কোনো তাগিদ বোধ করেন না। অরক্ষিত হয়ে ঘুরে বেড়ান। ট্রাম এসে চাপা দেয় তাঁদের। যেমন দিয়েছিল জীবনানন্দ দাশকে। প্রথম আলোতে সম্প্রতি প্রকাশিত জীবনানন্দের ঘনিষ্ঠজন ভূমেন্দ্র গুহের সাক্ষাৎকার পড়তে গিয়ে চীনের প্রাচীরে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা নিয়ে আমার ভাবনাটি মনে পড়ছিল। মৃত্যুর পর তাঁর শব দেখার জন্য যখন বুদ্ধদেব, অচিন্ত্য, সজনীকান্তসহ সব বিখ্যাত লেখকেরা এসেছেন, দেখে অবাক হয়েছেন তাঁর স্ত্রী।
ভুমেন্দ্রকে বলছেন−’তাহলে কি তোমার দাদা বড় লেখক ছিলেন?’ তারপর বললেন−’তোমার দাদা বাংলা সাহিত্যকে নিশ্চয় অনেক দানও করে গেলেন। কিন্তু আমার জন্য কী রেখে গেলেন বলো তো?’ মোক্ষম প্রশ্ন।
একজন স্ত্রীর পক্ষে এক’শ দশ ভাগ জরুরী প্রশ্ন। স্বামী-স্ত্রীর ভাবনার যদি অসেতুসম্ভব দুরত্ব থাকে তাহলে তো বটেই, দুরত্ব না থাকলেও এ প্রশ্ন খারিজ হয় না। সংসারকে নিরাপদ করার জন্য কী রেখে গেছেন জীবনানন্দ? ব্যাংকে টাকা, বাড়ি অথবা এক টুকরো জমি? কিচ্ছু না।
রেখে গেছেন কী সব ধুসর পান্ডুলিপি। ও দিয়ে আধা কেজি আলুও পাওয়া যাবে না। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে নয়, তাঁর মন ঘুরে বেড়িয়েছে অশোকের, বিম্বিসার জগতে। সারা কলকাতা হেঁটে বেড়িয়েছেন তিনি, প্রায়শই একা। প্রায় সারা রাত হেঁটে রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাসায় ফিরেছেন। আলুর দাম থেকে মনকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া, কিংবা বলা যায় অন্যমনস্ক হওয়াই যার পেশাগত কাজ, তাঁকে নিয়ে সংসারের বিপদ, নিজের বিপদ, আশপাশের মানুষের বিপদ। এ ধরনের মানুষের পক্ষে সংসার করতে যাওয়াই এক বিপদ। তবু তাঁরা করেন। হয়তো সামাজিকতার চাপে কিংবা হয়তো খানিকটা লোভে পড়েও। তারপর পরিবার-বন্ধুজনের সাঁড়াশির নিচে পড়েন। তখন হয়তো কিছু বলার থাকে না তাঁর।
রাতে হয়তো চুপি চুপি আলো জ্বালিয়ে লেখেন−’মেয়েটির প্রাণ একটি একাকী কুকুরের মত যেন, শুকনো পাতার পেছনে ছোটে, প্রজাপতি দেখে ঘেউ ঘেউ করে, আকাশের নিস্তব্ধ চাঁদ দেখে বিড়ম্বিত হয়ে ফেরে।…মানুষের আশা, প্রেম, ঘৃণা, মৃত্যুর জগৎ তৈরী হচ্ছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে কিন্তু তার জীবনে কোন নির্দেশ নেই।’
জীবনে কার কী নির্দেশ আছে, এ নিয়ে রাতে বসে যতই তিনি ভাবুন না কেন, সকালে উঠে ঠিকই তাঁকে আলু কিনতে যেতে হয়। কবিতা, গল্প লেখা−বাউলরা যেমন বলেছেন, একধরনের বাতাসে গেরো দেওয়ার মতো কাজ, তার চেয়ে আলু কেনা কম কঠিন কাজ নয়। তার ওপর এ তো চালু কথা যে সংসার আলুতে চলে, কবিতায় নয়।
যাঁরা চৌকস তাঁরা আলু এবং কবিতা দুটোরই ব্যবস্থা করতে পারেন। জীবনানন্দ এই দুয়ের ফেরে পড়ে সারা রাত পথে পথে হেঁটেছেন। সবার মন যখন বাজারে, বোনাসে; তাঁর মন তখন অন্যখানে, হয়তো শালিখের হলুদ ঠ্যাংয়ের দিকে। এ ধরনের অন্যমনস্ক মানুষ না সংসারকে নিরাপদ করতে পারেন, না নিজেকে।
একবার মংপুতে রবীন্দ্রনাথ খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন ইজিচেয়ারে, তাঁর ঘাড় বেয়ে একটা বিষাক্ত পোকা উঠছে। দুর থেকে দেখে মৈত্রেয়ী দেবী ছুটে এসে ফেলে দিলেন পোকাটাকে। বললেন−’এত অন্যমনস্ক থাকেন কী করে?’ আমাদের স্মরণ রাখা ভালো, রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বলেছিলেন−’আমার যা কিছু হয়েছে তা ঐ অন্যমনস্কতাটুকুর জন্যই।’
জীবনানন্দের রূপসী বাংলার কবিতাগুলো যখন পড়ি, যার নাম তিনি নিজে দিয়েছিলেন ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’, তখন মনে হয় তিনি যেন একটা অতিকায় প্রাচীরই তৈরি করতে বসেছিলেন, চীনের প্রাচীরের মতোই।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি যখন তিনি নগরায়ণকে ধেয়ে আসতে দেখছিলেন, তখন সেই প্রবল দানবের হাত থেকে এই নীলিমাকে, যা ভূমেন্দ্র বলছেন−তখন ভীত, ত্রস্ত হয়ে কাঁপছে, তাকে বাঁচাতে গিয়ে অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে বানাতে বসলেন একটা কবিতার প্রাচীর। নিজের নয়, সংসারের নয়, একটা বিধ্বস্ত নীলিমার নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘুমাতে পারলেন না তিনি।
কোনো উপযোগিতা নেই আজ, তবু লাখ লাখ মানুষ যেমন পৃথিবীর পিঠের ওপর সস্থির একটি রেখার মতো দাঁড়িয়ে থাকা আশ্চর্য চীনের প্রাচীর দেখতে যায়, তেমনি বহু শতাব্দী পর যখন এই বাংলার আকাশে আর কোনো শিমুল তুলো ওড়াউড়ি করবে না, অশ্বত্থের পাতার ফাঁকে আর কোনো পেঁচা বসে থাকবে না, খড়ের গাদার ওপর জমে থাকবে না ভোরের শিশির, তখন মানুষ খুলে বসবে এই অন্যমনস্ক কবির ‘রূপসী বাংলা’, অক্ষরে বন্দী করে রাখা এই আশ্চর্য জনপদের অনুপুঙ্খ ছবি দেখে বিষ্মিত হয়ে থাকবে তারা।
তথ্যঋণঃ শাহাদুজ্জামান। কথাসাহিত্যিক। শিক্ষক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
পদ্মা পাড়ের মানুষ থেকে শেয়ার করা হলো।
loading...
loading...
কোন মন্তব্য নেই