(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে একটি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ ত্রয়োদশ পর্ব।)
নিরপেক্ষ বিচারে দেখলে বোঝা যায়, নক্সালাইট মুভমেন্ট প্রতিষ্ঠিতই ছিল ভুল ভিত্তির ওপরে। মাওজেদং এর চীনের বিপ্লব কে অন্ধভাবে অনুসরণ, মাও কে নিজেদের চেয়ারম্যান ঘোষণা, চীনের তত্ব এই জলা জংলা ভূমিতে ইমপ্লিন্টের চেষ্টা, বন্দুকের নলই শক্তির উৎস বলার মত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ, সাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র মনীষীদের মূর্তি ভাঙা, স্কুল কলেজে ভাঙচুর এবং সর্বোপরি অতি সাধারণ মানুষ, যারা রাষ্ট্রশক্তির নীচু তলায় কর্মরত, যেমন- নীচুতলার পুলিশ, অধ্যাপক, রাজনৈতিক কর্মীদের অকারণ হত্যা তাদের মানুষ থেকে ক্রমাগতই বিচ্ছিন্ন করছিল। ভারতের মত বিশাল দেশের সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে তাদের লড়াই যে সম্পূর্ণ অসংগঠিত সম্ভবত তারা তা বুঝতে পারেনি বা বুঝতে চায়নি। অথচ ঐ নেতাদের তত্বে আকৃষ্ট হয়ে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র ছাত্রী, যাঁদের বড় অংশই শহরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন ছিলেন।
একটা ভুল তত্ত্বের ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে নক্সালাইট মুভমেন্ট শুধুমাত্র একটা আলোড়নের সৃষ্টি করা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করতে পারল না। দিশাহীনভাবে তারা শুধু হত্যার রাজনীতিই করে গেল, আর এতে সুবিধা হয়ে গেল রাষ্ট্রযন্ত্রের। পরবর্তীতেও দেখা গেছে নক্সালোত্তর মাওয়িস্টরা সেই একই হত্যার রাজনীতির কুম্ভপাকেই আটকে থাকল। অথচ এই বৃহৎ দেশের মূল যে সমস্যাগুলো- শোষণ, দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমজনতার নাভিশ্বাস সবই সেই একই জায়গায় থেকে গেল। এমনকি টিকে থাকার রাজনীতি করতে গিয়ে মাওবাদীরা সেই দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেই হাত মেলালো কোথাও কোথাও। তাদেরও নেতৃত্বের মধ্যে ঢুকে গেল বিলাসিতা, দুর্নীতির বিষ। মাত্র কয়েকটা রাজ্যে স্রেফ তোলাবাজ হয়েই থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে তারা নিঃশেষ হতে থাকল।
৭২ এ এই টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেই অন্য রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেরও নির্বাচন ঘোষিত হল। অথচ অন্য রাজ্যে যখন পাকিস্তানকে হারানোর আনন্দ রেশ, এখানে তখন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ঢেউ। কেন্দ্রে তখন ইন্দিরার বিশ্বস্ততম মানুষটি এক বাঙালি, সিদ্ধার্থ শংকর রায়। পশ্চিমবঙ্গ শাসনের জন্য তাঁকেই পাঠালেন ইন্দিরা। সেই নির্বাচন স্তম্ভিত করে দিল তাবৎ গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের। ভারতও প্রথম দেখল, শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের জন্য সর্বাত্মক ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রয়োগ। প্রচার থেকে ফলঘোষণা পর্যন্ত বিরোধী দলগুলিকে মাথা তুলতে দেওয়া হল না। সামান্যতম বিরোধিতার আভাস পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছিল প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের লুম্পেনরা। নিগ্রহ, হত্যার বন্যা বয়ে গেল রাজ্য জুড়ে। নির্বাচনের দিন অবাধে বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, বিরোধীদের শারীরিক নিগ্রহ চললো। অবধারিত ভাবেই ফল গেল কংগ্রেসের পক্ষে। মুখ্যমন্ত্রী হলেন সেই সিদ্ধার্থ। ইতিহাসের পাতায় বাহাত্তর এক জ্বলজ্বলে কালো দাগ হয়ে রয়ে গেল।
বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর, এই তিন বছর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল দমন পীড়ন। ব্যারিস্টার বাবার সন্তান নিজেও প্রখ্যাত ব্যারিস্টার এই নবাগত সদ্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন শরণার্থী সমস্যা সহ অন্যান্য মূল সমস্যা মোকাবিলার চেয়ে মন দিলেন বিরোধী দমনে। আর বিরোধী স্বর বন্ধ করার এই মহতী প্রচেষ্টায় প্রাণ দিলেন হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, নাট্যকার, অভিনেতা, কবি সমেত সাধারণ বাড়ীর অতি সাধারণ ছেলেমেয়েরা কেউই রেহাই পেলোনা শাসনদন্ডের প্রহার থেকে। এপার বঙ্গব্যাপী ছেয়ে গেল আতংকের কালো অন্ধকার।
(ফের আগামী কাল)
loading...
loading...
মাওবাদীরা সেই দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেই হাত মেলালো কোথাও কোথাও। তাদেরও নেতৃত্বের মধ্যে ঢুকে গেল বিলাসিতা, দুর্নীতির বিষ। মাত্র কয়েকটা রাজ্যে স্রেফ তোলাবাজ হয়েই থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে তারা নিঃশেষ হতে থাকল।
loading...