দুই বান্ধবী। দুজনেই বড়লোকের বেটি। একজনের নাম ঝর্ণা, আরেকজনের নাম বর্ণা। নামের মিল থাকার কারণে হাইস্কুল থেকেই দু’জনের বন্ধুত্বের বন্ধন শুরু। দুজন একইসাথে হাইস্কুল শেষ করে একই কলেজে ভর্তি হয়। লেখাপড়ার জীবনে আনন্দের সময়ই নাকি কলেজ জীবন। এই সময়টা খুবই ভাবনা চিন্তার সময়ও বটে। কারণ এই সময়টাতেই যার যার ভাগ্য নির্ধারণ করতে হয়। কে কী হবে! কে কোনটা নিয়ে পড়বে! কে ডাক্তার হবে আর কে ইঞ্জিনিয়ার হবে, এসব নিয়েই থাকে বেশি চিন্তায়!
আবার ধনীর ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ ওইসব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ভাবে অন্যটা। যেমন– কাকে ভালোবাসবে। কাকে ভালোবাসলে জীবনে বেশি সুখশান্তি ভোগ করা যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তো ঝর্ণা আর বর্ণা তারা দুজনেই ছিলো ধনীর দুলারি। কাজেই তাদের চিন্তা-ভাবনাও কোন ধরনের ছেলেকে বিয়ে করলে সারাজীবন সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। দুই বান্ধবীর মধ্যে ঝর্ণা একটু অহংকারী, আর বর্ণা বড়লোকের মেয়ে হলেও ও ছিলো খুবই বিনয়ী ও শান্ত! এই দুই বান্ধবী প্রায় দিনই কলেজের ক্লাস শেষে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েই আলাপচারিতায় মেতে ওঠে।
একদিন কলেজ চলাকালীন সময়ে দুপুরের টিফিনের সময় ঘনিয়ে এলো। টিফিনের সময় সবাই বের হয়ে যার যার মতো খাবার খেতে চলে গেলো। ঝর্ণা ও বর্ণা টিফিন করার এক ফাঁকে শুরু হয় তাদের ভবিষ্যৎ ভাবনার আলাপ।
ঝর্ণা–কিরে লেখাপড়া শেষ করার পর তুই কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি?
বর্ণা–তুই আগে বল, কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি?
ঝর্ণা–আমি? আমি একজন হ্যান্ডসাম সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার অথবা বড় ব্যবসায়ী ছেলেকে বিয়ে করবো। যাতে সারাটা জীবন সুখে-শান্তিতে সংসার করে যেতে পারি। আমার সংসারে চাকরবাকর থাকবে। নিজস্ব বাড়ি থাকবে। গাড়িও থাকতে হবে। এবার বল তুই কেমন ছেলেকে বিয়ে করবি?’
বর্ণা–আমার বাড়ি-গাড়ির প্রতি লোভ লালসা নেই। শুধু একজন মনের মত মানুষ হলেই হবে।
ঝর্ণা–বলিস কি? টাকা-পয়সা ছাড়া শুধু মন দিয়ে কী করবি?
বর্ণা–আরে শোন, আমি যেই ছেলেকে বিয়ে করবো ওর মন আর আমার মন একসাথে বেঁধে মিলেমিশে সংসার করবো। টাকা-পয়সা যদি হয় হবে। নাহয় তো নেই। মনের মানুষ তো সবসময় কাছে থাকবে! তাতেই আমি খুশি থাকবো।
–আচ্ছা, যাদের টাকা-পয়সা প্রচুর আছে, তাদের কি মন নেই?
–অনেক আছে। আবার অনেকেরই থাকে না। তো যাদের মন থাকে না, তাদের থাকে ধনসম্পদ আর অর্থবিত্তের প্রতি খুবই নেশা। সেই নেশায় আসক্ত হয়ে তারা সময়তে নিজের স্ত্রী সন্তানকেও দূরে ফেলে দেয়। এমনকি নিজের জন্মদাতা পিতা গর্ভধারিণী মাকেও দূরে রাখে। আবার কেউ কেউ তো মা বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমেই রাখে। আমি বাবা এমনটা চাই না। আমি একটা গরিব মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে চাই। আর এরকম একটা ছেলে আমি নিজেই পছন্দ করে রেখেছি। সময় হলে তোকে বলবো।
–ওহ্ আচ্ছা, তা বল! কে তোর মনের মানুষটি? আমি কি তাকে চিনবো? বল না!
–হ্যাঁ, অবশ্যই চিনবি! ও-ই যে, সেদিন যে ছেলেটার সাথে আমি কথা বললাম, সেই ছেলেটা।
–আরে, ও-ই লোকটা তো নেহাৎ গরিব! কিছুদিন আগে ওর বেতন মওকুফ করার জন্য প্রিন্সিপালের কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল। সেটা কি তুই জানিস?
–জানি! আরও জানি, ওর বেতন মওকুফের আবেদন পত্রটি মঞ্জুর হয়নি। তবে বেতন পরিশোধ ঠিকই হয়েছে।
–তা কীভাবে? আমি নিজেই দিয়েছি, ওর বকেয়া বেতনের টাকা। সেই টাকা দিয়েই ও বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছে।
–তুই কিন্তু ভুল করছিস! ভুল করছিস এই কারণে যে, তুই একজন বিত্তশালীর মেয়ে। তোর বাবার অঢেল সম্পত্তি। শহরে নিজেদের ব্যবসা। গাড়ি আছে। তোর বাবার ব্যাংক ভর্তি টাকাও আছে। ও-ই ছেলেটার কী আছে?
–ও-ই ছেলেটার একটা সুন্দর মন আছে। এমন সুন্দর মন আর দশজনেরও নেই।
–আচ্ছা, নিজেদের তো একটা বাড়িও থাকা চা-ই-ই। সেটা কি আছে?
–আছে। তবে ওদের বাড়িঘরে কোনও সময় যাওয়া হয়নি আমার। তো তাও না থাকুক, সমস্যা নেই। একসময় হয়তো হয়েও যেতে পারে। তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। কারণ আমিও শিক্ষিত। ছেলেটা গরিব হলেও শিক্ষিত। বিয়ের পর ভেবেচিন্তে একটাকিছু করা যাবে।
–নিজের ঘরদোর না থাকলে থাকবি কই?
–ছেলেটার মনটাই একটা বিশাল বাড়ি। আর সেই বাড়ির ঘরগুলো হলো ছেলেটার মনের ভেতরে থাকা মনিকোঠা। সেই কোঠাতেই দুজন খুব সুন্দরভাবে থাকতে পারবো। তাছাড়া আমার বাবার তো আছে। আমার বাবা কি আমাদের জন্য কিছুই করবে না।
–মনে কর যদি না-ই-বা করলো?
–তাতেও সমস্যা নেই। ও যদি একটা চাকরি করে, তাহলে আর সমস্যা কোথায়, বল? আর আমিতো শিক্ষিত। আমিও কি বসে থাকবো? দুজনের ভালোবাসা আর দুজনের দুই মন একসাথে বেঁধে নিজেদের ঘর বাঁধার কাজে গেলে যাবো। তার জন্য তুই আমার জন্য চিন্তা করবি না। আমি দোয়া করি তুই তোর স্বামীর সংসারে সবসময় সুখে থাকিস।
এই বলেই সেদিনের মতো দুই বান্ধবীর আলাপচারিতা শেষ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়।
একসময় ঝর্ণার বিয়ে হয় এক আমেরিকা প্রবাসী ছেলের সাথে। ঝর্ণার বিয়ের দাওয়াত বর্ণা পেয়েছিল। বিয়ের দিন বর্ণা একটা উপহারের বাক্স হাতে নিয়ে ঝর্ণার বিয়ের দাওয়াতে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর বর্ণা ঝর্ণার সাথে দেখা করতে গেলে, ঝর্ণা হাসিমুখে বর্ণাকে কাছে ডাকে। বর্ণা ঝর্ণার কাছে গিয়ে এতোদিনের বন্ধুত্বের শেষ হাসি বিনিময় করে পাশে বসে।
ঝর্ণা বর্ণার কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আমিতো এখানে বেশিদিন থাকছি না। বরের সাথেই আমেরিকা চলে যাবো। তোর সাথে তো আর শীঘ্রই যোগাযোগ হবে না। কিন্তু আমার মন, ভালোবাসা সবসময়ই তোর সাথে থাকবে। আর হ্যাঁ, যদি পারিস, তাহলে তোর ভবিষ্যৎ বিয়ের ভাবনাটা পরিবর্তন করে, ভালো ব্যবসায়ী অথবা ভালো একজন প্রবাসী ছেলের দিকে দৃষ্টি দিবি। গাঁও গেরামের ছেলে-পুলেরা তোর মতন মেয়ের মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে না, তা আমি শতভাগ নিশ্চিত! তো আর কিছুই আমার বলার নেই, আমার কথাগুলো সময়মতো ভেবে দেখবি’।
ঝর্ণার কথাগুলো বর্ণা শুধু শুনেই গেল, প্রত্যুত্তর কিছুই দেয়নি। শুধু ঘাড় কাত করে হ্যা ভাব প্রকাশ করলো। এরপর ঝর্ণাদের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরে এলো।
এদিকে বর্ণা বিএ পাস করে বাপের ঘরে। আর বর্ণার সেই মনের মানিক ছেলেটিও একই সময়ে বিএ পাস করে, লেখাপড়ার ইতি টানে। বিএ ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ছেলেটা নিজেদের গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। ছেলেটার গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা আছে, কিন্তু বসতভিটা ছাড়া আর কোনও জায়গাজমি বর্তমানে নেই। যা ছিলো, তা বাড়ির মুরুব্বি একমাত্র ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পরের জমিতে দিন মজুরের খেটে খায়। তবুও ছেলেটার বাবার মনে কোনও দুঃখ নেই, আছে শুধু আশা! আশা হলো, ছেলেটা যদি ভালো একটা চাকরিবাকরি পায়, তাহলে জীবনের কষ্ট স্বার্থক হবে। এই আশা নিয়েই একমাত্র ছেলের মুখপানে চেয়ে আছে।
ছেলেটা বাড়ি গিয়ে বাবার এতো কষ্ট দেখে আর ভালো লাগছিল না। দুই-তিনদিন বাড়িতে থেকে আবার সে তার আগের গন্তব্যে পৌঁছে। গন্তব্য ছিলো কলেজের পাশে থাকা এক বাড়ির ব্যাচেলর বাসা। একটা ব্যাচেলর বাসায় তিন-চারজন মিলে থাকতো। খাওয়া-দাওয়া হতো মেসে। শহরে এসে ছেলেটা একটা চাকরির জন্য এখানে সেখানে আবেদন করার পাশাপাশি কলেজ বান্ধবী বর্ণার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। এভাবে ক’দিন যেতে-না-যেতেই ভালো একটা রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে ছেলেটা চাকরি পেয়ে যায়। চাকরিটা ব্যাচেলর বাসায় আর মেসে খেয়ে ছেলেটা যখন মনোযোগ সহকারে করতে ছিলো, কলেজ পড়ুয়া বর্ণা নামের মেয়েটির আকুতি-মিনতি শুরু হয়।
বর্ণার আকুতি আর মিনতির কারণও ছিলো। কারণ হলো, বর্ণার বাবা। বর্ণার বাবা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। এই ঘটক, সেই ঘটক, এই পাত্র, সেই পাত্র করতে করতে একরকম মাথা নষ্টের পালা। যত পাত্রই দেখাক, বর্ণার প্রাত্র পছন্দ হয় না। বর্ণার মনের এরকম ভাব দেখে বর্ণার বাবা জিজ্ঞেস করে কোথাও কারো মন দিয়েছে কিনা! প্রত্যুত্তরে বর্ণা তার পছন্দের কথা জানালে, বর্ণার বাবা একরকম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বাবার এরকম অবস্থা দেখেই বর্ণা ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
কিন্তু ছেলেটা একরকম নিরুপায়! নতুন চাকরি। বাড়িতে বাবার ঋণের টাকা। তার উপর আবার বাড়িতে ভালো ঘরদোর নেই। এমতাবস্থায় যদি ছেলেটা মা-বাবার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে ওঠে, তাহলে মা-বাবার মনে যদি কষ্ট পায়? ছেলেটা এরকম মনোভাব বর্ণাকে জানালে, বর্ণা বলে, ‘আমিই সবকিছু ম্যানেজ করে নিবো, তাতে কোনও সমস্যা হবে না। বর্ণার মুখে একথা শুনে ছেলেটা মা-বাবাকে না জানিয়ে একদিন কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলে।
কোর্ট ম্যারেজ করে বর্ণাকে নিয়ে সোজা নিজের বাড়িতে চলে যায়। ছেলের সাথে এক যুবতী মেয়ে দেখে ছেলেটার মা-বাবা কাঁদতে শুরু করে। তখন ছেলেটার আগেই নতুন বধু বর্ণা নতুন শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এতে ছেলেটার মা-বাবার মনটা অনেক হালকা হয়ে যায়। তারপর তাদের চোখের জল মুছে নতুন বউকে সমাদরে ঘরে তুলে। ছেলেটা বর্ণাকে মা-বাবার কাছে সঁপে দিয়ে একদিন পরই আবার শহরের চলে যায়, নিজের নতুন চাকরি বাঁচানোর জন্য।
এর ক’দিন পরই বর্ণার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বুঝতে পারছে যে, নতুন বউ ভাঙাচোরা ঘরে ওঠার পর থেকে গরিবের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর যেন দিনে দিনে আলোকিত হচ্ছে। শত অভাবের মাঝেও যেন অভাব নেই! ঘরে কিছু না থাকলেও কোনও হাহাকার নেই! সবদিক যেন পরিপূর্ণ! এছাড়াও ছেলের বউয়ের আচার-ব্যবহারে শ্বশুর শ্বাশুড়ি দুইজনই মহাখুশি! এভাবেই বর্ণা খেয়ে-না-খেয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ির খেদমত করে সংসার পরিচালনা করার ফাঁকে গ্রামের দু’একটা ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করে। এতে যেই টাকা পায়, সব টাকাই বৃদ্ধ শ্বশুরের কাছে দিয়ে দেয়। বর্ণার স্বামীও শহর থেকে মাসে একবার বাড়িতে এসে চাকরি বেতনের অবশিষ্ট টাকা বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে বুঝিয়ে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে বর্ণার সংসার।
এদিকে বর্ণার বান্ধবী ঝর্ণা স্বামীর সাথে আমেরিকা গিয়ে সংসার শুরু করলেও, ঝর্ণার সেই সংসার বেশিদিন টিকেনি। বছর খানেক ঝগড়া-ঝাটির মধ্যে সংসার করে অবশেষে প্রবাসী স্বামীকে ছেড়ে দেশে ফিরে আসে। ঝর্ণা দেশে ফিরে এসেই সবার আগে বান্ধবী বর্ণার খবর জানতে বর্ণার বাবার বাড়িতে যায়। ঝর্ণা বর্ণার বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখে বর্ণার মা-বাবা দুজনই গুরুতর অসুস্থ! বর্ণা মা-বাবা একমাত্র মেয়ে। বর্ণা ছাড়া বর্ণার মা-বাবার আর কোনও সন্তান নেই, বর্ণাই একমাত্র সন্তান। কিন্তু বর্ণা নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করাতে তার বাবা বর্ণাকে তাদের অসুস্থতার কথা জানায়নি। না জানালেও বর্ণার মা-বাবা মনে মনে সবসময়ই বর্ণা বর্ণা কাঁদে। কিন্তু প্রকাশ করে না। ঝর্ণাকে দেখে বর্ণার মা-বাবা জানতে চায়, ‘আমাদের বর্ণা কেমন আছে’?
প্রত্যুত্তরে ঝর্ণা বলে, ‘আমিতো এই ক’দিন হয় আমেরিকা থেকে এসেছি, খালু। আমি আপনাদের বাড়ি এসেছি বর্ণার সাথে দেখা করতে। তো ও এখন কোথায়’?
বর্ণার বাবা বিষ্মিত চোখে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কী আশ্চর্য! তুমি কি কিছুই জানো না? ও-তো ওর কলেজ বন্ধু ছেলেকে বিয়ে করে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। ওখানেই নাকি স্থায়ীভাবে থাকবে। তুমি কি ওদের গ্রামের বাড়ি চেনো? যদি চেনো, তাহলে গিয়ে বলো, আমাদের দেখে যেতে আর আমার স্থাবর অস্থাবর সবকিছু বুঝে নিতে। ও ছাড়াতো আমাদের আর কেউ নেই’।
বর্ণার মা-বাবার কথা শুনে ঝর্ণা বুঝতে পেরেছে যে, ‘বর্ণা হয়তো স্বামীর সংসারে খুব ভালো আছে। যার কারণে ও-ই গ্রামের ছেলেটার হাত ধরে চলে যাবার পর ও এখানে আর আসেনি। তা-ই যদি হয়, তাহলে বর্ণার ভবিষ্যৎ চিন্তাই কি ঠিক ছিলো’?
এসব ভেবেচিন্তে ঝর্ণা কলেজ পড়ুয়া আরও সহপাঠীদের কাছ থেকে ছেলেটার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করে একদিন ছেলেটার গ্রামের বাড়ি রওনা দিলো। সংগ্রহ করা ঠিকানামতো ঝর্ণা ঠিকঠাক পৌঁছে গেলো, বর্ণাদের বাড়িতে। গিয়ে দেখে বাড়ির ঘরের বারান্দায় এক বৃদ্ধ বসে বসে হুক্কা ফুঁকছে। ঝর্ণাকে দেখামাত্র বারান্দায় বসা বৃদ্ধ লোকটা বউমা বউমা বলে ডাক দেয়ার সাথে সাথে বর্ণা ঘর থেকে বের হয়ে বললো, ‘আব্বা ডাকলেন’?
বর্ণনা শ্বশুর বললো, ‘হ্যাঁ বউমা, দেখতো মেয়েটি কাকে খুঁজছে’?
শ্বশুরের কথা কানে যেতেই বর্ণা ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, এ যে ঝর্ণা! বর্ণা আর দেরি না করে দৌড়ে ঝর্ণার কাছে এসে বললো, ‘আমেরিকা থেকে কবে এলি, বল? কেমন-ই-বা আছিস’? ভালো আছিস তো? তোর স্বামীকে সঙ্গে আনিসনি কেন? লোকটা কোথায়? তোর সাথে এসেছে’?
ঝর্ণা বললো, ‘না, ও সাথে আসেনি। আমি একাই এসেছি, ক’দিন হলো মাত্র’।
‘কেন আসেনি’? জানতে চাইল বর্ণা। কিন্তু ঝর্ণা বর্ণাকে সদুত্তর কিছুই দেয়নি, শুধু এড়িয়ে গেল। এসব কথা বলাবলির মাঝেই বর্ণা ঝর্ণাকে ঘরে নিয়ে বসতে দিলো। খাবার দিলো। খাবার খাওয়ার মাঝেই ঝর্ণা বর্ণাকে তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর স্বামী কোথায়’?
বর্ণা বললো, ‘ও-তো শহরে চাকরি করে। মাসে একবার আসে। মাঝেমধ্যে প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও বন্ধ পেলে চলে আসে’। ছুটি শেষে আবার চলে যায়। আমি আমার বৃদ্ধ শ্বশুর শ্বাশুড়ি নিয়ে বাড়িতেই থাকি। ঝর্ণা জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর বাবার বাড়িতে যাসনে কেন? তোর বাবা-মা তো অসুস্থ। আমি আমেরিকা থেকে এসেই তোর খোঁজে তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তোর মা-বাবা তোকে যেতে বলেছে। তাদের সমস্ত স্থাবর অস্থাবর হয়তো তোর নামেই দিয়ে দিবে। তুই সময় করে তোর স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে যাবি। তোর মা-বাবা হয়তো রাগ-গোস্বা ভুলে গিয়ে তোকে বুকে টেনে নিবে’।
ঝর্ণার কথা শুনে বর্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমার মা-বাবাকে দেখতে যাবো। তবে তাদের ধন সম্পত্তির লোভে নয়। গর্ভধারিণী মা ও জন্মদাতা পিতার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আর তাদের ভালোবাসার টানেই যাবো।
এখন বল, তুই কী সুখে আছিস’?
বর্ণার কথার জবাব দিতে গিয়ে ঝর্ণার দুচোখ বেয়ে জল ঝরতে লাগলো! একরকম কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ‘না বর্ণা, আমি ভালো নেই। কলেজ জীবনে আমার ভবিষ্যৎ ভাবনা ছিলো ভুল! তাই আমি প্রবাসী স্বামী পেয়েও সুখী হতে পারিনি, যতটা তুই গ্রামের ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হয়েছিস। আমি সুখী হতে পারিনি এই কারণে যে, আমি একটু বেশি সুখী হতে চেয়েছিলাম। তাই আমি আজ দুখী! বর্ণা তুইই সুখী!
loading...
loading...
অণুগল্পটি পড়লাম মি. নিতাই বাবু।
আমার দৃষ্টিতে লিখাটি একজন লিখকের আশেপাশে ঘটে যাওয়া অথবা যাপিত জীবনের খুবই কাছাকাছি কোন কাহিনী চিত্রপটের শাব্দিক প্রকাশ মনে হয়েছে।
খুবই চেনা অথবা শোনা। কথাটি এই কারণে বললাম, অমোঘ এই নিয়তি আমার মতো পাঠকের খুব দূর মাত্রার নয় বরং খুব কাছাকাছি। লিখায় সার্থকভাবে দুটি চরিত্রের বিন্যাস ঘটানো হয়েছে যা একজন লিখকের সুক্ষ্ন দৃষ্টিকেই মনে করিয়ে দেয়। ধন্যবাদ।
loading...
আপনার সঠিক উপলব্ধির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, দাদা। আমাদের সামনেই এমন হাজারো ঘটনা মঞ্চস্থ হচ্ছে, দাদা।
শুভকামনা থাকলো।
loading...