খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন শ্রীলংকাকে মনে করা হতো দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক জায়ান্ট। মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পর্যটন এসব খাতে শ্রীলংকার সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। কিন্তু হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করা দেশটি এখন অস্তিত্বের সংকটে। বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট এবং ঋণের ভারে জর্জরিত দেশটি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। কাগজের অভাবে স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট। তেল সংগ্রহের জন্য হাজারো মানুষ লাইনে ভিড় করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পেট্রোল পাম্পগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। এক ইরানের কাছেই জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ আড়াইশ মিলিয়ন ডলার বকেয়া। অথচ ২০০৬ সালে গৃহযুদ্ধ সমাপ্তির পরে শ্রীলংকার মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২০১২ সাল পর্যন্ত ঠিকই ছিল। সে সময় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৩৬ ডলার থেকে বেড়ে হয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। দেশটি ২০১৯ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশেও পরিণত হয়েছিল। কিন্তু কোনো অর্জনই ধরে রাখতে পারেনি। প্রবৃদ্ধি কমতে থাকলে পরের বছরেই বিশ্বব্যাংক তাদের নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে নামিয়ে দেয়। এরপর রপ্তানি কমে চলতি আয়ে দেখা দেয় বড় ভারসাম্যহীনতা। কিন্তু বড় ধস নেমেছে মূলত গত দুই বছরে, করোনা অতিমারির সময়ে। সবশেষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরও বিপদে পড়ে তারা।
আই এম এফ এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর শ্রীলংকাকে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অথচ হাতে আছে ২৩১ কোটি ডলার। সুতরাং ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, নতুন করে আরও ঋণ নিতে হচ্ছে। যতই বলা হোক, চীনের ঋণের ফাঁদে বন্দি শ্রীলংকা। কিন্তু এর একাধিক কারণ রয়েছে। মূলত অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, লাগামহীন বৈদেশিক ঋণ, ঋণ পরিশোধে বেহাল অবস্থা, কর কমানো, পর্যটন ও রেমিট্যান্স খাতের বিপর্যয়, অর্গানিক চাষে বিপর্যয় এবং সংকট সামাল দেওয়ার ব্যার্থতাই বর্তমান মহাবিপর্যের প্রধান কারণ। এ প্রসঙ্গে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরত্নে বলেন, “কিছু বড় বড় প্রকল্প শ্রীলংকার জন্য ‘শ্বেতহস্তীতে’ রূপান্তরিত হয়েছে।”
এবার বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। যদিও আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, শ্রীলংকার সাথে বাংলাদেশের তুলনা করার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমি এও মনে করি, সাবধানের কোনো মার নেই।
ঋণ পরিশোধের দায়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে বিপজ্জনক অবস্থানে নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ। যার মধ্যে বিদেশি ঋণের হার ১৩ শতাংশ। সুতরাং আপাতত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কেননা, আইএমএফের হিসাবে এই হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই বিপদ। তবুও শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর কারণ- যেসব বড় প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে, তার প্রায় সব ক’টিই অবকাঠামো প্রকল্প। এই খাতের ঋণের মধ্যে সরবরাহ ঋণও আছে। যার সুদহার বেশি এবং ঋণ সরবরাহকারীরাই প্রকল্প তৈরি করে দিচ্ছে। এসব প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ না হলে ব্যয় আরও বাড়বে।
তাছাড়া বড় প্রকল্পের কারণে ঋণ পরিশোধের দায় বাড়ছে দ্রুতগতিতে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে যেখানে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ডলার। ফলে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। এদিকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে গেলে কম সুদে আর ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। মিলবে না বাণিজ্যে বিশেষ অগ্রাধিকার সুবিধা।
এসব কারণে অর্থনীতিতে ক্রমাগত চাপ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৫৬২ কোটি ডলার। অন্যদিকে এই অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধিও ঋণাত্মক। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। আমদানি ব্যয় আরও বাড়লে রিজার্ভে টানও বাড়বে। সুতরাং আগে থেকেই সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
————————–
loading...
loading...
এইসব লেখায় উৎসাহিত হয়ে লুটেরা আর সম্পদ পাচারকারি তাড়াতাড়ি বিদেশে পালাবে আরো বেশী অর্থ-সম্পদ নিয়ে।
loading...
প্রবৃদ্ধি কমতে থাকলে পরের বছরেই বিশ্বব্যাংক তাদের নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে নামিয়ে দেয়। এরপর রপ্তানি কমে চলতি আয়ে দেখা দেয় বড় ভারসাম্যহীনতা। কিন্তু বড় ধস নেমেছে মূলত গত দুই বছরে, করোনা অতিমারির সময়ে। সবশেষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরও বিপদে পড়ে তারা।
loading...