চার
উঠোনে কঞ্চি দিয়ে মাটি খুঁড়ে তাতে গোড়ালি বসিয়ে এক ঘুর, দুই ঘুর, তিন ঘুর… ব্যাস ব্যাস, পিল তৈরি। হেল্লাস, সেকেন লাস, থাড় লাস। আঁটে না টোক্কায়, আগে বলবি তো!
তারক ডাক্তারের ছেলে ব্যাঁকার মতো যারা বড় গুলিশিল্পী, তাদের সহকারীর হাতে টিনের গ্ল্যাকসো কৌটোয় ঝম্পর-ঝম্পর টল, মাত্তিশ আর এমনি-গুলি। কলোনিতে ব্যাঁকার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বলরাম দাসের ছেলে সেই ফুটবলার পিকু; ব্যাঁকার টিপ বেশি আর পিকুর চোট্টামি বুদ্ধি। খেলার শেষে সবাই জানে মারামারি বাধবে, আজাদ হিন্দ ক্লাবে কাঠের প্যারালাল বারে বুক-ডন আর বেঞ্চে চিৎ হয়ে বারবেল ভাঁজা ব্যাঁকা পিকুকে এমন জাপটে ধরে যে নড়াই মুশকিল! তার মধ্যেও সে হাঁটু তুলে শত্রুর দুই থাইয়ের মাঝখানে মারে বা মাথা দিয়ে থুতনিতে ঢুঁসো লাগিয়ে জিভ কেটে দেয়।
কিন্তু কভি-কভি উদ্বাস্তু-সীমা ছাড়িয়ে গুলিখেলা আন্তর্জাতিক চেহারা নিতে পারে। আজ যেমন মান্নাপাড়া থেকে বর্মন, চালতাবেড়িয়ার ক্ষুদে, এমন অনেক বহিরাগত আর্টিস্ট কলোনির জনার্দন ভক্তের দোআঁশ মাটির টানটান বেডকাভারের মতো সেই প্রাঙ্গনে। কলাকারদের খ্যাতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে খেলতে খেলতে বিড়ি টানার অধিকার। আর ওই শিল্পীসমন্বয়ে হাঁটুঝুল স্কার্ট পরা স্কুলপাড়ার পলি মিত্র যোগ দেওয়ায় সাড়া পড়ে গেছে শরণার্থী তরুণদের হাড়পাঁজরে। আজাদ ক্লাবের বটের ঝুরি ধ’রে যারা দোল খাচ্ছিল, খোয়ারাস্তায় লাফিয়ে প’ড়ে; যারা পড়া মুখস্থ করছিল, জানলায় নিরক্ষীয় জলবায়ুকে হাট ক’রে খুলে, যারা ডোবায় ছিপ পেতেছিল, ছিপ ল্যাটামাছের জিম্মায় রেখে ছুটে এল। যেন মৈত্রী সংঘের পাশে নাগকেশর ফুলের গন্ধমাখা রেশন দোকানে আজ মাইলো দেবে!
তারপর দুই-দুই, চার-চার, আট-আট, ষোল-ষোল গুলির জিত্তাল খেলায় শ্বাসরোধ হয়ে আসে দর্শকের; প্রত্যেকবার টিপ শানানোর আগে জিভে টল ছুঁইয়ে নিচ্ছে ক্ষুদে, যেন সাপের মাথার মণি; স্কার্টের দুটো ফুলে থাকা পকেট নিয়ে পলি উঠোনে হাঁটলে “ঝুমুর-ঝুমুর নুপূর বাজে, নয়নে নয়ন মিলিয়া গেল…”! চকচকে রবিশস্যের মতো এই কাচের ফসল। বড় হয়ে বাসু হিন্দি সিনেমায় দেখেছে এমনই মূল্যবান ডায়মন্ড সাদা কোটপ্যান্টের অজিত অ্যাটাচিকেসে পুরে জোর বাতাসে টাই উড়িয়ে হেলিকপ্টারে উঠে যায়। তারপর সমুদ্রতীরে গিয়ে নামলে সেখানে সুধীর বিদেশি জাহাজে হিরে তুলে দেবে লালমুখো সাহেবের হাতে। পরের সিনে গ্রামের মেলায় নীল ঘাঘরা প’রে নাচছে হেমামালিনী। হেমামালিনীর নাভি দেখে বাসুর ভক্তবাড়ির মসৃণ পিল মনে পড়ে।
যত খেলা গড়াচ্ছিল, চটাং-চটাং আঘাতে গুলির চল্টি খ’সে মাটিতে অভ্রর ওয়াগন ওলটানো। এই পথিক-থামানো আনন্দের চারপাশে সদাচারী ব্রতচারী সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিয়ালদা থেকে ফেরা ফলের ব্যাপারি, মাথার পেছনে খালি ঝাঁকার ঘোমটা, লুঙির খুঁট উত্তেজনায় তার মুখে উঠে গিয়ে কোঁচকানো হাফপ্যান্ট প্রকাশিত। উলু হয়ে গিয়ে এক এক ক’রে সরে দাঁড়াচ্ছে খেলোয়াড়, গ্ল্যাকসোর কৌটো প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে উলটে দিয়ে দুঃখিত দর্শক হয়ে যাচ্ছে। যেন নায়ক ব্যাঁকার উড়ন্ত লাথি খেয়ে অজিতের হাত থেকে অ্যাটাচি ছিটকে পড়ল, আর মাটিতে গড়াচ্ছে অসংখ্য উজ্জ্বল গুলির সাঁজোয়া।
লাস্ট ডিলে শেষ শত্রু বর্মনের গুলির দিকে তেরো হাত দূর থেকে টিপ শানাবে ব্যাঁকা। মাথায় ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বাঁহাতের মধ্যমা আকর্ণ ধনুরাসনে পেছনে বেঁকে, গোটা পৃথিবীর শ্বাস বন্ধ, গাছ থেকে ঝুঁকে দেখছে পেঁপেফুল, বাবুইবাসার দোল থেমে গেছে। আমরা জানি না বুলেট লাগবে কি লাগবে না, শ্রীকৃষ্ণের কী অভিপ্রায়, এবং বেদব্যাসও লেখা থামিয়ে দিচ্ছেন কাকে জেতাবেন ঠিক করতে না পেরে।
পাঁচ
দু’বছর আগে গুলিখেলার বিরল প্রতিভা ব্যাঁকা-চ্যাম্পিয়ানের জীবনের অন্তিম ম্যাচের কথা বললাম এত সময়। ব্যাঁকা আর নেই, অথবা আছে স্বপন হয়ে। ম্যাচের পরের দিন তেরটা কৌটো ভর্তি কম-বেশি দুহাজার গুলি সে বাচ্চাদের বিলিয়ে দেবে। এবার থেকে তাকে কেউ ব্যাঁকা ডাকলেই তেড়ে যাবে — স্বপন বলতে পারিস না! সকালের ব্যায়াম আরও বাড়িয়ে (ভালো কথা, পাজামা প’রে ক্লাবে যাচ্ছে, লুঙি ছেড়েই দিল) দুপুর-দুপুর বালিশা-র চেম্বারে বাবার পাশে একটা ছোট্ট টেবিল পেতে বসা চালু করবে। এই পরিবর্তনে কেউ খুশি হয়, কেউ হয় না, কিন্তু কলোনি আর একজন ডাক্তার পায়, বেশি রাতে ডাকলেও গলায় উত্তরীয়র মতো স্টেথো ঝুলিয়ে খুব গম্ভীর মুখে স্বপন পেশেন্টের ঘরে ঢুকে পড়ছে। শুধু সুধার ছুটোছুটি বেড়ে গেল। সে ময়নার মতো ময়নাতদন্তের খবর মুখে বাড়ি-বাড়ি উড়তে থাকে। “ও কাকি, শুনিছো”? তারপর ঘরের বাচ্চাদের “এই, তোগো এহেনে কী রে? যা, খেলতি যা!” ব’লে তাড়িয়ে চাঁদের মা’র কানের কাছে হাস্যমুখ নিয়ে যায়।
চড়কপাড়ার উকিলের মেয়ে শীলার প্রেমে পড়েছে স্বপন। এঁড়ে বাছুর থেকে বৃষ হয়ে উঠছে তাই। এভাবে দুবছর কেটে গেলে ব্যাঁকা যখন স্বপন থেকে স্বপনডাক্তার ডাক শোনার অপেক্ষায়, তখন আচমকা সবাই খেয়াল করে সে আবার ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বাজারে চলে যাচ্ছে, বিকেলে ঘুমিয়ে উঠে বটতলায় বসে আগের মতো গুড়াকু ডলছে দাঁতে। তবে গুলিখেলায় ব্যাঁকা আর ফিরে আসেনি, তার আঙুল ওই আশ্চর্য টিপ করার ক্ষমতা ভুলে গিয়েছিল। যেভাবে শীলা ভুলে গিয়েছিল স্বপনকে।
অন্যদিকে ব্যাঁকার বন্ধুর আচম্বিতে বিয়ে হয়ে গেল অচেনা নাক-খ্যাঁদা মেয়েটার সঙ্গে, সঙ্গে অপবাদ জুটল গোপন প্রেমের। টিপু তবু ভোল পালটায়নি। সকালে ভক্তিভরে স্টেশানের গায়ে তার বইয়ের দোকানে গিয়ে বসে। সারাদিনে একটা দুনম্বর খাতা কিম্বা একজোড়া স্লেট পেনসিল বিক্রি হয়। বাড়িতে ছ’জনের কীভাবে দুটো ভাত জুটছে তাকে রহস্য রেখেই ছেলেটা পান খায়, চা খায়, গুলতানি মারে পাশের ওষুধ বা সাইকেল সারানোর দোকানের সঙ্গে। প্রায় দশ বছর হল নন্দ চলে গেছে আমতলাবাড়ি ছেড়ে, শিউলির ক্লাস সেভন, কিন্তু নন্দরাক্ষসকে নিয়ে মেয়েটার সঙ্গে তার গল্পও হয়ত সারা জীবন চলবে।
— টিপুদা, তুমি কী করে খোঁজ পাও নন্দুর? সুন্দরবনে তো যাতি দেখি না!
— নিবাধুইয়ের গোয়ালারা ভিজিট করে যে, জঙ্গলের মধু কিনতি যায় ঝড়খালি সুধন্যখালি। ওরা কালকে খবর দিল, একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটিছে মাতলা নদীতি।
ছয়
জলযান ছুটছে দক্ষিণের নদী দিয়ে। সকাল সাড়ে দশটা, তবু এখনও ধুঁধলা চারপাশ, মাথার ওপর উড়ে বেড়ানো সারসগুলোকে শামুকখোলের মতো লাগছে (সাহিত্যিকদের মতো পরিবেশ তৈরি করছে টিপু)। মাতলার ডানে-বাঁয়ে আস্তে আস্তে পার হয়ে যায় বেলাডোনা নদী, পিয়ালি-নবীপুকুর নদী। লঞ্চের ভেতর ফরেস্ট অফিসার আর গ্রামোন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি বসে চা খাচ্ছেন। একজন নদী-বিশেষজ্ঞ, কুক, তার হেল্পার, দুই পাইলট বা সারেং — এই সাত জন নীচে আর লঞ্চের ডেকে বন দপ্তরের চার জন রক্ষী। ওপরে খুব হাওয়া, তারা কানে মাফলার জড়িয়ে রোদ্দুরে পিঠ ক’রে বসেছে, দুজনের রাইফেল ডেকের বাউন্ডারিতে হেলান দেওয়া। অফিস থেকে এভাবেই টহলে বেরনো হয়, কোথায় ম্যানগ্রোভ ভেঙে নদীর জলে মাটিসুদ্ধু তলিয়ে যাচ্ছে, কোথায় কাঠচোর বন উজাড় করে দিচ্ছে বা স্পটেড ডিয়ার মেরে নিয়ে যাচ্ছে কারা… দেখতে দেখতে বোইনচাপি খাল পার হয়ে ধূলিভাসানি গাঙের মুখে দাঁড়াল বন দপ্তরের জলযান। এখানে নদীর মুখ চেপে ছোট হয়ে এসেছে, জঙ্গলও গভীরতর সবুজ, পাখিদের হইচইতে গলা তুলে কথা বলতে হয়। রেঞ্জারবাবু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ডেকে উঠে আসছিলেন, পেছনে সভাপতি, হঠাৎ কানে এল জলের খলবল আওয়াজ, পরক্ষণেই বাঁদিকে টলে কাত হয়ে গেল লঞ্চ। গার্ডদের স্নায়ু সজাগ, তারা ঝটপট ডেকের ডানদিকে লাফিয়ে এসে রাইফেল কাঁধে নিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে রেলিংয়ের ফাঁকে বাঘ! প্রথমে শুধু মাথা; সেটা হাঁ হল, হলুদ দাঁত আর লালামাখা জিভের ভেতর দিয়ে মেঘডাকা গর্জন, তারপর এক লাফে রেলিং টপকে ডেকের মেঝেয় পড়ল আস্ত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। একজন গার্ড ফায়ার করেছে, লক্ষ্য পেরিয়ে সেটা গিঁথে গেল ধূলিভাসানির স্রোতে। বাঘ ফিরেও দেখল না, রেলিংয়ে থিয়ে ক’রে রাখা যে দুটো লোডেড রাইফেল, তার একটার হাতল কামড়ে ধরে বারো ফুট ওপর থেকে ঝাঁপাল জলে। গোটা অপারেশান সেরে সাঁতরে ওপারে উঠে জঙ্গলের ভেতর মিশে যেতে তার লাগল আড়াই মিনিট।
স্কুলে দিদিমনিরা যেমন বলে, তেমনি পিন-ড্রপ নীরবতায় শুনছিল চাঁদের বাড়ি। কিন্তু বাঘ তো মরল না, কাউকে মারলও না, সবচেয়ে বড় কথা কাহিনিতে নন্দরাক্ষস কোথায়?
— তোদের বলা হয়নি, নন্দকে ছেড়ে আসা হয়েছিল শুইয়া নদীর পাশে, ওই স্পটের কাছাকাছি।
— তো?
— আজ পর্যন্ত শুনেছিস বাঘ বন্দুক চুরি করে? এই বুদ্ধি তার মাথায় ঢোকাল কে! মনে রাখবি, নন্দবাবু তোদের কাছে, মানে মনুষ্যসমাজে এক বছর ছিল। আমাদের এক মানে বেড়ালের সাত বছর; এই সময়ের মধ্যে মানুষের ভাষা, তার বুদ্ধি সবই সে খুব কাছ থেকে খেয়াল করেছে। তাছাড়া, নন্দকে বন্দুক দেখিয়েই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
সবাই স্তম্ভিত, চিন্তিত, শিহরিত। শিউলি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, নন্দুকে আবার পুলিশে ধরবে না তো? বাসু বলল, নন্দর মতলব তাহলে কী? মা রান্নাঘরে উঠে যেতে যেতে বলল, আজুড়ে গল্প না দিয়ে টিপু বাড়ি যা। নতুন বউডা না খেয়ে বসে আছে।
টিপু সামান্য গলা চড়ায় — আগামি সপ্তাহের যুগান্তর কাগজে খবরটা পাবে, মিলিয়ে নিয়ো। তারপর বাসুর দিকে ঘুরে — ঘটনা এখনও পর্যন্ত এটুকুই। এর পরে কী হবে, বাঘেরাই ঠিক করবে।
(আরও আছে)
loading...
loading...
সাহিত্যের অনন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে আপনার লিখা গুলোন।
একরাশ শুভেচ্ছা প্রিয় কবি এবং গল্পকার চন্দন ভট্টাচার্য দা।
loading...