সেলিম আল দীন: একজন মহানায়কের মহাপ্রয়াণ

Selim Al Deen

সেলিম আল দীন (১৮ই আগস্ট ১৯৪৯ – ১৪ই জানুয়ারি ২০০৮)।
পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

একজন প্রখ্যাত নাট্যকার। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি নাটকের আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক বা স্যাটায়ার-ধর্মী নাটকে তিনি বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

জীবনী:
সেলিম আল দীনের বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। সেই সূত্রে ঘুরেছেন বহু জায়গা। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি ছিল তাঁর চরম ঝোঁক। তাই দূরে কাছে নতুন বই দেখলেই পড়ে ফেলতেন এক নিমেষে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর লেখক হওয়ার বিষয়ে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। লেখক হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে, কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মাধ্যমে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিয়ে লেখা তাঁর বাংলা প্রবন্ধ নিগ্রো সাহিত্য ছাপা হয় ওই পত্রিকায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সেলিম আল দীন, যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে, কপি রাইটার হিসাবে। ১৯৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ওই বছরই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসানের অকাল মৃত্যু হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফকে সাথী করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার।

তাঁর প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৯ সালে এবং টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় লিব্রিয়াম (পরিবর্তিত নাম ঘুম নেই) প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। আমিরুল হক চৌধুরী নির্দেশিত এবং বহুবচন প্রযোজিত প্রথম মঞ্চনাটক সর্প বিষয়ক গল্প মঞ্চায়ন করা হয় ১৯৭২ সালে। তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্য বিষয়ক কোষগ্রন্থ বাংলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন। তার রচিত হরগজ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনুদিত হয় এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে।

সেলিম আল দীনের প্রথমদিককার নাটকের মধ্যে সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মূল সমস্যা, এগুলোর নাম ঘুরে ফিরে আসে। সেই সঙ্গে প্রাচ্য, কীর্তনখোলা, বাসন, আততায়ী, সায়ফুল মূলক বদিউজ্জামান, কেরামত মঙ্গল, হাত হদাই, যৈবতি কন্যার মন, মুনতাসির ফ্যান্টাসি ও চাকা তাকে ব্যতিক্রমধর্মী নাট্যকার হিসেবে পরিচিত করে তোলে। জীবনের শেষ ভাগে নিমজ্জন নামে মহাকাব্যিক এক উপাখ্যান বেরিয়ে আসে সেলিম আল দীনের কলম থেকে। তিনি ২০০৮ সালের ১৪ই জানুয়ারী মৃত্যু বরণ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নাটক এর উপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।

উল্লেখযোগ্য নাটক সমূহ:

* জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৭৫)
* মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি (১৯৭৬)
* বাসন (১৯৮৫)
* কিত্তনখোলা (১৯৮৬)
* কেরামত মঙ্গল (১৯৮৮)
* চাকা (১৯৯১)
* হরগজ’ (১৯৯২)
* যৈবতি কন্যার মন (১৯৯৩)
* শকুন্তলা
* হাত হদাই (১৯৯৭)
* বণপাংশুল
* ধাবমান
* পূত্র
* নিমজ্জন (২০০২)
* প্রাচ্য (২০০০)
* স্বর্ণবোয়াল (২০০৭)

গীতিনৃত্যনাট্য:
* স্বপ্ন রজনীগণ
* ঊষা উত্সব

রেডিও-টেলিভিশনে প্রযোজিত নাটক:

* বিপরীত তমসায় (রেডিও পাকিস্তান, ১৯৬৯)
* ঘুম নেই (পাকিস্তান টেলিভিশন, ১৯৭০)
* রক্তের আঙ্গুরলতা (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি)
* অশ্রুত গান্ধার (বিটিভি, ১৯৭৫)
* শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য (বিটিভি, ১৯৭৭)
* ভাঙনের শব্দ শুনি (আয়না সিরিজ, বিটিভি, ১৯৮২-৮৩)
* গ্রন্থিকগণ কহে (বিটিভি, ১৯৯০-৯১)
* ছায়া শিকারী (বিটিভি, ১৯৯৪-৯৫)
* রঙের মানুষ (এনটিভি, ২০০০-২০০৩)
* নকশীপাড়ের মানুষেরা (এনটিভি, ২০০০)
* কীত্তনখোলা (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫)

গবেষণাধর্মী নির্দেশনা:

* মহুয়া (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯০)
* দেওয়ানা মদিনা (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯২)
* একটি মারমা রূপকথা (১৯৯৩)
* কাঁদো নদী কাঁদো
* মেঘনাদ বধ (অভিষেক নামপর্ব)

চিত্রনাট্য:

* চাকা’ নাটক অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৪
* ‘কীত্তনখোলা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০০ সালে।
* ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা করেন ১৯৯৪ সালে।

অন্যান্য রচনা:

* দিনলিপি
* ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ

পুরস্কার ও স্বীকৃতি:

* বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪)
* ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা (১৯৮৫)
* কথক সাহিত্য পুরস্কার (১৩৯০ বঙ্গাব্দ)
* একুশে পদক (২০০৭)
* জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩)
* অন্য থিয়েটার, কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা
* নান্দিকার পুরস্কার, আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা, ১৯৯৪
* শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (১৯৯৪)
* খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার
* জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) ১৯৯৪
* মুনীর চৌধুরী সম্মাননা (২০০৫)

সেলিম আল দীনের অপ্রকাশিত রচনা:

2010-12-02-09-09-45-066189200-selim_al_din বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত ও কামাল উদ্দিন কবির নির্দেশিত অহরকণ্ডল নিয়ে সেলিম আল দীন লিখেছেন ‘যে কথাগুলো বলা উচিত’। নিচে তাঁর ডায়েরির কিছু অংশ বিশেষ তুলে দেয়া হলো –

লোকায়ত জীবনের মধ্যে খানিকটা বাইবেলের ফিউশন-অহরকণ্ডল। বাকিটা ছড়া-প্রবচন-ধ্রুপদী শব্দের ঘন গম্ভীর ধ্বনি। বাংলা নাট্যের সীমায় এ খুব অবাক হওয়ার মতো কাজ। নাট্য-ভূমিকায় লেখক যা বলেন তাতে তাঁর শিল্পভাবনার কৌশলটা বেশ বুঝতে পারা যায়। চরিত্রের নির্বিশেষ করণের বাড়তি প্রয়াস যে ওটা তাতে সন্দেহ নেই।
অহরকণ্ডলের গল্পটি আমাকে প্রথম শুনিয়েছিল নাসির উদ্দীন ইউসুফ। শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। দীনপুণ্য বাংলা নাট্যে এ রকম কেউ ভাবে নাকি-বলে নাকি-লেখে নাকি?

তারপর কামালউদ্দিন কবির আমাকে অহরকণ্ডলের পাণ্ডুলিপি পড়তে দেয়। লেখাটি পড়তে পড়তে দেখতে পাই কথকের বলার ভঙ্গিতে বিচিত্র সব চিত্র-উড়ে আসে কি মাটি ফুঁড়ে বেরোয়। ঘটনা-চরিত্রের মনোভঙ্গি-ইঙ্গিত-দ্ব্যর্থবোধকতা-সব মিলিয়ে অবাক হওয়ার মতো লেখা।
বুঝতে পারা যায়, বাংলা নাটক চলনে-বলনে আর উপনিবেশ কালের শাসন অগ্রাহ্য করছে সচেতন শিল্পরীতির মাধ্যমে, যে রীতিটা উঠে এসেছে আবহমানকালের ধারায়-প্রাচীন ও মধ্যকালের বাংলা থেকে। তবে তাতে পাশ্চাত্য শিল্পরীতির ন্যায্য অংশটুকুই গৃহীত হয়েছে-বিশ্ব সংস্কৃতির আধুনিক প্রবাহের ধারায়।

বর্ণনাত্মক বাঙলা নাটক যে বিশ্বনাটকের শিল্পযাত্রায় এক নতুনতর সংযোজন সে বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না, যখন দেখি আমাদের একদিনের ক্ষীণ-ভীরু চেষ্টাটা আজ বৃহত্তর শিল্পমণ্ডলবর্তী। একদিন নিজের রচনার ভিতরে নিঃসঙ্গের মতো নির্জনে বসবাস করতাম। আজ দেখি সেই চেষ্টা কতই না বিচিত্রতর ভিন্নধারায় বাহিত হচ্ছে।
রবীন্দ্রোত্তরকালে বাঙলা কবিতা ও উপন্যাসের চেয়েও বাঙলা নাটক নবতর অথচ ভূমিজ এবং অনঔপনিবেশীয় আঙ্গিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সে বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় বলা সংগত।

অহরকণ্ডল আমাদের নাট্যভাষায় এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ নাটকের পরিচালককে এ জন্য ভাষা পারিতোষিক দেই যে তিনি বলার ভঙ্গিটাকেই থিয়েটারে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছেন। একটা নতুন থিয়েটার সৃষ্টির অঙ্গীকার না থাকলে অহরকণ্ডলকে মঞ্চে তুলে আনা সম্ভব হতো না।
পাশ্চাত্য নাট্যধারার বিশাল থাবার নিচে আমাদের এ সকল প্রয়াস-একদিন ভূমি ভেদী বৃক্ষ রূপে দাঁড়াবেই-এই বিশ্বাসে নিরন্তর নিজ বীজ প্রোথিত করি বাঙালির শিল্প ভূমিতে।
৩রা মে ২০০৬।

sad-1.jpg
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

কোন মন্তব্য নেই

মন্তব্য বন্ধ আছে।