যুবক রবি অন্য রবি ছিন্নপত্রে ২য় পর্ব ... আলতাফ হোসেন


যুবক রবি অন্য রবি ছিন্নপত্রে ১ম পর্বের পর… ১৮৯১-এর জানুয়ারি মাসে যুবক রবি একদিন তাকিয়েছিলেন নদীর জলের ব্যস্তসমস্ত গোটাকতক পাতিহাঁসের দিকে…

“তারা ভারি কলরব করছে এবং ক্রমাগতই উৎসাহ সহকারে জলের মধ্যে মাথা ডুবোচ্ছে এবং তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে নিয়ে সবলে ঝাড়া দিচ্ছে। ঠিক মনে হচ্ছে যেন তারা জলের নিচেকার নিগূঢ় রহস্য আবিষ্কার করবার জন্য প্রতিক্ষণেই গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং তারপর সবেগে মাথা নেড়ে বলছে, ‘কিচ্ছুই না। কিচ্ছুই না।”

পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে না থেকে উপায় থাকে না। কোনো সন্ধানেই কোনো কিছুই যে পাওয়া যায় না কত প্রাজ্ঞ লোকই না বলে এসেছেন শত শত বছর ধরে সে কথা রবীন্দ্রনাথও কী চমৎকারভাবে একটি ছবি তৈরি করে বলে দিলেন, যা আবার মিলে গেল প্রিয় ফরাসি ঔপন্যাসিক আঁরি বারবুসের ‘দেয়ার ইজ নো ওয়ে আউট অর রাউন্ড অর থ্রু’-র সঙ্গেও, তা উপলব্ধি করে একরকম আশ্বস্ত বোধ করা যায়। প্রায়শই একরকম প্রত্যাশা যে মনে জাগে তা যেন পূরণ হয়।

ওই যে পড়াশোনার প্রসঙ্গ তোলা হয়েছিল, সে ব্যাপারে অনার্স ক্লাসের ছাত্রের মতো একটি প্রমাণ বা সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে চাই। বিবি তথা ইন্দিরাকে লিখছেন রবিকা:

“মানুষের আয়োজনের শেষ নেই।। তাকে যে কত রকমের কত-কী হাতে রাখতে হয় তার ঠিক নেই। সেই জন্য আমার সঙ্গে নেপালীজ বৌদ্ধিস্টিক লিটেরেচার থেকে আরম্ভ করে শেক্সপিয়ার পর্যন্ত কত রকমেরই বই রাখতে হয় তার ঠিকানা নেই।”

অন্য যা কারণ তার কথাও বলা হয়েছে: প্রকৃতি, প্রকৃতি এবং প্রকৃতি। প্রকৃতি থেকেও মানুষ তার জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পেতে পারে বলে পণ্ডিতেরাই বলেন। সারা ছিন্নপত্র- ছিন্নপত্রাবলী জুড়ে রয়েছে প্রকৃতিবর্ণনা। প্রশান্ত এক আবহ রচিত হয়েছে সেখানে। আর রয়েছে এমন গভীর উপলব্ধির কথা:

“আমার বোধ হয় কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে এলেই মানুষের নিজের স্থায়িত্ব এবং মহত্বের ওপর বিশ্বাস হ্রাস হয়ে আসে। এখানে মানুষ কম এবং পৃথিবীটাই বেশি। চারিদিকে এমন সব জিনিস দেখা যায় যা আজ তৈরি করে কাল মেরামত করে পরশু দিন বিক্রি করে ফেলবার নয়, যা মানুষের জন্ম-মৃত্যু ক্রিয়াকলাপের মধ্যে চিরদিন অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিদিন সমানভাবে যাতায়াত করছে এবং চিরকাল অবিশ্রান্তভাবে প্রবাহিত হচ্ছে।”

চিরকালের এই অবিশ্রান্ত প্রবাহের অনুষঙ্গে এসে পড়ে হেরমান হেস-এর ‘সিদ্ধার্থ’ পড়ার স্মৃতি। কৈশোর যৌবনের সন্ধিক্ষণে আমরা কেউ কেউ বইটি পড়তে গিয়ে কাঁপতে-কাঁপতে ভেবেছি জীবনের একটা অর্থ বুঝি এবার পাওয়া যাবে। অনেক চেষ্টা, অনেক ভ্রমণের পর সিদ্ধার্থ যখন গৌতমের দেখা পেল তখন কিছু প্রশ্ন করল তাঁকে। কিন্তু উত্তর তাকে সন্তুষ্ট করল না। কী ভাবে করবে? গৌতমের নিজেরও তো জানা ছিল যে, উত্তর নেই। বলেছিলেন তিনি: তোমার পথ তোমার নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। তখন সিদ্ধার্থ গেল কমলা নামের নৃত্যগীত ও চৌষট্টিকলায় পারদর্শিনী এক রূপোপজীবিনীর কাছে। কমলা এতটাই সহৃদয়া যে কেবল তাকে নিয়ে লেখা কবিতার বিনিময়ে সে সিদ্ধার্থকে দান করল তার শরীর ও মন। ভালোবাসার বন্ধনে জড়ালো তাকে। কিন্তু তাতে চিত্ত ভরল না সিদ্ধার্থের। একদিন বিদায় নিয়ে পথ চলতে-চলতে সে পৌঁছল এক নদীর ধারে। সেখানে খেয়াতরীর মাঝির সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হলো তার। সে মাঝিই তাকে বলে দিল জীবন হচ্ছে চিরপ্রবহমান নদীর মতো। এইখানে এসে আমার কাঁপুনি থেমে গিয়েছিল। তখন নিরাশ কি হয়েছিলাম, না কি জেনে শান্ত যে, তাই তো, তাই তো, অন্যরকম উত্তর পেলে তো হেরমান হেসকেই ছুঁড়ে ফেলতে হতো, মনে পড়ছে না। পরে অবশ্য এই চিন্তাই স্থিতি পেয়েছে যে, উত্তর তো এমনই প্রত্যাশিত। নদী চলেছে বহে। জীবনও সেইমতো। শান্তি যদি পাও এতে, পাবে, না হলে পাবে না।

bvc
কৃতজ্ঞতায়ঃ আলতাফ হোসেন।
অবাক বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য। পদ্মা পাড়ের মানুষ ব্লগ থেকে সবিনয়ে শেয়ার করা হলো।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

কোন মন্তব্য নেই

মন্তব্য বন্ধ আছে।